Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস ,পর্ব ২

শেষ নাহি

রাতের খাবার বলতে ছিল বিহানের রান্না করা রুটি আর ডিমের ঝোল। খাবার খেয়ে বাসন মেজে শুতে রাত দেড়টা বেজেছিল। সেই ‘রাম-ঘুম’ এখন ভাঙল। অফিস যেতে দেরি না হয়ে যায়। এক লাফে বিছানা থেকে উঠল বিহান। রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভে কেটলি বসিয়ে দু’কাপ চা চড়াল। নিজের বিছানা সাফ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ছবি: শুভম দে সরকার।

ছবি: শুভম দে সরকার।

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৮ ০৭:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: দরিয়া একজন সাধারণ মেয়ে। যে আজকের দিনে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এসব থেকে অনেক দূরে। কারণটা আর্থিক। তার বাবা সাম্যব্রত প্রাক্তন নকশাল। অবসর নিয়েছেন সরকারি চাকরি থেকে। মা সীমা অসুস্থ। অন্য দিকে বর্তমান রাজনীতিতে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছে বিরোধী দলগুলি।

সকালে যখন বুধন দুধ দিতে আসে তখন সীমা কথা বলেন হিন্দিতে। বুধন বলে বাংলায়! সীমা বলেন, ‘‘বুধন, তুমি বালতি সে পানি ফেক দো।’’ বুধন বলে, ‘‘বালটিতে জোল নেই মা।’’ সীমা বলেন, ‘‘হামি দেখতে পাচ্ছি যে পানি হ্যায়।’’ বুধন বলে, ‘‘উটা জোল নোয় মা। আপনার চোখ খরাব আছে।’’

বাংলাভাষীর হিন্দি আর হিন্দিভাষীর বাংলা শুনে সাম্যব্রত আর দরিয়া ঘরের মধ্যে হেসে কুটিপাটি!

সাম্যব্রত অতীতে দিনে তিন বান্ডিল বিড়ি খেতেন। শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পরে বিড়ির বদলে ঠোঁটে উঠেছে সস্তার সিগারেট। ফতুয়ার বুক পকেটে ইনহেলার আর সিগারেটের প্যাকেট একসঙ্গে থাকে। যেমন কাঁধের ঝোলার মধ্যে আজও থাকে রেডবুক। অনেক বকুনি দিয়ে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করেও সিগারেট খাওয়ার বদভ্যাস বন্ধ করতে পারেনি দরিয়া।

কর্তা-গিন্নির ওষুধের পিছনে পেনশনের টাকার অনেকটা বেরিয়ে যায়। দরিয়া বিয়ের পরেও বাপের বাড়িতে থাকে। সব মিলিয়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা সুবিধের নয়। ‘বসবাস’ আছে বলে মাথার উপরের ছাদ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু এই পরিবারের অবস্থা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ ধাঁচের। নেহাত দরিয়া বাড়িতে টিউশন করে, তাই মাসের শেষ দিকটায় বাজারে ধারবাকি রাখতে হয় না। তবে সেই রকম পরিস্থিতিও কয়েক বার হয়েছে।

আঠাশে ডিসেম্বর সকাল সাতটার সময় দরিয়ার যখন ঘুম ভাঙল, তখনও সে জানে না, আজকের দিনটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনে, এবং একই সঙ্গে বাংলার ইতিহাসে। ঘুম ভাঙার পরে দরিয়া বুঝল তলপেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। চমকে উঠে সে ভাবল এটা কি লেবার পেন? না কি গতকাল বুধনকাকার ফুচকা খেয়েছিল বলে পেট কামড়াচ্ছে?

সকাল ন’টার সময়ে দ্বিতীয় বারের জন্য ঘুম ভাঙল বিহান চট্টোপাধ্যায়ের। প্রথম বার ভেঙেছিল ভোর ছ’টার সময়ে। কোনও রকমে লেপ গায়ে জড়িয়ে, বিছানা ছেড়ে উঠে, বাথরুমে হিসি করে সেই যে বিছানা নিয়েছে, আর ওঠেনি। বাপ রে বাপ! কী ঠান্ডা! মোবাইলের অ্যাপ দেখাচ্ছে বকুলতলার তাপমাত্রা এখন আট ডিগ্রি। সঙ্গে গাঢ় কুয়াশা। ভিজ়িবিলিটি নিল।

সমুদ্র বন্দরের নিকটবর্তী বকুলতলার অবস্থান কলকাতা থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে। তাতেই কী ভয়ঙ্কর ঠান্ডা রে ভাই! হাড়ের মধ্যে শীতের সুচ ঢুকে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে খটাখট শব্দ হচ্ছে। মুখ দিয়ে গলগল করে বাষ্প বার হচ্ছে। যে কেউ দেখলে ভাববে বিহান ধূমপান করছে।

কাল রাতে বিহান ধূমপান না করলেও ঠান্ডার থেকে বাঁচতে কারণবারি পান করেছিল সনতের সঙ্গে। দু’জনে মিলে রামের একটা ছোট বোতল শেষ করেছে। সঙ্গে ছিল ‘অভিরুচি’ থেকে আনা চিকেন পকোড়া। ‘অভিরুচি’ বকুলতলার সব চেয়ে নামী রেস্তরাঁ। খাবারের মান খুবই খারাপ। বেশি তেল-মশলা দিলেই যে ভাল রান্না হয় না, সেটা এদের কে বোঝাবে! কিন্তু বিহান উপায়হীন। রোমে থাকলে রোমানদের মতো আচরণ করতে হয়।

রাতের খাবার বলতে ছিল বিহানের রান্না করা রুটি আর ডিমের ঝোল। খাবার খেয়ে বাসন মেজে শুতে রাত দেড়টা বেজেছিল। সেই ‘রাম-ঘুম’ এখন ভাঙল। অফিস যেতে দেরি না হয়ে যায়। এক লাফে বিছানা থেকে উঠল বিহান। রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভে কেটলি বসিয়ে দু’কাপ চা চড়াল। নিজের বিছানা সাফ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বকুলতলার চার মাথার মোড় থেকে এক কিলোমিটারের ভিতরে এই বাড়ির ভাড়া মাসে পাঁচ হাজার টাকা। দোতলা বাড়ির উপরের তলায় কর্তা-গিন্নি আর তাঁদের দশ বছরের ছেলে থাকে। ওঁরা দূর থেকে চাকরি করতে আসা পোর্টের কর্মচারী ছাড়া অন্য কাউকে ভাড়া দেন না। ব্যাচেলর ভাড়াটে মোটেই পছন্দ করেন না। সনৎ রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটিয়ে এই মেসটা ম্যানেজ করেছে। মেসে পা রাখার আগে বিহানকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখাতে হয়েছে।

বিহান বকুলতলা পোর্টের ডিইও বা ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। অতীতে যাদের বলা হত ক্লার্ক বা কেরানি, তাদেরই কর্পোরেট জগতে নতুন পরিচয়, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। সামান্য বেতনের চুক্তিভিত্তিক চাকরিকে পুষিয়ে দেওয়ার জন্য গালভরা উপাধি! এখন সব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বসে গিয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকজন বয়স্ক কর্মচারী কম্পিউটার চালাতে পারেন না বা পারলেও করতে চান না। সেই কাজ করে দেওয়ার জন্য রাজ্যের সব জেলায় কম্পিউটার-সাক্ষর ছেলেমেয়েদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে।

শিবপুরের দীনবন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে বি কম পাস করার পরে দীর্ঘ তিন বছর ধরে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে বিহান। পায়নি। বেসরকারি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এটিএম আর শপিং মলের সিকিয়োরিটি গার্ড ছাড়া কোনও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য রাজ্যে গেলে কাজ আছে, মাইনেও ভাল। কিন্তু ঠাঁইনাড়া হওয়ার ইচ্ছে বিহানের নেই। বৌ আর মাকে ছেড়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিহান রবিঠাকুরের কবিতার সেই প্রবাদপ্রতিম সন্তানের মতো, যাকে মায়েরা বাঙালি করে রেখেছে।

ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজটা বিহানকে জুটিয়ে দিয়েছে সনৎ কুইলা। সনৎ তার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড এবং কলেজের ক্লাসমেট। সনৎ কলেজ থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। খরাজ পার্টি তখন সদ্য বাংলার রাজনীতিতে পা রেখেছে। সেই দলের ছাত্র সংগঠনের হয়ে কলেজ ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারির পোস্টে দাঁড়িয়েছিল সনৎ। ক্ষমতায় থাকা কিশলয় পার্টির ছাত্র সংগঠনের হাতে প্রবল মার খেয়েও ভোটের ময়দান ছেড়ে পালায়নি। তার এই একরোখা ব্যক্তিত্বের জন্য ছাত্রছাত্রীরা ঢেলে ভোট দিয়েছিল। নির্বাচনে জিতেছিল সনৎ। রাজনৈতিক উত্থানের সেই শুরু। সনতের গুরু ছিলেন সুধাকর ঘোষ। সনৎ বুঝেছিল, কিশলয়ে নাম লিখিয়ে লাভ নেই। ওখানে কেউ তাকে পাত্তা দেবে না। খরাজ বাংলায় নতুন, নিজেদের জায়গা পোক্ত করার জন্য প্রচুর টাকা ওড়াচ্ছে এই রাজ্যে। তাই সনৎ বড় মেশিনের ছোট বল্টু হওয়ার চেয়ে ছোট মেশিনের বড় লিভার হতে চেয়েছে। প্ল্যানিং সফল। কলেজে পড়তে পড়তেই সনৎ খরাজ পার্টির ছাত্র সংগঠনের রাজ্যস্তরের নেতা হয়ে গিয়েছিল। ও-ই বিহানকে বলেছিল, “সরকারের ঝুলিতে আর টাকা নেই। সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না।”

গণতান্ত্রিক মোর্চাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কিশলয় পার্টি খরাজ পার্টিকে নানা সুযোগ-সুবিধে দেয়। সেই সুবিধের কারণেই বিহান আর সনৎ হাওড়ার বকুলতলা বন্দর অফিসে চাকরিটা পেয়ে গেল। তাদের প্রাথমিক চাকুরিদাতা বন্দর হলেও মাঝখানে এক কনট্র্যাক্টর আছেন। তাঁকে সকলে মিস্টার দাস বলে ডাকে। নাম কেউ জানে না। সিড়িঙ্গে চেহারার মিস্টার দাস সব সময় ধূসর রঙের সাফারি পরে থাকেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। পায়ে দামি জুতো। নাকের নীচে বাটারফ্লাই গোঁফ, যেটা দেখলেই বিহানের মনে হয় আঠা দিয়ে লাগানো আছে!

দু’জন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীর বেতন বাবদ প্রতি মাসে তিরিশ হাজার টাকা মিস্টার দাসের হাতে তুলে দেয় বকুলতলা পোর্ট। বিনিময়ে মাসের শেষে কাজ বুঝে নেয়। এগারো মাসের চুক্তি। এগারো মাসের শেষে পুনর্নবীকরণ না হলে চাকরি গেল।

বিহানের কাজের সময় সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা। মাঝখানে এক ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক। মেশিনে বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে অফিসে ঢুকতে হয়। বেরোনোর সময়েও একই ব্যবস্থা। কে ক’টায় ঢুকছে এবং বেরোচ্ছে, সব বন্দরের সেন্ট্রাল সার্ভারে নথিভুক্ত থাকে। পালানোর উপায় নেই।

পালিয়ে করবেটা কী বিহান? একশো কিলোমিটার উজিয়ে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। বকুলতলার আগের স্টেশনের নাম পোর্ট স্টেশন। সেখান থেকে সারা দিন মালগাড়ি ছাড়ে। হাতে গোনা কয়েকটা লোকাল ট্রেন আছে। সেগুলো এমন বেখাপ্পা সময়ে ছাড়ে যে বিহান কখনও ট্রেনে চড়ার কথা ভাবেনি। শুনেছে ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। জাতীয় সড়ক দিয়ে শনশন করে চলে সরকারি আর বেসরকারি বাস। তাতে উঠলেও হরেদরে একই সময়। ছ’ঘণ্টার যাতায়াত এড়াতে মেস ভাড়া নিয়েছে বিহান আর সনৎ।

বিছানা সাফ করে রান্নাঘরে ঢুকল বিহান। চা ছেঁকে, দুটো কাপে ঢেলে, চারটে বিস্কুট প্লেটে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে সনৎকে খোঁচা মেরে বলল, “চা!”

সনৎ আর বিহানের বয়স ছাব্বিশের সামান্য উপরে। বিহানকে ছাব্বিশের মতোই দেখতে লাগে। ফর্সা গায়ের রঙ, রোগাপাতলা চেহারা, একমাথা চুল, চোখদুটো ভাসা-ভাসা। সনৎকে দেখে মনে হয় তিরিশ পেরিয়েছে অনেক দিন। এবং সেটা মনে হওয়ার পিছনে কারণও আছে। রাজ্যস্তরের নেতা হওয়ার ওজন আছে, নানা দু’নম্বরি কাজ করে ঘুষ খেয়ে পকেট গরম থাকার অভিঘাত আছে, এই বয়সেই গাড়ি-বাড়ি করে ফেলার আত্মদর্প আছে। সব মিলিয়ে ছ’ফুট, শ্যামবর্ণ সনৎকে পেটমোটা কোলা ব্যাঙের মতো দেখতে। মাথার চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, ওজন একশো দশ কিলো, চোখের নীচে অ্যালকোহলের কারণে পাউচ। পটলের মতো মোটা মোটা দশ আঙুলে গোটা আটেক আংটি, গলায় তিনটে সোনার চেন, হাতে সোনার মোটা বালা। একগাদা তাবিজ আর কবচ শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঝুলছে। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। সেটা নেতাসুলভ গাম্ভীর্য আনার কারণে, না সত্যিই দরকার, জানে না বিহান। সনৎ সব সময়ে সাদা কুর্তা আর পাজামা পরে থাকে। হাওড়া ময়দানের পুরনো বাড়ি বিক্রি করে সে চলে গিয়েছে গঙ্গার ও পারে। হেস্টিংস এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। সেখানেই বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। হেস্টিংস এলাকাতেও ও নেতা। সনৎ এখনও বিয়ে করেনি। কোনও বান্ধবীও নেই। বিহান কানাঘুষোয় শুনেছে সনতের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি আছে। সেটা কখনও দেখেনি বিহান।

সনৎ ডিউটি করে সপ্তাহে দু’দিন। বৃহস্পতিবার সকালে এসে মেসে চান খাওয়া সেরে দুপুর একটার সময়ে বন্দরের ভিতরে ঢোকে। বেরোয় রাত দশটা নাগাদ। সে অফিসে কাজ করে না। সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন ‘খরাজ রাজ্য ফেডারেশন’ বা ‘কেআরএফ’-এর রাজ্যস্তরের নেতা হিসেবে তার কাজ হল সংগঠনকে মজবুত করা। বাংলার প্রতিটি জেলার প্রতি ব্লকে তার যোগাযোগ। এমন কর্মযোগীর পক্ষে কি সামান্য ডেটা এন্ট্রির কাজ করা সম্ভব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Indranil Sanyal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE