Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘সগর্বে বলতে পারি, আমিই ভারতের প্রথম এলজিবিটি রাজা’

সে দিনই ৩৭৭ ধারা বাতিল হল। রাজপরিবারের ছেলে হয়েও বারো বছর আগে যে দিন নিজেকে ‘গে’ বলে ঘোষণা করেছিলাম, মা-বাবা রেগে গিয়েছিলেন। আমাদের প্রজারাও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তবু এই দিনটার জন্যই লড়াই করে গিয়েছি। স্বাধীনতা পেলাম গত ছয় সেপ্টেম্বরসে দিনই ৩৭৭ ধারা বাতিল হল। রাজপরিবারের ছেলে হয়েও বারো বছর আগে যে দিন নিজেকে ‘গে’ বলে ঘোষণা করেছিলাম, মা-বাবা রেগে গিয়েছিলেন। আমাদের প্রজারাও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তবু এই দিনটার জন্যই লড়াই করে গিয়েছি। সগর্বে বলতে পারি, আমিই ভারতের প্রথম এলজিবিটি রাজা।

মানবেন্দ্র সিংহ গোহিল
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আমার মায়ের তখন পূর্ণ গর্ভাবস্থা। যে কোনও সময় প্রসব হতে পারে। রানি রুক্মিণীদেবী, অর্থাৎ আমার মা হলেন জয়সলমেরের রাজকুমারী। বিয়ে হয়েছিল গুজরাতের রাজপিপলার রাজপুত রাজা রঘুবীর সিংহের সঙ্গে। আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান এবং একমাত্র ছেলে। আমার জন্মের আগে রীতি মেনে মা ছিলেন তাঁর বাপের বাড়ি, জয়সলমেরে। এ দিকে তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সালটা ১৯৬৫। পাকিস্তান-সীমান্ত ঘেঁষা জয়সলমের ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। হামলার ভয়ে যে যেখানে পারছেন পালাচ্ছেন। প্রাসাদে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা। রাজ-চিকিৎসক জানালেন, এই রকম অবস্থায় জয়সলমেরে প্রসব ঝুঁকির হয়ে যাবে। বিকল্প ব্যবস্থা ঠিক হল।

মা-কে পাঠিয়ে দেওয়া হল অজমেঢ়-এ। জানেন হয়তো, ওখানে মেয়ো কলেজ আছে। ভারতের অন্যতম সেরা বোর্ডিং স্কুল। আমাদের দেশের, বিশেষ করে বেশির ভাগ রাজপুত রাজপরিবারের ছেলেরা ওখানে পড়ে। রাজপুত্রেরা সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে হস্টেলে থাকে না। স্কুল চত্বরের লাগোয়া এক-একটি রাজপরিবারের আলাদা প্রাসাদ রয়েছে। ঠাকুর, চাকর, লোক-লশকরের অভাব নেই খিদমত খাটার জন্য। সেখানে থেকে রাজপুত্রেরা পড়াশোনা করে। মা গিয়ে উঠলেন মেয়ো কলেজের পাশে আমার মামাবাড়ির প্রাসাদ জয়সলমের হাউস-এ।

অদ্ভুত সমাপতন, যে দিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল, সেই ২৩ সেপ্টেম্বর আমি জন্মালাম। রাজপরিবারের ভিতরে, এস্টেটের প্রজাদের মধ্যে ধন্য-ধন্য পড়ে গেল। আহা! কোন দেবদূত এসেছেন রাজপুত্র হয়ে, যে কিনা জন্মেই যুদ্ধ থামিয়ে দিল! তাঁরা তখন কল্পনাও করতে পারেননি, সেই রাজপুত্র বড় হয়ে এমন যুদ্ধ ঘোষণা করবে যাতে তাঁদের পিলে চমকে যাবে, ধ্যানধারণার ভিত নড়ে যাবে, গোটা দেশে ঝড় উঠবে।

দর্শনীয়: পারিবারিক মিউজিয়মে। শিকার ছিল অামাদের রাজপরিবারের অন্যতম শখ।

আমি, রাজপিপলার গোহিল রাজবংশের ৩৯তম পুরুষ এবং রাজসিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী, আমি হলাম ভারতের প্রথম ঘোষিত সমকামী বা ‘গে’ রাজা! ২০০৬ সালে আমি যখন প্রথম গুজরাতের একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের যৌন-অবস্থান প্রকাশ্যে আনলাম, তখন আমার গোটা পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়, প্রজারা বজ্রাহত হয়েছিলেন। তাঁদের ভাবনাচিন্তা এমনকি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছিল। স্তব্ধতার পরেই ঝড় আসে। রাজপিপলাতেও ‘আঁধি’ শুরু হল।

বাবা-মা ভাবলেন, হয় ছেলে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে, নয়তো কেউ তুকতাক করেছে, কোনও ভূতপ্রেতের কুনজর লেগেছে। অদ্ভুত রাজকীয় ইগো তাঁদের। যুগ যুগ ধরে রাজপরিবারগুলি পারিবারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির উপর প্রাণপণ পর্দা টেনে এসেছে, সেখানে আমার ঘটনা তো যাকে বলে ‘সুপার-ডুপার কেচ্ছা’! রাজা মানে এস্টেটের লোকেদের কাছে ভগবানের অংশ, অতিমানব, রক্ষাকর্তা, হি-ম্যান। তাঁকে স্পর্শ করতেও ইতস্তত করেন তাঁরা। সেই ‘শক্তিমান’ পুরুষটি অক্ষরে-অক্ষরে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে পা ফেলবেন, বহিরঙ্গে একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা রাজার প্রতিভূ হবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। সেখানে সেই রাজার একমাত্র বংশধর, অর্থাৎ ১৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো সাম্রাজ্যের পরবর্তী রাজা কি না সমকামী! ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিল রাজপিপলায়।

এক অনুষ্ঠানে বন্ধু-পরিজনের সঙ্গে। প্রাসাদের সামনে তোলা

অথচ রাজপরিবারগুলোর মধ্যে সমকামিতা যুগযুগান্ত ধরে ছিল, রয়েছে, থাকবে। সবাই জানে, কিন্তু সর্বসমক্ষে স্বীকারের কথা ভাবতেই পারে না। তাতে তাঁদের ঠুঁটো পারিবারিক মর্যাদা খানখান হয়ে যাবে। অতএব, পারিবারিক সম্মানের ধ্বজা উড়িয়ে সেই মানুষগুলি বিষমকামী এবং সমকামীর দ্বৈত জীবনের গিলোটিনে প্রতিদিন মাথা রাখবে, রক্তাক্ত হবে। আমি নিজেই এই রকম অনেক রাজা ও রাজপুত্রকে চিনি।

আমার বাবা-মা’ও আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করলেন। ‘‘অমুককে বলে দেব, তমুককে জানিয়ে দেব। দেখবে তখন তোমাকে আর ভালবাসবে না, তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না, মুখ দেখবে না, সিংহাসন হাতছাড়া হবে, এস্টেট রসাতলে যাবে,’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তখন ভাবলাম, ধুত্তোর! তোমরা কী বলবে, আমিই তার আগে গোটা পৃথিবীতে ‘ব্রেকিং নিউজ’ করে দিচ্ছি। স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, আমি কে বা কী। কোনও লোক-দেখানো ভাবমূর্তি, কোনও মিথ্যা, কোনও টানাপড়েনের সঙ্কটে আমি নেই।

সেটা প্রায় এক যুগ আগের কথা। ২০০৬ সাল। সমকামিতা তখনও ভারতে অপরাধ। আমি আমার ‘গে’ পরিচয় সর্বসমক্ষে আনলাম। আমাকে নগ্ন করে মারতে মারতে এস্টেট থেকে বার করার দাবিতে রাজপিপলায় লোকজন রাস্তায় নামলেন। আমার কুশপুতুল জ্বালানো হল। বাবা-মা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন। প্রাসাদ ছাড়তে হল। যদিও ‘ত্যাজ্য’ করার ব্যাপারে কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ায় এক মাসের মধ্যেই আবার বাবা প্রাসাদে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাবা কোথাও একটা আমার অবস্থানকে ভিতরে-ভিতরে সম্মান এবং সমর্থন করতেন, আমি বুঝতে পারতাম। মায়ের সঙ্গে কোনও দিনই আমার তেমন সম্পর্ক ছিল না, এই ঘটনার পরে সেই জ্যালজেলে হয়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতোটা ছিঁড়েই গেল। বাঁচা গেল।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা! এ কেমন কুপুত্র যে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ নিয়ে মোটেই দুঃখী নয়? এ ক্ষেত্রে আমি বলব, নদীর ও পারে সব ঘাস বেশি সবুজ মনে হলেও আসলে সেটা নয়। রাজপরিবার মানেই বাইরে থেকে লোকজন মনে করে আমরা খুব ভাগ্যবান, সেটা এক্কেবারে ভুল। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা অনেক বঞ্চিত, অসুখী। আমার দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি জানতামই না রানি রুক্মিণীদেবী আমার আসল মা। তিনি আমার কাছে ‘হার হাইনেস’ বা রানিসাহেবা’ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, আর বাবা ‘রাজাসাহেব’। রানিসাহেবার কাছে ছোটবেলায় কোনও দিনই থাকিনি আমি। আমাকে লালন করেছিলেন আমার দাই-মা রুকমন কুমার।

বেশির ভাগ রাজপরিবারে এটাই রীতি। নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম থেকে আত্মিক দূরত্ব তৈরি করে ছেলেমেয়েদের মানসিক ভাবে ‘দৃঢ়’ করার চেষ্টা। আমাকে তো এখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ নিয়ে বাবা বা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হয়। আমাদের ছোটবেলা থেকে সমস্ত পূর্বসূরির নাম মুখস্থ করতে হয়, অথচ পরিবারের সঙ্গে আমাদের ‘অ্যাটাচমেন্ট’ শূন্য। সে যা-ই হোক, আমি আমার দাই-মাকেই নিজের মা বলে জানতাম। তিনি আবার আমার মায়েরও দাই-মা ছিলেন। মা যখন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি আসেন, তখন দাই-মা সঙ্গে এসেছিলেন।

অদ্ভুত একটা ‘অতি প্রোটেকটিভ’ অথচ আদ্যন্ত নিরাপত্তাহীন জীবন ছিল আমার। বলতে পারেন মাটিতে পা ফেলতে হত না। ষোলো বছর বয়সে প্রথম একা রাস্তা পার হয়েছি। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গাঁধী ভারতীয় রাজাদের ‘ডি-রেকগনাইজ’ করার পরেও মুম্বইয়ে আমাদের বাড়িতে আমার জন্য ২৩ জন পরিচারক ছিলেন। কিন্তু পরিবারের লোকেদের সাহচর্য, আদর, আত্মীয়তা কাকে বলে, আমি জানতাম না। মা-বাবার সঙ্গে কথাই হত না, দেখাও হত কালেভদ্রে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, স্কুলে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করব সেটাও রাজপরিবার ঠিক করে দিত। ভুল করে কোনও সাধারণ ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেললে বকুনি খেতে হত এবং পত্রপাঠ সেই বন্ধুত্ব ভাঙতে হত। বিভ্রান্ত, বিচলিত, লজ্জিত, অবসাদে তলিয়ে-যাওয়া আমি বন্ধু পাতানোই বন্ধ করে দিলাম। স্কুলে কোনও বন্ধু ছিল না আমার। বুদ্ধি ভালই ছিল, কিন্তু অত্যন্ত লাজুক, অন্তর্মুখী ছিলাম। সারা দিন একা, চুপচাপ বসে থাকতাম। বাড়িতে সব সময় চার দিকে গাদাগাদা চাকরবাকর। এঁরাই সর্বক্ষণের সঙ্গী, আর দাই-মা। ফলে তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে যখন প্রথম আমার নিজের যৌনতা, নিজের শরীর নিয়ে কৌতূহল তৈরি হচ্ছে, যখন একটু-একটু করে বুঝছি কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে, হিসেব মিলছে না, তখন সেই অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার, বা পরামর্শ করার লোকও ছিল না। কাকে বলতাম? পরিচারকদের তো এ সব বলা যায় না।

আমি পড়াশোনা করেছি মুম্বইয়ে। প্রথমে বম্বে স্কটিশ স্কুল, তার পর মিঠিভাই কলেজ ক্যাম্পাসের অম্রুতবেন জীবনলাল কলেজ অব কমার্স অ্যান্ড ইকনমিক্স-এ। ছোটবেলায় যখন দেখতাম, বন্ধুদের বাবা-মায়েরা স্কুলে আসছেন, সবার সামনে জড়িয়ে ধরছেন, গল্প করছেন, চুমু খাচ্ছেন, আমি হতভম্ব হয়ে যেতাম। এই রকম যে হয় তার কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। ভীষণ একা ছিলাম আমি। আর পৃথিবীটাও তখন বড্ড ছোট ছিল। সত্তরের দশকে কম্পিউটার, গুগল, ইন্টারনেট নেই। টিভিতে হরেক চ্যানেল নেই। সমকামী, রূপান্তরকামী কী বস্তু, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। ফলে আমিও ভাবতে শুরু করলাম, এ রকম বোধ হয় এই বয়সে সব ছেলেদের হয়, পরে বয়স বাড়লে, বিয়ে হলে ঠিক হয়ে যাবে। দোনামোনায় ভুগতে-ভুগতে ২৫ বছর বয়সে বাবা-মায়ের ঠিক করা পাত্রীকে বিয়েও করে ফেললাম। সেটা ১৯৯১ সাল। আমার স্ত্রী চন্দ্রিকা কুমারী মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ার রাজকুমারী। এখনও আপশোস করি ওর জীবন নষ্ট করার জন্য। তবে আমি খুশি, বিবাহবিচ্ছেদের পর ও আবার বিয়ে করে ভাল আছে।

বিয়ের পর কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। আমাদের রাজপরিবারে বিচিত্র সব ব্যাপার আছে। নিজেদের মধ্যে কথা বা যাকে ‘কমিউনিকেশন’ বলে সেটা ভীষণ কম। আমার অবস্থা নিয়ে আমার আর চন্দ্রিকার মধ্যেও কোনও দিন খোলাখুলি কথা হয়নি। তবে ও বিয়ের ১৫ মাসের মধ্যে ডিভোর্স ফাইল করল। কারণ দেখিয়েছিল, আমি ‘ইমপোটেন্ট’ বা অক্ষম। আমিও ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে প্রমাণ করেছিলাম, আমি ‘অক্ষম’ নই। এ বার বিষয়টা দুই রাজপরিবারের ইগোর লড়াইয়ে পরিণত হল। চন্দ্রিকা কিছু দিনের মধ্যে আবার বিয়ে করল আর তার যোগ্য জবাব দিতে আমার বাবা-মাও আমাকে ফের বিয়ে দিতে খেপে উঠলেন। আমিও একবগ্গা। আর বিয়ে কিছুতেই নয়। ভিতরে-ভিতরে তখন আমি মরিয়া। আমি আসলে কী, সেটা খুঁজে বার করতেই হবে।

প্রচুর বিদেশি পত্রপত্রিকা ঘাঁটা শুরু করলাম। সেখানেই কোথাও সমকামী আন্দোলনের কর্মী, ‘বোম্বে দোস্ত’ পত্রিকার অশোক রাও কবি-র কথা জানলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। আমার পুনর্জন্ম হল। আমি আসলে কী, কী আমার সেক্সুয়ালিটি বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন, সেটা বুঝলাম ৩০ বছর বয়সে। বুঝলাম, এটা রোগ নয়। এটা জন্মগত, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তখনও খোলাখুলি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারছি না, আমার নিজের পরিচয়ে সামনে আসতে পারছি না। ভিতরে ক্রমাগত গুমরে গুমরে থেকে ২০০২ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউনে শয্যাশায়ী হলাম। সেটাই টার্নিং পয়েন্ট। আমাদের পারিবারিক মনোচিকিৎসককে সব জানালাম এবং আমারই নির্দেশে তিনি বাবা-মা আর আমার একমাত্র ছোটবোন মীনাক্ষীকে (যিনি জম্মুর এক রাজপরিবারের রানি) সব জানালেন।

বাবা-মা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। তার পর ভাবলেন এটা মানসিক রোগ, শক থেরাপি করাতে হবে। এবং তার পর আমাকে নিয়ে একের পর এক সাধুসন্তের কাছে দৌড়তে শুরু করলেন। কেউ নিদান দিলেন, খাতায় রোজ তিন পাতা করে রামনাম লিখতে হবে, আবার কেউ বললেন, নিরামিষ খাওয়া ধরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কিছুতেই বাড়িতে বোঝাতে পারলাম না যে, আমাদের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যেই প্রচুর সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী রয়েছে, আবার উদ্ভট যৌনাচারও রয়েছে। আরও মজার কথা হল, আমার বোন নিজে সাইকোলজির ছাত্রী। অথচ সে ভেবে বসল, সমকামিতা আর পিডোফিলিয়া (শিশুদের সঙ্গে যৌনাচার) এক। ফলে সে তার ছেলেমেয়েদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা বন্ধ করে দিল। পাছে তাদের মামা তাদের ক্ষতি করে দেয় বা তাদের ‘সমকামী’ করে ফেলে।

ধাক্কা কম খেলাম না, যুদ্ধও প্রচুর হল। এবং শেষ পর্যন্ত গত ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যুদ্ধজয় হল। গোটা দেশের কাছে স্বাধীনতা দিবস হল ১৯৪৭ এর ১৫ অগস্ট, কিন্তু আমার কাছে ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। স্বাধীনতা, মুক্তি। এর মাঝখানে অবশ্য দিন বদলেছে। অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।

মানুষ অন্য ধরনের যৌনতা সম্পর্কে এখন বেশ সচেতন। সংবাদমাধ্যমে অনেক প্রচার বেড়েছে। আমার নিজের এস্টেটের মানুষ আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। ২০০০ সালে ‘লক্ষ্য ট্রাস্ট’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করে সমকামিতা ও এইচআইভি-র উপর আমার এস্টেট ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার ও সচেতনতা অভিযান চালাচ্ছি। আমার যে বোন আমাকে ‘পিডোফিলিক’ ভেবেছিল তার ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিরা এখন আমার অন্যতম সমর্থক ও শক্তি। ওরা আমার ট্রাস্টের ভার নিয়েছে। আরও শুনবেন? আমার বাবা রাজপিপলায় ১৫ একরের একটা পৈতৃক জায়গা আমাকে দিয়েছেন। সেখানে অসহায়, অত্যাচারিত, ঘরছাড়া সমকামী, রূপান্তরিত মানুষদের আশ্রয় দেওয়া এবং তাঁদের কাজের সংস্থান করে দেওয়ার কেন্দ্র খুলেছি। আমার বাবা নিজের হাতে সেই কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এর থেকে বড় সাফল্য কী হতে পারে!

আমার এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। অনেক অনেক কাজ, সেই তুলনায় জীবনটা খুব ছোট। প্রথম ভারতীয় ‘গে’ রাজা হিসেবে ইতিমধ্যেই সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে ওপরা উইনফ্রে-র শো থেকে বিবিসি, অনেককে। স্বেচ্ছায় হেঁটেছি সুইডেনের ‘গে প্রাইড ফেস্টিভ্যাল’-এ। প্রেম করা, সম্পর্কে জড়ানোর আর কোনও ইচ্ছা আমার নেই। বেশ কয়েক বার ধাক্কা খেয়ে বুঝেছি, যাঁরা কাছে আসেন তাঁদের ধান্দা থাকে। তাঁরা আমার পরিবার, অর্থ, পরিচয়কে আসলে ব্যবহার করতে আসেন। তার থেকে এই বেশ আছি নিজের কাজ নিয়ে। এস্টেটের ভারও

এ বার নিতে হবে। সেটা আমার কর্তব্য। আমি যুবরাজ মানবেন্দ্র সিংহ গোহিল— দেশের প্রথম ঘোষিত সমকামী রাজা— সব চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত!

অনুলিখন: পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE