Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
National News

চাঁদের কাছাকাছি

এই হাসপাতালের রোগীরা কেউ ভাল পিয়ানো বাজান। কেউ ক্রিকেটার, কেউ খুব ভাল টাইপিস্ট। কিন্তু সকলেই চন্দ্রাহত। একশো বছর পেরিয়ে গেল রাঁচীর ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’। মানুষ যাকে আজও ভুল করে বলে, পাগলা গারদ!এই হাসপাতালের রোগীরা কেউ ভাল পিয়ানো বাজান। কেউ ক্রিকেটার, কেউ খুব ভাল টাইপিস্ট। কিন্তু সকলেই চন্দ্রাহত। একশো বছর পেরিয়ে গেল রাঁচীর ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’। মানুষ যাকে আজও ভুল করে বলে, পাগলা গারদ!

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সূর্যাস্ত হলেই একটা মন কেমন করা পিয়ানোর সুর ছড়িয়ে যেত পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে। ২১১ একরের বিশাল ক্যাম্পাসের বাগানে ইতিউতি ঘুরতে থাকা রোগী থেকে শুরু করে চিকিৎসকরা আনমনা হয়ে যেতেন। মনে হত, যিনি পিয়ানো বাজাচ্ছেন তিনি যেন ভিতর থেকে কোনও একটা যন্ত্রণা খুঁড়ে নিয়ে আসছেন। সন্ধের ওই পিয়ানোর সুর শুনেই বোধহয় ক্যাম্পাসের ভিতর আম, জাম, শাল, পিয়াল গাছে বাসা বাঁধা পাখিরা ঘরে ফিরে আসে।

শুধু কি ওই পিয়ানোবাদক? যে মাঝবয়সি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক তুখড় গতিতে একটাও ভুল ছাড়া ইংরেজিতে টাইপ করে যেতেন তাঁকেই বা কী করে ভোলা যায়? ডাক্তারি ছাত্রদের দিস্তার পর দিস্তা নোট টাইপ করতে হলে ওই ভোলাভালা লোকটাই তো ছিল ভরসা। ভরসাটা ছিল একটু বেশিই। কারণ নোটে কোনও বানান ভুল থাকলে অবধারিত ভাবে সেই বানান ঠিক করে দিতেন ওই টাইপিস্ট। তাছাড়া ওঁর কাছে টাইপ করতে যাওয়ার আর একটা মজা ছিল। ভদ্রলোক যে কোনও সময়ে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিতে পারতেন।

এ তো মাত্র দু’জন রোগীর কথা বলা হল। সেটা ছিল সত্তরের দশক। এ রকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুণী মানুষের সংখ্যা কম ছিল না রাঁচীর কাঁকে-র মানসিক হাসপাতালে। পুটপুটা নদীর ধারে যে হাসপাতালের পোশাকি নাম সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি। কথ্য ভাষায় রাঁচীর ‘পাগলা গারদ’ নামে বিখ্যাত। দেখতে দেখতে এই যার একশো বছর পার হয়ে গেল।

আমাদের হাসপাতালে কোথায় গারদ আছে একটু খুঁজে বের করে দেখান তো? সেন্ট্রাল ইনস্টিটিটিউট অব সাইকায়াট্রি-র (সিআইপি) অধ্যাপক খ্রিস্টোডে রাজা জয়ন্ত খেস-এর প্রশ্ন, ‘‘আমাদের হাসপাতালের ২১০ একর জমিতে খুঁজে বের করুন কোথায় একটা রোগীকে আমরা হাত-পা বেঁধে গারদে পুরে রেখেছি। একটা ভুল ধারণা মানুষের বছরের পর বছর ধরে রয়ে গিয়েছে। কেন একে বলা হবে পাগলা গারদ? এই ভুল ধারণাটা ভাঙা দরকার। ঘুরে আসুন আমাদের ক্যাম্পাস। ঘুরে দেখুন কেমন গাছগাছালিতে ভরা চারদিক। দেখুন গত একশো বছরের কত স্মৃতিচিহ্ন পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে।’’ অধ্যাপক খেস জানালেন, দক্ষিণ লন্ডনের মড‌স্‌লি মেন্টাল হাসপাতালের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল রাঁচীর এই হাসপাতাল। মড‌স্‌লি হাসপাতালের ক্যাম্পাসের সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে রাঁচীর এই হাসপাতালের। মড‌স্‌লি মানসিক হাসপাতালে কোনও গারদ নেই। এখানেও নেই। বিলিতি হাসপাতালটি শুরু হওয়ার দু’বছর পরেই রাঁচীতে এই মানসিক হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু হয়।

তখন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। কলকাতার ভবানীপুরে ও বহরমপুরে রয়েছে লুনাটিক অ্যাসাইলাম। কিন্তু দু’জায়গাতেই তখন মানসিক রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে। বিদেশি মানসিক রোগীরা সেখানে জায়গা পাচ্ছেন না। দরকার আর একটা হাসপাতাল। কিন্তু কোথায় করা যায় সেটা?

তখন বাংলা, বিহার, ওডিশা মিলে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। ব্রিটিশ সরকার ঠিক করল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মধ্যেই কোনও এক শহরে এই হাসপাতাল খুলতে হবে। এমন একটা জায়গা তাঁরা খুঁজছিলেন যেখানকার মনোরম আবহাওয়া রোগীদের মনমেজাজ ভাল রাখবে। জায়গা খুঁজতে খুঁজতে তাঁদের নজরে পড়ে গেল রাঁচী। প্রশাসনিক নানা কারণে এই শহরে তখন সাহেবদের আনাগোনা ছিল। সেই সাহেবদের থেকেই জানা গেল, যে রকম আবহাওয়ায় তাঁরা এই হাসপাতাল তৈরি করতে চাইছেন, রাঁচীর আবহাওয়া ঠিক সে রকমই। এখানে গরমকালেও প্রায় প্রতি দিন বিকেলে বৃষ্টি নামে। আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে যায়। গরমকালে সব সময় সঙ্গে রাখতে হয় অন্তত একটা হাফ হাতা সোয়েটার বা চাদর। আর ঠান্ডায় তো তাপমাত্রা শূন্যও ছোঁয়।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল রাঁচীর নামকুমে তৈরি হবে এই হাসপাতাল। কিন্তু পরে মত বদলে হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত হল কাঁকের পুটপুটা নদীর ধারে। ১৯১৭ সালে শুরু হল হাসপাতাল তৈরির কাজ, আর ১৯১৮ সালের ১৭ মে খুলে গেল দেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতাল। তবে শুধু বিদেশিদের জন্য। ১৭৪ জন রোগী নিয়ে শুরু হওয়া এই হাসপাতালের নাম দেওয়া হল ‘ইউরোপিয়ান লুনাটিক অ্যাসাইলাম।’

প্রথম দিকে খোদ সাহেবদের কাছ থেকেই এই হাসপাতালকে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেনাবাহিনীর চিকিৎসক কর্নেল বার্কলে হিল হাসপাতালের ডিরেক্টর হয়ে এলেন ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে। ডিরেক্টর হওয়ার পরে হাসপাতালের সামগ্রিক পরিবেশ দেখে তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ হলেন। সরাসরি যোগাযোগ করলেন তাঁর বন্ধু, স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে। হাসপাতাল ঘুরে ভাল করে সমালোচনামূলক একটা রিপোর্ট লিখতে অনুরোধ করলেন সম্পাদককে। কয়েক দিনের মধ্যে কাগজে প্রকাশিত হল রাঁচীর ইউরোপিয়ান লুনাটিক অ্যাসাইলাম নিয়ে একটি লেখা। লেখা পড়ে নড়েচড়ে বসেছিল ব্রিটিশ সরকার। কয়েক বছরের মধ্যেই ভোল পাল্টে গেল হাসপাতালের। ১৪ বছর টানা ডিরেক্টর থেকে যখন এই হাসপাতাল থেকে অবসর নিলেন বার্কলে হিল, তখন তিনি বলেছিলেন, শুধু দেশের মধ্যেই নয়, এশিয়ারও সব চেয়ে সুন্দর রাঁচীর এই ইউরোপিয়ান লুনাটিক অ্যাসাইলাম।

বার বার নাম পরিবর্তন হয়েছে এই হাসপাতালের। ১৯৪৭ সালে নাম পাল্টে হয় ‘ইন্টার-প্রভিনশিয়াল মেন্টাল হসপিটাল’। ১৯৫২ সালে এর নাম হয় ‘হসপিটাল ফর মেন্টাল ডিজিজেস’। এবং সব শেষে ১৯৭৭ সালে এর নাম হয় সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি।

সেই ১৯৭৭ সাল থেকেই এই হাসপাতালের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছেন খুশান্দাল টোপ্পো। ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হল তাঁর সঙ্গে। তিনি এই হাসপাতালের দর্জি। এখানে ভর্তি থাকা রোগীরা, যাঁরা কিছুটা সুস্থ হয়ে যান, তাঁদের নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পছন্দ মতো কাজ বেছে নেন তাঁরা। কেউ করেন দর্জির কাজ, কেউ ছবি আঁকেন, কেউ বা কাঠের কাজ করেন। অনেকে আবার কৃষি কাজ নিয়ে থাকেন। যে সব রোগীদের জামাকাপড় বানানোর কাজে উৎসাহ, তাঁদের দর্জির কাজ শেখান খুশান্দার।

প্রায় চার দশক ধরে রোগীদের জামাকাপড় বানানো শেখাচ্ছেন খুশান্দার। বললেন, ‘‘আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখনও প্রচুর ব্রিটিশ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রোগীকে দেখেছি। এই হাসপাতালই ছিল ওদের স্থায়ী ঠিকানা। ওদের প্রিয়জনরা ওদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। অনেকেই মারা গিয়েছে এখানে। কবর দেওয়া হয়েছে এই হাসপাতালের ধার ঘেঁষা নদীর পাড়ে।’’

কয়েক জন রোগীকে সেলাই শেখাচ্ছিলেন খুশান্দার ও ক’জন সহকর্মী। হাসপাতালে নিজেদের পোশাক নিজেরাই সেলাই করেন রোগীরা। খুশান্দার বলেন, ‘‘এঁদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে গ্রামে দর্জির দোকান খুলেছেন। খুব কাছ থেকে এঁদের প্রতিদিন দেখি আর বন্ধুর মতো মিশে যাই। ওঁরা অনেক কথা ডাক্তারকে বলতে পারেন না। কিন্তু আমাদের বলেন। আমরা সেই সব ইনপুট আবার ডাক্তারদের দিয়ে দিই।’’ খুশান্দারের এক সহকর্মী রুনু আলি হেসে বলেন, ‘‘শুধু একটা জিনিস আমরা এখন আর দিতে পারি না। আগে দিতে পারতাম। সেটা হল বিড়ি বা খৈনি।’’

দার্শনিক: মিশেল ফুকো

খুশান্দাররা জানালেন, কাজ করতে করতে অনেকেই নেশার জিনিসও চেয়ে বসেন। আগে এই হাসপাতালে রোগীদের জন্য সাপ্তাহিক এক প্যাকেট বিড়ি বা খৈনি বরাদ্দ থাকত। রুনুবাবু বলেন, ‘‘অনেককে দেখেছি, একটা বিড়ি ধরিয়ে কাজে অনেক বেশি মগ্ন হয়ে গেল। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কাজ ফেলে সে খেতে যাচ্ছে না। এখন অবশ্য হাসপাতালের ভিতর বিড়ি, সিগারেট খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।’’

খুশান্দাররা জানান, তখনকার পরিবেশটা একেবারেই অন্য রকম ছিল। যারা এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতেন তাঁদের সপ্তাহের শেষে ভাল কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হত। ছোট ছোট পুরস্কার, কিন্তু তাতেই কী যে খুশি হতেন ওঁরা! কেউ পেতেন টফি, কেউ বা বিস্কুট। সাবান, গায়ে মাখার তেল, চিরুনিও দেওয়া হত। পুরস্কার পাওয়ার তাগিদে কাজের মান আরও ভাল হত। বিকেলে ট্রেনিং সেন্টারের পিছনে বসত ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে চা তো হতই, এমনকি সন্ধ্যায় পকোড়া, সিঙাড়া ভাজতেন রোগীরাই।

এক বিদেশি ক্রিকেটারের কথাও খুব মনে পড়ে এখানকার পুরনো চিকিৎসক ও কর্মীদের। ইংল্যান্ডের ওই ক্রিকেটারকে তাঁর পরিজনরা কেউ নিয়ে যাননি। তীব্র অবসাদে ভুগে ওই তরুণ ক্রিকেটারের ঠিকানা হয়েছিল রাঁচীর মানসিক হাসপাতাল। অধ্যাপক খেস বলেন, ‘‘কী ভাল ব্যাটিং করতেন উনি! আমাদের ক্যাম্পাসের মাঠেই অন্য রোগীদের নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতেন। একটা ক্রিকেট টিম তৈরি করেছিলেন। মাঝেমধ্যে অন্যদের প্রশিক্ষণও দিতেন।’’ অধ্যাপক খেস জানান, ওই তরুণ ক্রিকেটার দারুণ ছবিও আঁকতেন। বিশেষ করে তেলরঙের ছবি। রাঁচীর আশেপাশের পাহাড়, ঝর্না ফুটে উঠত তাঁর তুলিতে। হাসপাতালেই মারা যান ওই ক্রিকেটার। হাসপাতালের পাশে নদীর ধারে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে এঁকেছিলেন আত্মপ্রতিকৃতি। ক্রিকেটারের পোশাক পরা সেই ছবি এখনও হাসপাতালের দেওয়ালে টাঙানো।

এই হাসপাতালেই কয়েক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ছিলেন বিশিষ্ট অঙ্কবিদ বশিষ্ঠ নারায়ণ সিংহ। বিখ্যাত হোক বা সাধারণ, যে সব রোগী এখানে আসেন তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব গল্প থাকে। সেই গল্প মন দিয়ে শোনেন এখানকার চিকিৎসক ও কর্মীরা। হাসপাতালের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগিয়ে গেলেই রয়েছে ডিঅ্যাডিকশন বিভাগ। সেখানকার এক কর্মী জানান, নেশা ছাড়ানোর জন্য এখানে রোগীরা ভর্তি হয়। কিন্তু কী কারণে এই মাত্রাতিরিক্ত নেশা? খুঁড়ে বার করতে চাইলে উঠে আসবে বহু বিচিত্র কাহিনি। এমন মানুষেরও দেখা মিলেছে যার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের দেবদাস চরিত্রের অনেক মিল। কিন্তু বাস্তবের এই সব দেবদাসের গল্প লেখার লেখক তো এখানে নেই। ওই কর্মীর আপশোস, ‘‘আমরা মানুষকে সুস্থ করার চেষ্টা করি শুধু। আমাদের তো আর লেখার ভাষা জানা নেই। তা হলে কত গল্পই না এখানে এই বাগানে, গাছের তলায় বসে লেখা হয়ে যেত!’’ পুরুলিয়ার এক তরুণের কথা তাঁদের খুব মনে পড়ে। বন্ধুর বোনকে ভালবেসে, ঘটনাচক্রে পরে ওই তরুণের ঠিকানা হয়েছিল এই হাসপাতাল। গুনগুন করে তিনি মাঝেমধ্যেই গাইতেন, ‘‘বেকারার করকে হামে ইউ না জাইয়ে, আপ কি হমারে কসম লট আইয়ে।’’ কী ভাল গানের গলা ছিল সেই তরুণের!

হাসপাতাল চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছনো গেল ‘ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি’ বিভাগে। এই সেই বিখ্যাত বিভাগ, যেখানে রোগীকে চিকিৎসার জন্য ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। এখন অবশ্য মন-চিকিৎসার ক্ষেত্রে আধুনিক নানান ওষুধ বাজারে আসার পরে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা অনেক কমে গিয়েছে। চিকিৎসকরা জানালেন, এখন রোগীকে অ্যানাসথেসিয়া প্রয়োগ করে তার পরই এই থেরাপি দেওয়া হয়।

তবে এখানকার চিকিৎসকদের এক অংশের মতে, ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি কিন্তু খুবই কার্যকরী। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভুল ধারণার ফলেই এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। এক চিকিৎসক জানালেন, মাইক্রো ভোল্টের বিদ্যুৎ দিয়ে এক মিলিসেকেন্ডের মতো ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। অথচ বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা, রোগীর হাত-পা বেঁধে বেশ কিছু ক্ষণ ধরে শক দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানালেন, হাত-পা মোটেই বেঁধে রাখা হয় না, চিকিৎসকরা হালকা করে ধরে থাকেন, তা-ই যথেষ্ট। সিনেমাতে এই থেরাপিকে ভয়ঙ্কর ভাবে দেখানো হয়, তাই মানুষের মনে এই ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। হাসপাতালের বর্তমান ডিরেক্টর ডি রাম জানালেন, ‘‘ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা ভাঙা খুব দরকার। এই থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার খরচও বেশ কম। অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধের থেকেও বেশি কার্যকরী এই থেরাপি। খুব দ্রুত সুস্থও হয়ে ওঠেন রোগী।’’

ডি রাম জানান, অনেক কিছুতেই এই হাসপাতাল সকলের আগে ছিল। যেমন অকুপেশনাল থেরাপি ট্রিটমেন্ট এখানে এসেছে ১৯২২ সালে। ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি এসেছে ১৯৪৩ সালে। লিউকোটোমি নামে এক ধরনের মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হাসপাতালে চালু হয়েছে ১৯৪৯ সালে। তখন ভারতের অন্য কোনও হাসপাতালেই কিন্তু এই ধরনের চিকিৎসার প্রচলন ছিল না।’’

স্বাধীনতার আগে ও পরে বেশ কয়েক বছর এই হাসপাতালের বেশির ভাগ ডিরেক্টরই ছিলেন বিদেশি। এ রকমই এক ডিরেক্টর, মেজর আর বি ডেভিসকে ভুলতে পারেনি এই হাসপাতাল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ডিরেক্টর ছিলেন ডেভিস। অবসর নেওয়ার পরেও তিনি এ দেশেই থেকে যান। সিআইপি-এর কাছে কাঁকে-তেই তিনি খোলেন ‘ডেভিস ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইকায়াট্রি’। এই দেশের মানসিক রোগীদের সেবার জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন মানুষটি।

১৯৪৯ সালে দেশের প্রথম ‘মেন্টাল হেল্থ অ্যাক্ট অব ইন্ডিয়া’র ড্রাফ্টও তৈরি করেন ডেভিস। ১৯৮০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর তৈরি হাসপাতালটি অবশ্য এখনও চালাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্ম।

সিআইপি-র কয়েকটি ওয়ার্ডের নাম হাসপাতালের প্রাক্তন ডিরেক্টরদের নামে। কোনও ওয়ার্ডের নাম ক্রেপলিন ওয়ার্ড, কোনওটির বেকারি হিল ওয়ার্ড, আবার কোনওটি কনোলি ওয়ার্ড। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে বিলেতের স্থাপত্যের ছোঁয়া। একশো বছরের পুরনো হাসপাতালের গায়ে কোথাও একটুও জীর্ণতা নেই। হাসপাতালের এক পুরনো কর্মী বললেন, ‘‘শীতকালে কনকনে ঠান্ডায় হাসপাতালের ওয়ার্ডের ছাদে, মাঠে, বাগানে বরফের আস্তরণ পড়ে যেত। তখন মনে হত, সত্যিই যেন বিদেশের কোনও হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছি।’’

হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘোরাতে ঘোরাতে ফের একই প্রশ্ন অধ্যাপক খেস-এর: ‘‘কই, কোথাও দেখতে পেলেন গারদ?’’ বাইরের সাধারণ মানুষের এই হাসপাতালে প্রবেশাধিকার নেই। হয়তো পুরো হাসপাতাল ঘিরে থাকা বিশাল উঁচু পাঁচিল দেখেই অনেকের ধারণা, এটা একটা গারদ বা জেল। অধ্যাপক খেস বলেন, ‘‘এই বিশাল উঁচু পাঁচিলেরও সত্যিই দরকার নেই। একটা সময় মানসিক রোগীদের সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে রাখার নিয়ম ছিল। তখন পাঁচিল তোলার দরকার হয়েছিল। এখন আর তার দরকার পড়ে না।’’ মিশেল ফুকোর ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ কথারই যেন প্রতিধ্বনি এই ডাক্তারের কণ্ঠে। ফুকো দেখিয়েছিলেন, পাগলামি নিয়ে আমাদের ধারণা বদলেছে যুগে যুগে। ধ্রুপদী যুগে কবি, দার্শনিক, যাজক এবং উন্মাদ প্রায় সমগোত্রীয়। ‘দিব্য, পবিত্র স্বর’ শুনতে পান তাঁরা। পবিত্র উন্মাদ বা ‘হোলি ফুল’-এর ধারণা তখনই সমাজে বাসা বাঁধে।

তার পর ধারণা বদলে গেল। মধ্যযুগ ভয় পেত যুদ্ধ ও কুষ্ঠ রোগকে। আর রেনেসাঁস-এর সময় মানুষ ভয় পেতে শিখল পাগলামিকে। পাগলামি কার্যকারণবোধকে নষ্ট করে দেয়, কাজকে করে দেয় মূল্যহীন, চিন্তাকে করে ধারহীন। ১৬৫৬ সালের প্যারিসে তাই জারি হল নির্দেশ: গরিব, হতভাগ্য, দুর্বল ও চলচ্ছক্তিহীনদের রেখে দেওয়া হবে সেখানকার হাসপাতালে। উন্মাদনাকে শিকল পরানোর সেটাই শুরু। আর মানসিক চিকিৎসা? দার্শনিক পরিষ্কার জানাচ্ছেন, উন্মাদনাকে এই যে বেড়ি পরানো শুরু হল, তার নৈতিক, সামাজিক ও আইনি ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই সবাইকে পাঁচিল ঘেরা একটা জায়গায় রেখে মানসিক চিকিৎসার শুরু। এখন সমাজ আধুনিক হয়েছে, রাঁচীর এই মানসিক হাসপাতালও। ‘‘আধুনিক চিকিৎসায় সমাজের মধ্যেই মানসিক রোগীদের রেখে চিকিৎসা করার নিয়ম। আমাদের চিকিৎসকদের একটা দল মাঝেমধ্যে অন্য এলাকাতে গিয়েও মনোরোগীদের চিকিৎসা করে আসেন,’’ বললেন অধ্যাপক খেস।

একশো বছরের পুরনো এই সিআইপি-র কাছেপিঠে তৈরি হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি মানসিক হাসপাতাল। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত এই হাসপাতালকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে তারই পাশে গড়ে ওঠা আর এক মানসিক হাসপাতাল ‘রাঁচী ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইকায়াট্রি অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস (রিনপাস)’। রাজ্য সরকার পরিচালিত এই হাসপাতাল সিআইপি-র প্রায় সমসাময়িক। অনেকের এমনও মত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রিনপাস সিআইপিকে টেক্কা দিচ্ছে, একশো বছরের পুরনো সিআইপি নিজেকে সময়ের সঙ্গে পুরোপুরি বদলাতে পারেনি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে অন্য অনেক কিছুই। যে মনোরম আবহাওয়ার জন্য রাঁচীতে এই মানসিক হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল সেই আবহাওয়া রাঁচীতে নেই। এখন আর গ্রীষ্মকালে হাতের সামনে হাফ হাতা সোয়েটার রাখার দরকার পড়ে না। তবে পুরনো আবহাওয়া আর মেজাজ হারিয়ে ফেললেও এখনও কিছু ম্যাজিক অবশিষ্ট আছে এখানে। তীব্র গরমের পরে বৃষ্টি নামলে এখনও ঠান্ডা হয়ে যায় চারদিক। তখন মনে হয়, কাঁকের হাসপাতালের ক্যাম্পাসের ভিতরে এখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে সেই পিয়ানো-বাজিয়ের মন কেমন করা সুর।

(সিআইপি-র চিকিৎসাধীন রোগীদের নাম ও পরিচয় উল্লেখ করার নিয়ম নেই। তাই কোনও রোগীরই নাম, পরিচয় দেওয়া হল না।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE