Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বনাথ আর গুগাবাবার ম্যাজিক

সত্যজিৎ রায়ের করা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির স্কেচ, হোর্ডিংয়ের জন্য। এই ‘আজব’ ছবি চিরকাল বাঙালির অমলিন আনন্দের উৎস। ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায় ।ষাটের দশকের একেবারে শেষ বছর। ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়ে ক্লাস সিক্সে উঠেছি। সবে জ্ঞানবৃক্ষের ফল একটু একটু করে খেতে শিখছি। গল্পের বই আর রেডিয়ো-নাটক ছিল আমার প্রধান আকর্ষণ। যা পেতাম, তা-ই পড়তাম, টেলিফোন-গাইড বা রেলের টাইমটেবিলও বাদ যেত না। তবে সবচেয়ে ভাল লাগত দেব সাহিত্য কুটিরের শারদ সংকলনগুলি— ‘অরুণাচল’, ‘বেণুবীণা’, ‘ইন্দ্রনীল’ ইত্যাদি।

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

ষাটের দশকের একেবারে শেষ বছর। ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়ে ক্লাস সিক্সে উঠেছি। সবে জ্ঞানবৃক্ষের ফল একটু একটু করে খেতে শিখছি। গল্পের বই আর রেডিয়ো-নাটক ছিল আমার প্রধান আকর্ষণ। যা পেতাম, তা-ই পড়তাম, টেলিফোন-গাইড বা রেলের টাইমটেবিলও বাদ যেত না। তবে সবচেয়ে ভাল লাগত দেব সাহিত্য কুটিরের শারদ সংকলনগুলি— ‘অরুণাচল’, ‘বেণুবীণা’, ‘ইন্দ্রনীল’ ইত্যাদি। আরও দুটো জব্বর আকর্ষণ ছিল ইন্দ্রজাল কমিক্স-এর বেতাল-ম্যানড্রেক-ফ্ল্যাশ গর্ডন আর স্বপনকুমারের সিরিজগুলো— ‘বিশ্বচক্র’, ‘বাজপাখী’, ‘নিয়তি’, ‘কালনাগিনী’। বেতালের প্রেমিকা ডায়না, ম্যানড্রেক-এর নার্দা স্বপ্নে দেখা দিত। স্বপনকুমারের বইগুলো অবশ্য লুকিয়ে পড়তে হত। গেঞ্জির তলায়, হাফপ্যান্ট আর পেটের সন্ধিস্থলে চটি-চটি বইগুলো লুকিয়ে নিয়ে সিধে বাথরুম। গোগ্রাসে গিলতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বাভাবিক দেরিতে বাথরুম থেকে বেরোতাম। মা ভুরু কুঁচকে তাকাতেন।

প্রতি বুধবার সন্ধে সাড়ে ছ’টায়, শনিবার দুপুর তিনটে, রোববার বেলা একটায় আর অধিকাংশ শুক্রবার রাত আটটায় হত রেডিয়োর নাটক। সেখানেই শুনি প্রথম সিরিয়াল, শনিবার দিন ‘ব্যোমকেশ’ আর রোববারে ‘দিশেহারার কড়চা’। অন্য নাটকগুলোর মধ্যে এখনও মনে আছে ‘ডানাভাঙা পাখি’, ‘নাইন আপ’, ‘রাজযোটক’, ‘টাকার রঙ কালো’।

এই সব কিছুর মধ্যেই ১৯৬৯ সালটায় পাঁচ-পাঁচটা এমন ঘটনা ঘটল, যা আমার যাবতীয় আকর্ষণের মোড়ই শুধু ঘুরিয়ে দিল না, আমার পরবর্তী জীবনকেও অনেকটা প্রভাবিত করল। এক এক করে সেগুলোর কথা বলি।

প্রথম ঘটনা: ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন তারার জন্ম— গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ। সেই বছর বিল লরি-র নেতৃত্বে দারুণ শক্তিশালী অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল ভারত সফরে এসেছিল। সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই ভারতীয় ক্রিকেট দলে আবির্ভাব সেই অসামান্য ব্যাটিং-শিল্পীর। প্রথম ইনিংসে হায়-হায় করা শূন্য-র পর, দ্বিতীয় ইনিংসে বিশ্বনাথ করেছিলেন হইহই করা সেঞ্চুরি— ১৩৭! সেই যে আমার প্রিয় ক্রিকেটার হয়ে গেলেন বিশ্বনাথ, অনেক বেশি বিখ্যাত ও অধিক-আলোচিত গাওস্করও কখনও আমার কাছে সেই জায়গাটা দখল করতে পারেননি। এই বিশ্বনাথের জন্য চিরকালের মতো ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটই আমার কাছে বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছিল।

পরের ঘটনাটা একেবারেই কলকাতা-কেন্দ্রিক। অ্যালবার্ট ডিউক আর পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় নামে দুই অসমসাহসী যুবক, পালতোলা কাঠের নৌকোয় কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট থেকে রওনা দিয়ে, বিপদসংকুল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে, আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার-এ পৌঁছন। সেই সময়ের খবরের কাগজগুলোতে তাঁদের রোজকার যাত্রা-বিবরণ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হত। মাঝখানে দিন দুয়েক কি তিনেক তাঁদের সঙ্গে বেতার-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সারা বাংলা আকুল হয়ে উঠেছিল তাঁদের খোঁজে। সমস্ত বাঙালি তরুণীর হৃদয় উদ্বেল করা এই দুই যুবক যে দিন কলকাতায় ফিরে আসেন, সে দিন সারা শহর ভেঙে পড়েছিল। আমিও তার পর থেকে বেশ একটু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম।

তৃতীয় ঘটনাটা তো জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। ১৯৬৯ সালের ৮ মে মিনার-বিজলী-ছবিঘরে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। ছবি রিলিেজর প্রথম সপ্তাহেই বাবার সঙ্গে দেখতে গেলাম। জ্ঞানত সেই প্রথম আমার সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখতে যাওয়া। যেমন গান, তেমনই গল্প আর অভিনয়ও। এইচএমভি থেকে বেরনো এলপি রেকর্ডে (বাংলার প্রথম এলপি) ছবির সব ক’টা গান তো ছিলই, আবার ভূতের রাজার অদ্ভুত গলায় বর দেওয়ার পুরো সংলাপগুলোও ছিল। রেকর্ডটা তখনই কিনে নিয়েছিলাম। সেই সময়ের এবং এখনও আমার প্রিয় তিনটি এলপি রেকর্ডের মধ্যে (বাকি দুটি ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ আর ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র) মধ্যে জ্বলজ্বল করছে ‘গুগাবাবা’। সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রতি আমার ভালবাসা গড়ে দিয়েছিল এই ছবিই, পরে যে ফিল্ম ক্লাবের মেম্বার হয়ে প্রচুর দেশি-বিদেশি ছবি দেখেছি, তারও গোড়ায় এই ছবির ভাললাগাটাই কাজ করেছে।

চতুর্থ ঘটনাটার প্রভাব তখনকার মতো সাংঘাতিক হলেও পরে ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। ১৯৬৯-এর ৮ জুলাই দুই আমেরিকান নভশ্চর নিল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন চঁাদে পা রাখলেন, অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানে চেপে। ভয়ংকর উত্তেজিত হয়েছিলাম সে খবর শুনে। যদিও বিদ্যালয় পর্যায়েই আমার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইতি ঘটেছিল, কিন্তু এই ঘটনার প্রভাবেই আমার মনে বিজ্ঞানমনস্কতার একটা জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

আর, সেই বছরেই পুজোয় এইচএমভি থেকে বেরলো রাহুল দেববর্মন-এর দুটো গান: ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ আর ‘ফিরে এসো অনুরাধা’। কথা শচীন ভৌমিকের, সুর শিল্পীর নিজেরই। গায়ক হিসেবে রাহুল দেববর্মনের আত্মপ্রকাশ ছিল এই দুটো গানেই। তখনও অবধি শোনা আর সব বাংলা আধুনিক গানের থেকে কথায় ও সুরে অনেকটাই আলাদা। অচিরেই এই মানুষটার সুর ও গলার বেজায় ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। এখনও অবধি ওঁর করা সুরের চেয়ে বেশি আধুনিক কোনও সুর আমি শুনেছি বলে মনে হয় না। ভারতীয় লঘুসংগীতের জগতে রাহুল দেববর্মন ছিলেন আমার মতে শেষ মুঘল। তার পর শুধুই ‘চেঁচাইছিলি কেনে?’

সোমনাথ রায়, অটল সুর রোড, কলকাতা

somnathray09@yahoo.in

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE