Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

পরিত্যক্ত বুধনি

প্রায় ৫৮ বছর আগে তাঁর হাতেই উদ্বোধন হয়েছিল পাঞ্চেত বাঁধের। কিন্তু আদিবাসী সমাজ তাঁকে ত্যাগ করে। ঝাড়খণ্ডের গ্রামে আজও সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন বুধনি। ঊর্মি নাথ দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সে দিন পা়ঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বাঁধের কাজ শুরু হতে কাজের সুযোগ পেয়েছিল চারপাশের গ্রামের বেশ কিছু আদিবাসী নারী-পুরুষ।

বিস্মৃত: ১৯৫৯ সালে নেহরুর সঙ্গে পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধনে বুধনি।

বিস্মৃত: ১৯৫৯ সালে নেহরুর সঙ্গে পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধনে বুধনি।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বলিরেখা ভর্তি মুখ। বয়স ৭৮। ১৯৫৯-এর ৬ ডিসেম্বর, তিনিই সুইচ টিপে উদ্বোধন করেন দামোদর নদীর উপর পা়ঞ্চেত বাঁধ। তিনি বুধনি, আজও বেঁচে আছেন।

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সে দিন পা়ঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বাঁধের কাজ শুরু হতে কাজের সুযোগ পেয়েছিল চারপাশের গ্রামের বেশ কিছু আদিবাসী নারী-পুরুষ। উদ্বোধনের দিন নেহরুকে দেখার জন্য তারাও হাজির ছিল সে দিন। নেহরুর গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানাবে কে? দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের কর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দায়িত্ব পড়ল রাবণ মাঝি ও ১৫ বছরের সাঁওতাল মেয়ে বুধনির উপর। গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানালেন বুধনি। নেহরু খুশি। নিজে নন, বাঁধ উদ্বোধন করালেন বুধনিকে দিয়ে। উদ্বোধনী বক্তৃতায় নেহরু বললেন, এই বাঁধই হল টেম্পল অব ডেভেলপিং ইন্ডিয়া।

এই ঐতিহাসিক দিনে চিরতরে পালটে গেল বুধনির জীবন। উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শেষে বুধনি বাড়ি ফিরছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে। যে প্রাপ্তি তার কাছে আশাতীত ছিল। কিন্তু সুখাবেশ ক্ষণস্থায়ী হল। বাড়ি ঢোকার আগেই গ্রামের মোড়লরা তাকে পাকড়াও করল। কেন? তার বিচার হবে। বুধনি বুঝে উঠতে পারছিল না, সে কী অপরাধ করেছে! মোড়লদের মতে, তার অপরাধ, সে পরপুরুষের গলায় মালা পরিয়েছে! সে অবিবাহিত, তাদের আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী অবিবাহিত মেয়ে কোনও পুরুষের গলায় মালা পরালে ধরে নেওয়া হয় তারা বিয়ে করল। সে দিক থেকে দেখলে বুধনি তখন নেহরুর স্ত্রী! কিন্তু নেহরু তো আর সাঁওতাল নন, তাই বেজাতে বিয়ে করার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হয় বুধনিকে। বহিষ্কৃত করা হয় সমাজ থেকে।

এই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় ৫৮ বছর। পাঞ্চেত বাঁধ পেরিয়ে তাঁর বাড়ির পথ সন্ধান করতে গিয়ে অবাক হতে হল। অটোচালক, দোকানদার, রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষ, প্রায় সকলেই বুধনির বাড়ির পথ চেনেন। বুধনির কথা উঠতেই তাঁদের মধ্যে এক জনের প্রশ্ন, ‘‘আপনি কি সিনেমার লোক?’’ হঠাৎ এ প্রশ্ন? জানালেন, ‘‘কয়েক দিন আগে মুম্বই থেকে এক জন পরিচালক বুধনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর বায়োপিক করতে চান। অনেক টাকা অফার করা হয়েছিল বুধনিকে। কিন্তু টাকার অঙ্ক মোটা হলেও বুধনি রাজি হয়নি।’’ কেন? সে উত্তর অবশ্য তাঁদের জানা নেই।

গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে ইটের তৈরি ছোট্ট অতি সাধারণ একতলা বাড়ি। এখানেই বুধনি থাকেন। অতিথির আগমনে মোটেও খুশি হননি তিনি। প্রতিবেদকের আসার উদ্দেশ্য ঘরের ভিতর থেকেই শুনলেন। কোনও রাখঢাক না করেই ভিতর থেকেই বললেন পত্রপাঠ বিদেয় হতে। নাছোড়বান্দা প্রতিবেদক তাঁকে যখন জানালেন, তাঁকে একটি বার দেখতে চান, তখন বোমা ফাটার মতো ফেটে পড়লেন বুধনি, ‘‘কী দেখবেন, কী দেখার আছে? আপনারা দেখলে আমার কী লাভ? আপনারা খবর নিয়ে যাবেন। তাতে আমার কি কোনও লাভ হবে?’’

এখনকার ছবি

ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি যেন জেগে উঠল অনেক দিন পরে। কথাগুলো বলতে বলতে ঘর ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন বুধনি। প্রতিবেদককে চুপ থাকতে দেখে হয়তো মায়া হল। দাওয়ায় বসে ইশারায় নির্দেশ দিলেন পাশে বসতে।

পরপুরুষের গলায় মালা পরালে বিয়ে হয়ে যায়, সে কথা জানতেন না? ‘‘সাহেব সুবারা বলেছিল। আমি কী করব! তখন তো আমি ছোট, আমার মাথায় কি বুদ্ধি ছিল? বুদ্ধি থাকলে কি এমন কাজ করতাম? যাদের ছিল তারা তো সব পিছিয়ে গেল।’’ নেহরু কিছু বলেননি আপনাকে? ‘‘কী বলবে ও! শুধু বলেছিল, বেটি, তোমার জীবনভর চাকরি রইল।’’ অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আর দিতে চান না বুধনি। আর পিছন ফিরে তাকাতে চান না।

নীরব বুধনি দাওয়া থেকে উঠে উঠোন ঝাঁট দিতে থাকেন। সব কাজ কি আপনি নিজেই করেন? সঙ্গে সঙ্গে হাতের ঝাড়ু থামিয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে বুধনির উত্তর, ‘‘আর কে করবে?’’ সপ্তাহ কয়েক আগে ধর্মঠাকুরের উৎসবে... প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই বললেন, ‘‘আমি যাই না কোথাও। কেন যাব?’’

বুধনি এখনও দামোদর ভ্যালি করপোরেশনের কর্মী। যদিও জীবনভর চাকরি থাকার আশ্বাস পাওয়ার পরও কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাঁকে। শোনা যায়, বুধনিকে সমাজ ত্যাগ করার পর তিনি সুধীর দত্ত নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় পান। বুধনির একটি মেয়েও হয়। মেয়েটিও সাঁওতাল সমাজে ঠাঁই পায়নি।

১৯৬২ সালে ডিভিসির চাকরিটিও চলে যায় বুধনির। কুড়ি বছরেরও পর, ১৯৮৫ সালে রাজীব গাঁধীর হস্তক্ষেপে আবার ডিভিসিতে চাকরি পান তিনি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গেল, তাঁর নাতিকে নাকি সরকার চাকরি দিয়েছে। বুধনিকেও ডিভিসি থেকে পাকা বাড়ি করে দেওয়া হবে। বাড়ি করে দেওয়ার ব্যাপারটা বুধনি নিশ্চিত করলেও মেয়ে-নাতির প্রসঙ্গ উঠতে তিনি নিরুত্তর থাকলেন।

তিক্ত স্মৃতিমন্থনে তিনি নারাজ। ৭৮ বছরের বুধনিকে দেখে বোঝা যায় না, তিনি মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। এই রোগের জন্যই বহু দিন হল ভাত খাওয়ার অভ্যেস ছেড়েছেন। যদিও রান্না করা থেকে কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা— এই বয়সেও তিনি নিজের হাতে করেন। কালের নিয়মে সমাজ আজ বদলেছে অনেকটাই, একঘরে হয়ে থাকার নিয়ম শিথিল হয়েছে, কিন্তু যে সমাজ তাঁকে বিতাড়িত করেছিল, সেখানে আর তিনি ফিরে যাননি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, উৎসব-আনন্দ-সামাজিকতা— সমস্ত কিছু থেকে তিনি নিজেকে ব্রাত্য করে রেখেছেন আজ। নিজেকে স্বেচ্ছায় ব্রাত্যই করে রাখতে চান শহুরে মানুষদের কাছ থেকেও।

বুধনির বর্তমান ছবি: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE