Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাংলার পর্বতারোহণের ইতিহাসে পেম্বাকে বাদ দেওয়া যাবে না

কয়েক দিন ধরে বরফের গহ্বরে তার দেহ। কেউ খোঁজও পায়নি। গত কয়েক বছরে আমরা বাঙালিরা এভারেস্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, ধৌলাগিরি, যত আট হাজারি শৃঙ্গ জয় করেছি, বেশির ভাগের পিছনেই দার্জিলিঙের এই শেরপা বাঙালি। বাংলার পর্বতারোহণের ইতিহাস থেকে ওকে বাদ দেওয়া যাবে না। দেবাশিস বিশ্বাসআট হাজারি শৃঙ্গ আরোহণ পেম্বার শরীর আর দিচ্ছিল না। গত বছর দেখেছি, সাড়ে সাত হাজারের উপরে পেম্বার কিছু অসুবিধে হচ্ছিল। আগে যেমন ও আমায় সামলাত, গত দু’বছর আমি ওকে কিছুটা আগলে রাখার চেষ্টা করেছি।

তুষার-রাজ্য: এভারেস্ট ওঠার পথে খুম্বু হিমবাহ পেরোনো। ছবিটা তুলেছিল পেম্বা

তুষার-রাজ্য: এভারেস্ট ওঠার পথে খুম্বু হিমবাহ পেরোনো। ছবিটা তুলেছিল পেম্বা

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

আমার বন্ধু পেম্বার আদি গ্রাম ছিল মাকালু এলাকায়। তার পর থাকত দার্জিলিঙের ঘুম-এ। ওরা চার ভাই— পাসাং, মিংমা, পেম্বা আর তাশি। শেরপাদের নাম দেখলে একটা জিনিস লক্ষ করা যায়, একই নামে বহু শেরপা। সে জন্যই চেনাজানা শেরপাদের মধ্যেই রয়েছে বেশ কিছু পেম্বা আর পাসাং। কারণটা বেশ মজার। শেরপাদের জন্মবার অনুযায়ী প্রত্যেকের নামের সঙ্গে একটা করে শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। যেমন পেম্বা— ওর নাম ছুটি শেরপা, শনিবার জন্মেছে বলে নামের সঙ্গে ‘পেম্বা’ জুড়ে হয়েছে ‘পেম্বা ছুটি শেরপা’। সে ভাবেই শুক্রবার জন্মেছে বলে ওর দাদা ‘ফুতার’-এর পুরো নাম হয়েছে ‘পাসাং ফুতার শেরপা’। একই ভাবে যার জন্ম রোববারে, তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে যাবে ‘নিমা’, সোম হলে ‘দাওয়া’, মঙ্গল— ‘মিংমা’, বুধ— ‘লাকপা’, বৃহস্পতি— ‘ফুরবা’।

কে জানত, এত তাড়াতাড়ি পেম্বাকে নিয়ে ‘ছিল’, ‘থাকত’ এই সব অতীত কাল ব্যবহার করতে হবে! সেই পেম্বা, যে না থাকলে আমি, বসন্তদা (বসন্ত সিংহ রায়), মলয় (মুখোপাধ্যায়), রুদ্র (হালদার), রমেশ (রায়), সত্যরূপ (সিদ্ধান্ত) কেউই এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে পা রাখতে পারতাম না। বাঙালি পর্বতারোহীরা গত কয়েক বছর ধরে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা, মানাসলু, মাকালু… আট হাজার মিটারের উপর যে ক’টা পর্বতশৃঙ্গে পা রেখেছে, বেশির ভাগের পিছনেই পেম্বা। ওকে আমরা নিছক শেরপা ভাবতে পারিনি কোনও দিনই। অভিযানের প্ল্যানিং থেকে বেস ক্যাম্প, শিখরযাত্রার প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে থাকত। দিন কয়েক আগে ‘সাসের কাংরি ফোর’ শৃঙ্গে যাওয়ার সময় বসন্তদা ওকে আর শেরপা হিসাবে রাখেনি। দলের ক্লাইম্বিং মেম্বার করে নিয়েছিল। দলের সদস্য হিসেবে ওর প্রথম অভিযান! কে জানত, সেটাই হবে ওর শেষ! বাঙালি আজও শেরপাদের হাই-অল্টিটিউড নেপালি পোর্টার ছাড়া বিশেষ কিছু ভাবে না। কিন্তু পেম্বাকে আমরা বাঙালিই ভাবতাম। শেরপা-বাঙালি। পশ্চিম বাংলায় পর্বতারোহণের সাম্প্রতিক ইতিহাস লেখা হলে সেখানে পেম্বার নামটাও তাই স্বর্ণাক্ষরে থাকা উচিত।

পেম্বাদের বাবা-মা দুজনেই খুব ছোটবেলায় তাঁদের মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন। মাথার উপরে কেউ ছিল না। গ্রামের সবচেয়ে গরিব দম্পতি ছিলেন তাঁরা। সেখান থেকে নিজেদের চেষ্টা আর পরিশ্রমে অল্প অল্প করে অবস্থার উন্নতি ঘটান তাঁরা। কিছু জমিজমা হয়, গরু, চমরি গাই হয় বেশ কয়েকটা। ক্রমে গ্রামের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থাপন্ন পরিবার হয়ে ওঠেন তাঁরা। এর মধ্যেই বড় ছেলে পাসাং চলে আসে দার্জিলিঙে, কাজের খোঁজে। কপালজোরে যোগাযোগ হয়ে যায় তেনজিং নোরগে-র সঙ্গে। এতই ভাল ছিল সেই সম্পর্ক, তেনজিংয়ের বাড়িতেই সে থাকতে শুরু করে। তেনজিংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী পাসাংকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন। মেজ ছেলে মিংমাও এর পর দার্জিলিঙে এসে বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে ট্রেকে যেতে শুরু করে, মূলত কুক হিসেবে। পাসাং আর মিংমা ভাগ্যের সন্ধানে দার্জিলিং চলে আসায় পেম্বা বাধ্য হয় গ্রামে থেকে জমিজমা তদারকি, পশুপালনে বাবা-মা’কে সাহায্য করতে। গ্রামে স্কুল ছিল, কিন্তু রোজকার কাজের চাপে পড়াশোনা করা হয়নি। পেম্বা স্কুলে গেলে ঘরের কাজকর্ম দেখাশোনায় বিঘ্ন ঘটবে বলে মা-বাবাও পেম্বা ও তাশিকে আর স্কুলে পাঠাননি।

পরে ওরা দুই ভাইও কাজের খোঁজে দার্জিলিং চলে আসে। প্রথমে বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে পোর্টারের কাজ করেছে, পরে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে নিজেরাই গাইড, শেরপার কাজ শুরু করে। তার পর টাকা জমিয়ে চার ভাই মিলে জমি কেনে, বাড়ি বানায়। মিংমার দুই ছেলে, পাসাং-এর এক ছেলে, এক মেয়ে। পেম্বার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়েদের নাম দোলমা আর ফুলামু। অষ্টাদশী, শান্ত দোলমাকে এয়ারহোস্টেস বানানোর স্বপ্ন ছিল পেম্বার। ফুলামু একেবারে বিপরীত— প্রাণচঞ্চল, ছটফটে। ছেলে ফুরতেম্বা ছোট, বছর চোদ্দো বয়স, পেম্বার খুব নেওটা। কিন্তু পেম্বা বলত, ওর পড়াশোনায় মন নেই। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ঠিক করেছিল, ওর বাড়িটাকে হোম স্টে করে দেবে। আমরাও ভেবেছিলাম তারই সঙ্গে একটা ছোটখাটো মিউজিয়ম বানাব— আট বারের এভারেস্ট জয়ী পেম্বার ছবি, শংসাপত্র, পাহাড় চড়ার নানান যন্ত্রপাতি-সাজসরঞ্জাম দিয়ে তা সাজানো থাকবে। সেটা হয়ে উঠবে ঘুম-এর এক দর্শনীয় স্থান।

কত যে পাহাড়ের গল্প আছে পেম্বার! জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তো কেটেছে পাহাড়ে। পেম্বার প্রত্যক্ষ সাহায্য পায়নি, কলকাতায় এমন পাহাড়ি ক্লাব খুব কমই। হাওড়ার মলয় মুখোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়। ২০০৫ সালে পেম্বার সঙ্গে তাঁর পরিচয়, তার পর ২০০৭ সালে ভারতের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কামেট-এ পেম্বার সঙ্গে প্রথম অভিযান। তার মধ্যেই পেম্বা বার তিনেক এভারেস্ট আরোহণ করে ফেলেছে। সে বারেও এভারেস্ট আরোহণ করেই মে মাসের শেষের দিকে পা বাড়িয়েছে কামেটের দিকে। পেম্বার ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা ছিল। সে বার সমস্যা বাড়ায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার শেষে হাঁটছিল। বেস ক্যাম্প পৌঁছনোর চার দিনের হাঁটাপথেই গল্পে গল্পে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে গেল। মলয়ের তখন অল্প বয়স, দলের কনিষ্ঠ সদস্য। মায়া পড়ে গেল পেম্বার। ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছে নিজের তাঁবুতেই থাকার ব্যবস্থা করল মলয়ের। শিশুর মতো আগলে রাখত দিন-রাত।

অথচ এই পেম্বাই প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল সেই অভিযানেই। ক্যাম্প থ্রি-এর পর দড়িতে ‘জুমার’ লাগিয়ে ঠিকঠাক উঠতে পারছিল না মলয়। সেই দেখে পেম্বা তো রেগে ওকে নীচেই পাঠিয়ে দেয়। বলেছিল, ‘‘টেকনিক জানো না, পাহাড়ে এসেছ কেন? কওন ভেজা তুমকো?’’

শিখরে: বাঙালির প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযান, ২০১০। বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাসের সঙ্গে দুই ভাই পেম্বা ও পাসাং

সব দিকে খেয়াল থাকত ওর। মলয় খেতে খুব ভালবাসে, যা পায় চেটেপুটে খেয়ে নেয়। ২০১৩-র ধৌলাগিরি অভিযানে গিয়েছি আমি, মলয় আর বসন্তদা। আমাদের ডিনারের পর শেরপারা খেত। ওরা প্রায়ই ইয়াকের মাংস খেত। কিন্তু ইয়াক যেহেতু চমরি গাই, বসন্তদা খাবে না, আর বসন্তদার পাশে বসে আমাদের খাওয়াটাও অশোভন। পেম্বা বুঝত, খাওয়ার ইচ্ছে আমাদের ষোলো আনা। তাই ডিনার শেষে তাঁবুতে ফেরার পর চুপিচুপি ফের ডেকে নিয়ে যেত ডাইনিংয়ে, ইয়াকের মাংস খাওয়াতে।

বর্ধমানের রাজীব মণ্ডল, বিখ্যাত পর্বতারোহী। বহু অভিযানের সদস্য। এক বার গিয়েছে হিমাচল প্রদেশের কাংলা টার্বো ওয়ান ও টু অভিযানে। সঙ্গী পেম্বা শেরপা। ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছে দেখা গেল মাউন্টেনিয়ারিং বুটের সমস্যা। সদস্যের তুলনায় বুট কম পড়ে গেছে। রাজীব ঠিক করল, তার বুট অন্য এক সদস্যকে দিয়ে সে নেমে যাবে। ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত পাথুরে এলাকা, মাউন্টেনিয়ারিং বুট ছাড়াও নামতে পারবে। কিন্তু খোঁজ করেও রাজীবের পায়ের মাপের ট্রেকিং শু পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল শুধু এক জোড়া চপ্পল। সেটাই রাজীবের পায়ে পরিয়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে পিছনের স্ট্র্যাপ বানিয়ে দিল পেম্বা। তার আগে খুব ভাল করে মোজা পরিয়ে দিল। সে ভাবেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেমে এল রাজীব।

শীর্ষারোহণ করে বেস ক্যাম্পে ফিরেই রাজীবের কাছে ছুটে গেল পেম্বা। প্রথমেই পা টেনে কোলে তুলে নিল। ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, পায়ে কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না। রাজীব মানা করাতেও শুনল না। বলল, ‘‘তোমার পায়ে তো জখম আছে, সেটায় ফের চোট লাগেনি তো?’’ ঠিক আগের বছর নন্দাকোট অভিযানে গিয়ে রাজীবের পায়ে তুষারক্ষত হয়, কাটা পড়ে পায়ের আঙুল। সেটাই আরও ক্ষতিগ্রস্ত হল না তো, উদ্বেগ পেম্বার।

আর এক অভিযানে শেরপা হিসেবে ওরা তিন ভাই— পাসাং, পেম্বা আর তাশি— যাবে। ওদের সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্য পেম্বার বাড়ি গেছে রাজীব। নির্দিষ্ট সময়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন। স্টেশন পৌঁছে দেওয়ার গাড়িও চলে এসেছে, হঠাৎ পেম্বা বলল, আমি একটু আসছি। বলেই ঘরের হাফপ্যান্ট, হাফ শার্ট পরা অবস্থাতেই দৌড় লাগাল। আর আসে না। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, সবাই অধৈর্য, বিরক্ত। এর পর তো ট্রেন মিস হয়ে যাবে! অবশেষে ছুটতে ছুটতে এল। ওই অবস্থাতেই গাড়িতে বসে বলল, জলদি চলিয়ে, বহুত দের হো গয়া। প্রচণ্ড বকাবকি শুরু করল রাজীব, জরুরি কাজ থাকলে আগে সেরে রাখতে পারতে! তুমি তো জানো আজ বেরোতে হবে! পেম্বা শুধু মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, থোড়া দের হো গয়া।

পরে অভিযানের অবসরে কথাপ্রসঙ্গে রাজীব জানতে পারে, সে দিন পেম্বা হাসপাতালে গিয়েছিল ওর কোনও পরিচিতজনকে দেখতে। তার খাবার, ফল, চিকিৎসার জন্য কিছু টাকাপয়সা দিতে। সে ছাড়তে চাইছিল না পেম্বাকে। হাত ধরে বলেছিল, তুমি তো দু’মাস পাহাড়ে থাকবে, আর একটু বোসো। এত দিনের জন্য দুর্গম পাহাড়ে যাওয়ার আগে পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে পেম্বা গিয়েছিল অসুস্থ মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে। এমন হৃদয় ছিল ওর।

আর কী সরল যে ছিল! মুখের হাসিই মেলে ধরত ওর অমলিন মনের ছবি। ওকে সামান্যতম মিথ্যাও বলতে দেখিনি কখনও। এক বার আয়কর ভবনে এসেছে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা জমে উঠেছে আমাদের। পেম্বা অনেক ক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল। বসন্তদা ডেকেছে, ওকে যেতে হবে। আমরা আটকে দেওয়ায় নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। শেষে ওকে বাঁচানোর জন্য বললাম, বসন্তদাকে গিয়ে বলবে রাস্তায় জ্যামের জন্য দেরি হয়ে গেছে। পেম্বা কোনও জবাব দিল না, কিন্তু ওর মুখের হাসিটাই বুঝিয়ে দিল, এই সামান্য মিথ্যাটাও ওর পক্ষে বলা সম্ভব হবে না।

আদ্যোপান্ত পাহাড়প্রেমী পেম্বা। কত যে গল্প ছিল তার ঝুলিতে! কে-টু আরোহণে গিয়েছিল এক কোরিয়ান দলের সঙ্গে। কাঠমান্ডু থেকে প্লেনে ওসাকা হয়ে সাংহাই। সেখান থেকে ট্রেনে তিন দিন তিন রাত পরে এক জায়গায়। তার পর ল্যান্ডক্রুজ়ারে দু’দিন দু’রাত। ফের ছ’দিন ট্রেক করে তিব্বতের দিকের কে-টু বেস ক্যাম্প। অভিযান সফল হয়নি। ক্যাম্প-টু’তে হিমবাহের তুষারধস নামায় সদস্যরা তাঁবুতেই বরফের তলায় চাপা পড়ে। দু’জন কোরিয়ান মারা যান। ওরা ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

ফের এক বার কে-টু যায় পেম্বা। এ বার পাকিস্তান দিয়ে। দিল্লি থেকে প্লেনে লাহৌর, তার পর গাড়িতে ইসলামাবাদ। সেখান থেকে জিপ, তার পর ছ’দিন হেঁটে বেস ক্যাম্প। কিন্তু প্রচণ্ড হাওয়ার দাপটে ক্যাম্প থ্রি থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

পেম্বার কথা বলতে গেলে কোথা থেকে শুরু করব, কোথায়ই বা শেষ করব! পাতার পর পাতা লিখলেও মনে হয় শেষ হবে না। সে আমার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছে। পেম্বা না থাকলে আমি কি আদৌ পর্বতারোহণ করতে পারতাম? সে শিবলিঙ্গই হোক বা এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা।

কী অসম্ভব সরল আর ভদ্র একটা মানুষ! আমায় তো ও তিলে তিলে গড়েছে, কিন্তু যাদের সঙ্গে ও এক বারও কথা বলেছে, তারাও এই একই কথা বলবে। কত বার হয়েছে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই পেম্বার ফোন: ‘‘স্যর, পহুচ গয়া।’’ আমি তো অবার। কহাঁ পহুচ গয়া? ঘুমের ঘোর কাটতেই বুঝলাম, ও কলকাতায় এসেছে। বিধাননগর স্টেশনের পাশেই আমার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট রয়েছে। ফাঁকা। পেম্বা জানে, ওটা শেরপাদের জন্য রাখা। তাই কলকাতায় আসার দরকার পড়লে একটা ব্যাপারে ও চিন্তামুক্ত। থাকা-খাওয়ার ওর নিজের একটা জায়গা রয়েছেই। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে ঢুকে পড়লেই হল, আমাকে জানাবার তো দরকারই নেই। ওটা ওর নিজেরই বাড়ি।

কত অভিযান, কত সফল আরোহণ ওর তালিকায়। যে কোনও পর্বতারোহীর কাছেই ঈর্ষণীয় সেই তালিকা। এক আমার সঙ্গেই তো কত অভিযান! সবই মধুর স্মৃতি, অনেক ভেবেও তিক্ত কোনও স্মৃতি মনে করতে পারি না।

শিবলিং-এর সামিট ক্যাম্পের পর সেই বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) সেরাক। পেম্বা-পাসাং’এর চরম নৈপু্ণ্যেই তো বিপজ্জনক সেই সেরাকে রুট ওপ্‌ন করা গেল। সেই দড়িতে ঝুলতে ঝুলতেই আমার ছবি তোলা। আর তা থেকে শিবলিং মুভি। শিবলিং আরোহণ বাংলার পর্বতারোহণকে এক ধাক্কায় বহু ধাপ এগিয়ে দেয়। পেম্বা-পাসাংই তো সেই সাফল্যের দুই কারিগর।

পানওয়ালিদুয়ার অভিযানের সময়ও পেম্বা-পাসাং দুই ভাইয়ের জুটি। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ায় শীর্ষারোহণ হয়। কখন যে শীর্ষে পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারিনি। খুব মেঘলা হওয়ায় আর প্রচণ্ড তুষারপাতের জন্য দশ-বারো ফুট দূরের কিছুও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। পেম্বাই এক সময় আবিষ্কার করল, আমরা ক্রমশই নীচের দিকে নেমে চলেছি। চিৎকার করে বলল, ‘‘দেবাশিসদা, সামিট ক্রস করকে হমলোগ নীচে কা তরফ যা রহা হু।’’

আর এভারেস্ট? ২০১০ সালের এভারেস্ট অভিযান তো বাংলার পর্বতারোহণের নবজাগরণ। আর পেম্বা সেই যজ্ঞের ভগীরথ। প্রায় দু’মাসের সেই কর্মকাণ্ডে দেখেছি পেম্বার দায়িত্ববোধ, আমাদের সাফল্যের জন্য তার আগ্রহ, পরিকল্পনা। তত দিনে পর্বতারোহণের দক্ষতায় বড় ভাই পাসাংকে ছাপিয়ে গেছে পেম্বা।

এভারেস্ট অভিযানের অসংখ্য ঝলমলে স্মৃতি আছে আমার। কিন্তু দায়িত্ববোধের কথা ভাবলে একটা ছোট্ট ঘটনা নাড়া দিয়ে যায়। সামিটের উদ্দেশ্যে উঠে গেছি ক্যাম্প থ্রি-তে। আমাদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে পেম্বা নেমে গেছে ক্যাম্প টু-তে। ক্যাম্প থ্রি-তে একটাই তাঁবু। তাতে চার জন থাকার অসুবিধে হবে বলে বসন্তদা, পাসাংজি আর আমাকে থাকতে দিয়ে ও নেমে গিয়েছিল ক্যাম্প টু-তে। পর দিন সকাল থেকেই বেশ মেঘলা, সঙ্গে তুষারপাত। আমাদের তিন জনেরও আলসে মেজাজ, বেরোনোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। অথচ পেম্বা আগের দিন বলে দিয়েছে সকাল সকাল বেরোতে। ও ক্যাম্প টু থেকে রওনা দিয়ে রাস্তাতেই আমাদের ধরে ফেলবে।

আমরা না বেরোলেও পেম্বা যথাসময়ে পৌঁছে গিয়েছিল ক্যাম্প থ্রি-তে। আমাদের তখনও তাঁবু থেকে বেরোতে না দেখে শুরু করল প্রচণ্ড বকুনি। যেন মনে হল আরোহণের গরজটা শুধুই ওর একার।
অথচ তার মধ্যেই ওর পাঁচ বার এভারেস্টে ওঠা হয়ে গিয়েছে। আমাদের সাফল্যের জন্য এতটাই যত্নবান ছিল পেম্বা।

ধৌলাগিরি অভিযান থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলাম শুধু পেম্বার দৌলতে। শেষের পথটা চলছিলাম মাত্র আমরা ক’জন। আমাদের দলে আমি, বসন্তদা, পেম্বা আর এক বাচ্চা শেরপা— পাসাং। আর ছিল স্পেনের লোলো ও গারা ও তাদের শেরপা কেশব, আর জাপানি মহিলা কোনো, সঙ্গী দুই শেরপা— দুজনের নামই দাওয়া। শীর্ষের কাছাকাছি রয়েছে এক পাথুরে খাঁজ, পর্বতারোহণের ভাষায় ‘কুঁলোয়ার’। তার নীচের বরফের ঢাল বরাবর উঠছি। পথে দড়ি লাগানো নেই, তাই নিজেদের কোমরে দড়ি বেঁধে (যাকে বলে ‘রোপ আপ’) চলছি। হাওয়ার দাপটে বরফকুচি উড়ছে, তাই চলার গতি বেশ ধীর। ঘড়িতে বেলা আড়াইটে, তবুও আমরা সেই কুঁলোয়ারের নীচে। সে সময়ই কেশব গড়িয়ে পড়ল, তার কোমরে বাঁধা দড়ির টানে গারা-ও গড়িয়ে গেল। জাপানি আরোহী কোনো ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে ওখানেই মারা যান। দুর্ঘটনা দেখে আমরা চার জন সেখান থেকেই নামতে শুরু করলাম।

আগের রাত থেকে একটানা চলেছি। প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে হাওয়া আর বরফের ঝাপটা। সেই সঙ্গে আলোর তীব্রতায় দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। নামার পথে এক সময় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলাম। পেম্বা বুঝে গেল আমার অবস্থা। চার জন যে দড়ি বেঁধে চলছিলাম, তা দু’টুকরো করে নিল ও। ঠিক হল, এক টুকরোতে আমি আর পেম্বা, অন্যটায় বসন্তদা আর পাসাং নামবে। পেম্বা নিজে থেকেই আমার দায়িত্ব নিয়ে নিল, যখন দেখল আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

এর পর পর্বতারোহীর দক্ষতায় আমাকে নিয়ে নেমে এল নীচের ক্যাম্পে। অন্ধ হয়ে যাওয়ায়
আমি বুঝতেও পারিনি, বসন্তদা পথেই বসে পড়েছে। তাঁবুতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম, দৃষ্টিশক্তিও সম্পূর্ণ ফিরে এল। এর মধ্যেই পেম্বা ওয়াকিটকিতে কথা বলে নীচের ক্যাম্পে থাকা দাওয়াকে অক্সিজেন, জল, দড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে— বসন্তদাকে নামিয়ে আনার জন্য।

এর পর সাক্ষী হলাম শেরপাদের অপরিসীম দায়িত্ববোধের এক চরম দৃষ্টান্তের। পেম্বা আর দাওয়া প্রায় মৃত্যুর দরজা থেকে বাঁচিয়ে নামিয়ে আনে বসন্তদাকে। তার পর হেলিকপ্টারে করে নামাতে হয়েছিল ওঁকে। দু’দিন কোনও খোঁজ না থাকায় খবর হয়েছিল— ধৌলাগিরিতে বসন্ত সিংহরায় নিখোঁজ, হয়তো বা মৃত। ‘মৃত’ মানুষকে জীবিত করার অসম্ভবকে সে দিন সম্ভব করেছিল পেম্বা-দাওয়া।

২০১৭ সালের লোৎসে অভিযানেও দেখেছি পেম্বার বিশাল মনটাকে। আমার রক্তচাপ তো প্রায় ২৬০/১৫০ হয়ে গিয়েছিল। বেস ক্যাম্প থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে কাঠমান্ডুতে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। তার পর যখন ফের আরোহণের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম, পেম্বা আমাকে সারা ক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিল। সে বার ও আমার শেরপা ছিল না, কিন্তু সামিটে যাওয়ার সময় আমার খেয়াল রাখতে ও আমার সঙ্গে ক্যাম্প থ্রি পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। বারবার ওকে কথা দিতে হয়েছিল, শরীর খারাপ লাগলে তক্ষুনি নীচে নেমে যাব। তবেই ও আশ্বস্ত হয়ে নেমে গিয়েছিল নিজের মেম্বার কার্লোসের কাছে।

শিশুর মতো সরল ছিল পেম্বা। এক বার পর্বতারোহী মহলে খুব হইচই হয়েছিল পেম্বার দুটো ছবির জন্য। ফেসবুকে ওর একটা প্রোফাইল আছে। সেখানে ওর দুটো ছবি পোস্ট হয়। দেখা যায়, কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে দাঁড়ানো ছবিটাকে তুলে অন্নপূর্ণার মাথায় বসানো হয়েছে। ছবি দেখে কারও বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে কোনও একটা ছবিকে কপি করে অন্য ছবির উপরে পেস্ট করা হয়েছে। সেই নিয়ে খবর কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়াতে তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডা। দুটো অভিযানেই আমি ছিলাম পেম্বার সঙ্গী। ছবি দুটো দেখেই বুঝে গেলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা আসল। ওটা তো আমারই তোলা! সেই ছবিটাই কেটে বসানো হয়েছে অন্নপূর্ণার ছবিতে। সেই বিতর্কিত সময়ে পেম্বা গিয়েছে কোনও এক অভিযানে। কলকাতায় ফেরামাত্রই দিলাম ওকে প্রচণ্ড ধমক, কেন করেছ এটা? ও তো প্রায় কেঁদেই ফেলল। বলল, আমি তো দু-এক লাইন লেখা ছাড়া কম্পিউটারের কিছুই জানি না। ফেসবুকের সব কিছু ছেলেমেয়েরাই করে। ওদের বলেছিলাম, অন্নপূর্ণার মাথায় ফ্ল্যাগ নিয়ে আমার কোনও ছবি নেই। তাই ওরা ওটা বানিয়েছে। এ রকম একটা সরল চাহিদা যে এত বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে, পেম্বা কল্পনাই করতে পারেনি। ওর চোখে জল দেখেছিলাম সে দিন। খুব কষ্ট হয়েছিল বকুনি দিয়েছি বলে।

আট হাজারি শৃঙ্গ আরোহণ পেম্বার শরীর আর দিচ্ছিল না। গত বছর দেখেছি, সাড়ে সাত হাজারের উপরে পেম্বার কিছু অসুবিধে হচ্ছিল। আগে যেমন ও আমায় সামলাত, গত দু’বছর আমি ওকে কিছুটা আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। পেম্বাও হয়তো আমাকে খুব ভরসা করত। সে জন্যেই হয়তো কিছু দিন আগে যখন এক জন ওকে জিজ্ঞেস করল, পেম্বাজি, ঔর কিতনা দিন আপ ক্লাইম্ব করোগে? উত্তরে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘‘দেবাশিসদা জব তক বোলেঙ্গে।’’ কিন্তু আমায় থামতে বলার সুযোগ দিল না পেম্বা। নিজে নিজেই থেমে গেল। কিছু বলারই সুযোগ দিল না!

পর্বতারোহণ এমন একটি ‘খেলা’, যেখানে কোনও প্রতিপক্ষ নেই, নেই কোচ, রেফারি, দর্শক। সেখানে আমিই এগুলো সব, এমনকি প্রতিপক্ষও। প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ভুল হলে শুধরে দেওয়ার কেউ নেই, নেই কোনও দ্বিতীয় সুযোগ। সফল হলেও নেই দর্শকের হাততালি, বাহবা, উল্লাস। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও এখানে আবেগকে সংযত রাখতে হয়। ঠান্ডা মাথায় নেমে আসতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ে। শীর্ষে পৌঁছে খেয়াল রাখতে হয়, কত লক্ষ বার পা ফেলে তবেই পৌঁছেছি এই বিন্দুতে, তত বার ফের সঠিক পদক্ষেপ করতে পারলেই ফিরতে পারব সুরক্ষার বলয়ে। মাত্র এক বার তার অন্যথা হলেই আছড়ে পড়তে পারি হাজার হাজার ফুট নীচে, কিংবা তলিয়ে যেতে পারি কোনও অতলান্ত ক্রিভাসে। আর তা হতে পারে কখনও নিজের কোনও ভুলে, কখনও বা কোনও কারণ ছাড়াই।

সে রকমই, কোনও কারণ ছাড়াই, আমার বন্ধু পেম্বা শ্বেতশুভ্র বরফের দেশে এক ফাটলের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছে। শীর্ষ জয় করে ফেরার পথে সেই ১৩ জুলাইয়ের শেষ মুহূর্তেও অন্যদের জন্য সুরক্ষিত রাস্তা খুঁজছিল ও। কে জানে, ক্রিভাসে পড়েও সে দিন হয়তো অনেক ক্ষণ বেঁচে ছিল পেম্বা! হয়তো আশায় ছিল, কেউ আসবে তাকে উদ্ধার করতে। কিন্তু পেম্বা তো এক জনই হয়। তাই দেবাশিস, বসন্তরাই বেঁচে ফিরে আসে। কোনও পেম্বা হাত বাড়ায় না— আমার বন্ধু পেম্বাকে টেনে তোলার জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pemba Sherpa Mountaineer Debasish Biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE