Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রহস্যময় রাসপুটিন

কে তিনি? অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সন্ত, নাকি নারীলোলুপ ভণ্ড? রিভলভারের গুলি বা বিষক্রিয়াতেও কি অক্ষত রয়ে যান তিনি? তবু তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রাশিয়ার শেষ জ়ার এবং জ়ারিনার কাহিনি। ১৯০৪-এর অগস্টে জন্ম নিল আলেক্সেই। খুশি-ঝলমল রাজপরিবার। কিন্তু তা বেশি দিন টিকল না। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বোঝা গেল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

প্রভাবশালী: গ্রিগরি রাসপুটিন। ছবি: গেটি ইমেজেস

প্রভাবশালী: গ্রিগরি রাসপুটিন। ছবি: গেটি ইমেজেস

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

রাশিয়ার রোমানভ সাম্রাজ্যের কাছে ১৯০৪ সালটা বড় সুখের সময়। অবশেষে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী জন্ম নিল যে! আলেক্সেই নিকোলেভিচ। এর আগে পর্যন্ত রোমানভ-সম্রাট জ়ার দ্বিতীয় নিকোলাস আর জ়ারিনা (জ়ার-পত্নী) আলেকজ়ান্দ্রা ফিয়োডোরোভনার ঘরে একে একে জন্ম নিয়েছে চারটি কন্যাসন্তান। কিন্তু পুত্রসন্তান কই? কে নেবে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব? শোনা যায়, ছেলের আশায় আলেকজ়ান্দ্রা নাকি তুকতাকেরও শরণ নিয়েছিলেন।

১৯০৪-এর অগস্টে জন্ম নিল আলেক্সেই। খুশি-ঝলমল রাজপরিবার। কিন্তু তা বেশি দিন টিকল না। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বোঝা গেল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। ছোট্ট একটা আদরের টোকাতেও যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে শিশু। কালশিটে ফুটে ওঠে নরম ত্বকে। জানা গেল, আলেক্সেই হিমোফিলিয়ার শিকার। এ রোগে রক্তপাত বন্ধ হতে চায় না কিছুতেই। অল্প কেটে যাওয়া, সামান্য আঘাতও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

এমন খবরে ভেঙে পড়েন আলেকজ়ান্দ্রা। রোগের উপসর্গ তাঁর বড় চেনা, পরিণামও জানা। ইতিমধ্যেই পরিবারের কয়েক জনকে তিনি হারিয়েছেন এই রোগে। এমন রোগে আক্রান্তরা হয় বেশি দিন বাঁচে না, নয়তো আর পাঁচটা শিশু-কিশোরের মতো স্বাভাবিক হয় না সেই বেঁচে থাকা। আলেক্সেই-এরও কি সেই পরিণতি হবে?

এই কান্নাকাটির দিনগুলোতেই রাজপ্রাসাদে পা রাখেন গ্রিগরি রাসপুটিন। সাইবেরিয়ার চাষির ঘরের ছেলে। লেখাপড়াও তেমন শেখেননি। স্থানীয় কাগজপত্র থেকে জানা যায়, কিশোরবেলা থেকেই বেপরোয়া ছিলেন তিনি। মদ্যপান, ছোটখাটো চুরির সঙ্গেও নাম জড়িয়েছিল। এহেন প্রায় নিরক্ষর, বিশৃঙ্খল যুবকটি ১৮৯০-এর দশকে হঠাৎই ধর্ম নিয়ে মেতে ওঠেন। বিভিন্ন মঠে ঘোরাঘুরি করতে করতে এক সময় সংসার ছাড়েন। নানান দেশ ঘুরে ১৯০৩ সাল নাগাদ এসে পৌঁছন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। তত দিনে নিজেকে ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ ঘোষণা করেছেন। ভবিষ্যদ্বক্তা, মরণাপন্নকে সারিয়ে তোলার ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী-গোছের পরিচিতিও হয়েছে ভালই। বিশেষ করে, রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণির একাংশ তাঁকে নিয়ে রীতিমত আগ্রহী। তাঁরাই রাসপুটিনকে নিয়ে যান নিকোলাস এবং আলেকজ়ান্দ্রার কাছে। ছেলেকে সুস্থ করে তোলার জন্য আলেকজ়ান্দ্রাও তখন অন্য কোনও শক্তির খোঁজে উন্মুখ। এই সময়ই প্রাসাদে রাসপুটিনের প্রবেশ, এবং মির‌্যাক‌্ল।

সত্যিই কি রাসপুটিন জ়ারেভিচকে (রাশিয়ার সম্রাট বা জ়ারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী) সুস্থ করে তুলেছিলেন? তাঁর গোটা জীবনটাই গুজবে মোড়া থাকলেও এই একটি ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত, সত্যিই সেরে উঠেছিল আলেক্সেই, এবং তা রাসপুটিনের প্রাসাদে আসার পর থেকেই। তাঁর সম্মোহনী বিদ্যের কারণে, তাঁর লাগাতার প্রার্থনা আর প্রাসাদজোড়া একটা শান্ত-পবিত্র পরিবেশ তৈরির জন্য, নাকি সাইবেরীয় চাষি পরিবার থেকে শিখে আসা জড়িবুটির কল্যাণে— তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে, চিকিৎসকেরা যে আয়ু বেঁধে দিয়েছিলেন, তার চেয়ে কিছু বেশি বছর বেঁচেছিল জ়ারেভিচ, যার পুরো কৃতিত্বই রাসপুটিনের হাতে তুলে দেন অভিভূত নিকোলাস এবং আলেকজ়ান্দ্রা। ইতিমধ্যেই তাঁরা এই সন্তসম মানুষটির কথাবার্তায় গভীর ভাবে প্রভাবিত। তার ওপর একমাত্র ছেলেকে সারিয়ে তোলা— রাসপুটিনকে তাঁদের অদেয় কিছু ছিল না। এই ভরসাকে কাজে লাগিয়েই রাসপুটিন নাকি ঘোষণা করেন, শিশু-সহ সমস্ত সাম্রাজ্যের ভাগ্য এখন থেকে তাঁর সঙ্গে বাঁধা পড়ল।

বিশ্বাস জিতে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। জ্বলজ্বলে দুই চোখে, ব্যক্তিত্বে এমন কিছু মিশে ছিল, যা তাঁকে অন্য সমস্ত সাধু-সন্তদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। এই আশ্চর্য ক্ষমতাতেই মজেছিলেন আলেকজ়ান্দ্রা। রাসপুটিন তাঁর সম্মোহনী কথাবার্তা দিয়ে প্রথম আলাপেই এক অদ্ভুত ভরসা আর শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছিলেন আলেকজ়ান্দ্রার মনে। সেই বিশ্বাস, ভরসা কখনও চিড় খায়নি। প্রাসাদের ভিতরে রাসপুটিনের জীবনযাত্রায় তাঁকে আদ্যন্ত রাশিয়ার কৃষকসমাজের প্রতিনিধি মনে হলেও, প্রাসাদের বাইরে পানাসক্তি, মারামারি, ভাঙচুর, নারীসঙ্গ এবং মহিলাদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার ঘটনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কিন্তু বহু অভিযোগ জমা পড়লেও জ়ার রাসপুটিনের ব্যাপারে অবিচল থাকেন— সম্ভবত আলেকজ়ান্দ্রা ক্ষুব্ধ হবেন ভেবেই।

রাসপুটিনের কেচ্ছার রঙিন খবর তখন উড়ছে লোকের মুখে মুখে। শোনা যায়, ১৯১০-১১ সালে রাজপরিবারের মেয়েদের গভর্নেস আলেকজ়ান্দ্রার কাছে গিয়েছিলেন মেয়েদের শোওয়ার ঘরে রাসপুটিনের ঢোকা বন্ধ করার আদেশ চেয়ে। কারণ, তত দিনে রাসপুটিন প্রাসাদের এক নার্সকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। রাজপ্রাসাদে মেয়েদের ঘরে রাসপুটিনের অবাধ প্রবেশাধিকার। তাই আলেকজ়ান্দ্রাকে নাকি সতর্ক করতে গিয়েছিলেন গভর্নেস। সম্রাজ্ঞী কানও দেননি। উলটে বরখাস্ত হন সেই গভর্নেস এবং নার্স। আরও শোনা যায়, কে বা কারা এক বার মহিলাদের সঙ্গে রাসপুটিনের কিছু ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি তুলে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করে— হয় সেন্ট পিটার্সবার্গ ছাড়ো, নয়তো জ়ারের হাতে ছবিগুলো যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু রাসপুটিন তাতে বিন্দুমাত্র চমকালেন না। বরং নিজেই সেই ছবি তুলে দেন জ়ারের হাতে। এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। ক্ষমাই করেছিলেন নিকোলাস। তিনি এমনকী বন্ধুদের হিতোপদেশ, পুলিশি রিপোর্ট-সহ যাবতীয় প্রমাণ অগ্রাহ্য করেন আলেকজ়ান্দ্রার

কথা ভেবেই। স্বাভাবিক ভাবেই প্রাসাদের বাইরে গুঞ্জন ওঠে, আলেকজ়ান্দ্রার সঙ্গে তাঁর ‘হোলি ম্যান’ রাসপুটিনের সম্পর্ক কি নিছকই আধ্যাত্মিক আদানপ্রদান, না তার চেয়েও বেশি কিছু?

রাসপুটিনকে ঘিরে এমন গুজগুজ, ফিসফাস হয়তো আরও কিছু বছর চলত, কিন্তু বাদ সাধল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আর তার সঙ্গেই যেন গ্রহণ লাগল জ়ার-শাসিত রাশিয়ার রাজনীতিতে। ইতিমধ্যেই জ়ারের অসীম ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য টাল খেয়েছে। তাতে শেষ পেরেক পুঁতল এই যুদ্ধ। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিজের হাতে নিলেন স্বয়ং জ়ার। প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কেউ বলেন, এই প্রস্তাব রাসপুটিনের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। আবার কেউ বলেন, উঁহু, রাসপুটিন সাবধানই করেছিলেন জ়ারকে। বলেছিলেন, এই লড়াইয়ে জড়ালে রাশিয়ার সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। প্রস্তাব যারই হোক, নিকোলাস প্রাসাদ ছাড়ার পরই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর দায়িত্ব হাতে তুলে নেন আলেকজ়ান্দ্রা আর তাঁর পরামর্শদাতা, রাসপুটিন। দ্বিতীয় জনেরই অঙ্গুলিহেলনে যোগ্য মন্ত্রীরা পদচ্যুত হন, ক্ষমতায় আসেন কিছু অপদার্থ মানুষ।

রাশিয়ার অর্থনীতির তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা। এক দিকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, অন্য দিকে বড় বড় শহরগুলোতেও মানুষের হাতে রুটি নেই, প্রচণ্ড ঠান্ডায় গায়ে দেওয়ার কম্বল নেই, আগুন জ্বালানোরও কিছু নেই। রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তখন তুঙ্গে। একে তো যুদ্ধে রাশিয়ার শত্রুপক্ষ জার্মানি দেশটার সঙ্গে জন্মসূত্রে যোগ রয়েছে আলেকজ়ান্দ্রার, তার ওপর এই মারণযজ্ঞে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল নাকি সবচেয়ে বেশি। ফলে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে অভিজাতদের একাংশও বেজায় চটলেন। তবে, রাগের তিরটা ছিল রাসপুটিনের দিকে। রাজপরিবারের ওপর তাঁর বিরাট প্রভাব কখনও সমর্থন করেননি অভিজাতরা। এখন জ়ারের অনুপস্থিতির সুযোগে তাঁর ভুল পরামর্শ আগুনে ঘি ঢালল। শুরু হল ষড়যন্ত্র।

কিন্তু রাসপুটিন না কি মৃত্যুঞ্জয়ী? এর আগেও তো এক পতিতা তাঁকে ভয়ঙ্কর ভাবে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিল। তাতেও সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সে বার, ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরের ওই রাতেও ঠিক কী হয়েছিল, পুরো স্পষ্ট নয়। বলা হয়, ষড়যন্ত্রী অভিজাতরা তাঁকে ওই দিন নিয়ে যান এক প্রাসাদে। সেখানে তাঁকে বিষ-মেশানো খাবার আর মদ পরিবেশন করা হয়। কিন্তু খাওয়ার বহু ক্ষণ পরও দেখা যায়, দিব্যি আছেন রাসপুটিন। শরীরে বিষক্রিয়ার চিহ্নমাত্র নেই। তখন সরাসরি তাঁকে গুলি করা হয়। কিন্তু তার পরও নাকি তিনি বেঁচে ছিলেন। এমনকী, ওই অবস্থাতেও পালানোর চেষ্টা করেন। ফের গুলি, সঙ্গে বেদম মার। আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে দেহটি কম্বলে মুড়ে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে।

দু’দিন পর রাসপুটিনের দেহ উদ্ধার হয় নদীর ধারে। যে অবস্থায় নাকি দেহটি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে মনে হয়, জলে পড়ার পরও বহু ক্ষণ বেঁচেছিলেন ‘ম্যাড মঙ্ক’। এমনকী হাতের বাঁধনও খানিকটা খুলতে পেরেছিলেন। অটপ্সি রিপোর্টও যেন খানিকটা এই গাঁজাখুরিকেই বৈধতা দেয়। জানায়, রাসপুটিনের মৃত্যু হয়েছে বরফঠান্ডা জলে ডুবেই, যদিও শরীরে গুলির ক্ষতও ছিল।

তবে, সারা জীবন হরেক লোককাহিনি, রং-চড়ানো গপ্পো আর অতিনাটকীয়তাকে সঙ্গী করে চলা ‘সাধু’ রাসপুটিনের একটি ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। সেই যে তিনি বলেছিলেন, আলেক্সেই-সহ সমস্ত সাম্রাজ্যের ভাগ্য তাঁর সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ল! সত্যিই রাসপুটিনের মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে জ়ারের সাম্রাজ্য। আর বছর দেড়েকের মধ্যেই বলশেভিকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন জ়ার দ্বিতীয় নিকোলাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE