Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেন বিনয় ঘোষ, সংস্কৃতির শহর নির্বিকার

পায়ে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে ঘুরেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার পর তুলে ধরেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ থেকে ‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র।’ বিদ্যাসাগর থেকে মেট্রোপলিটন মন, সব কিছুতেই তাঁর প্রখর নজর।বিনয় ঘোষকে জানার জন্য যেমন সমসময়ের উত্তাল ও অগ্নিগর্ভ দেশ ও বিতন্ডাগ্রস্ত মানবসমাজকে সামনে রাখতে হবে, তেমনই মনে করা চাই কেমন পরিবেশ ও পরিবারে তাঁর জন্ম।

বিনয় ঘোষ। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বই লেখার সময়কার ছবি।

বিনয় ঘোষ। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বই লেখার সময়কার ছবি।

সুধীর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

ঘোরাঘুরির অভ্যাস ও নেশাটা ছেড়ো না— এটাই শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে যেমন আমাকে রেখেছে। নিজের দেশ, দেশের মানুষ, তার কাজকর্ম, কীর্তি নিজের চোখে দেখা— এর চেয়ে বড়ো কাজ মানুষের জীবনে নেই বলে মনে হয়।

এক অনুজ সন্ধিৎসুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন বিনয় ঘোষ (১৯১৭-১৯৮০), যার থেকে তাঁর সামগ্রিক জীবনদর্শনের মর্মরস আমরা নিষ্কাশন করে নিতে পারি। ১৯১৭ সালের ১৪ জুন কলকাতার মনোহরপুকুরে তাঁর জন্ম। কলকাতাতেই তাঁর প্রয়াণ ২৫ জুলাই ১৯৮০ সালে, মাত্র ছেষট্টি বছর বয়সে। তাঁর জন্মশতবর্ষ আমরা প্রকৃত দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাবোধে উদ্‌যাপন করিনি। বস্তুত এ বঙ্গে ‘পার্টিসিপেটরি রিসার্চ’-এর পরিসরে বিনয় ঘোষ ছিলেন এক অদম্য প্রাণশক্তিধর পুরুষ। একই সঙ্গে মনে আসে তারাপদ সাঁতরা, মানিকলাল সিংহ, ভূপতিরঞ্জন দাস ও হিতেশরঞ্জন সান্যালের নাম। এঁরা সকলেই এখন প্রয়াত। তবে বাংলার বিভিন্ন নামী গ্রামের আশেপাশে অকুলীন জন-সমাবেশে, মন্দির-মসজিদের স্বতন্ত্র নান্দনিকতার সন্ধানে ও লোকশিল্পের, লোকধর্মের আর ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচনের খোঁজে সরেজমিন অনেকেই এখনও তৎপর আছেন। এঁদের মগ্ন ও একলক্ষ্য প্রয়াসের ভিতরে রয়ে গিয়েছে বিনয় ঘোষের মতো স্বেচ্ছানিবেদিত সমাজ-স্বপ্নবাদীদের নির্জন একক পরিক্রমার অগ্রবীজ। সম্ভবত আমাদের নিবিড় তথ্যসন্ধানী বাঙালিদের মধ্যে বিনয় ঘোষের কাজ সবচেয়ে বহুশাখায়িত ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত সম্ভারে সংরক্ষিত, কেননা তিনি বরাবর ছিলেন লেখনীনিষ্ঠ ও প্রকাশ-পিয়াসী। ছিলেন একরোখা, আদর্শবাদী ও আপসহীন। শিখিল কর্তব্যযাপন কিংবা পারিতোষিকলোভী লেখনী চালনা তাঁর পক্ষে ঘৃণ্য ও বর্জ্য ছিল। স্থায়ী মসৃণ জীবিকার সহজ মার্গ তাঁকে টানেনি কোনও দিন। সচ্ছলতা ছিল অজ্ঞাত। দেখনদারি একেবারে ছিল না। সুগঠিত চেহারায় প্রত্যয়বান তাঁর চারিত্র্যমূর্তিটি বেশ মনে পড়ে, যার গভীরে ছিল অস্খলিত প্রগতিপন্থার রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাস। তাঁর সমগ্র সারস্বত দৃষ্টিকে তিনি বলতেন ‘জীবনের কাজ’। সেই কাজে তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন ও প্রতিদিনের শ্রমনিষ্ঠতায় জাগর। একই সঙ্গে তাঁর আগ্রহ নাগরিক মেট্রোপলিটন দ্বিধাচ্ছিন্ন মন ও প্রাচীন মানুষের শুদ্ধ সঞ্চারিত জীবনবোধের প্রতি। তাই কলকাতার আদিকল্প বিষয়ে অনুসন্ধানের গায়ে গায়ে খুঁজতে চেয়েছেন সামগ্রিক ব্যাপ্তি ও বৈচিত্রে ভরা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির প্রাণভোমরা। বাংলা সাময়িকপত্রের মধ্যে সন্নিবিষ্ট সমাজচিত্রের উন্মোচনের পাশে লোকসংস্কৃতির সমাজচিত্রকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।

আজকের সমাজবিজ্ঞান চর্চা ও সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বিনয় ঘোষের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভর্তি-নির্ভর গবেষণার বিপুল ফসল পদে পদে কাজে লাগে। তাঁর সমগ্র রচনাকৃতির মূলে দেশকে ও পরম্পরাগত সমাজ-মানসকে জানার ও বোঝার অসীম আগ্রহ ছিল। তার জন্য যথাযথ পশ্চিমি চিন্তানায়কদের ভাবনা ও প্রেক্ষাপট বই পড়ে বুঝে নিতে দ্বিধা রাখেননি। অন্বেষণের সমান্তরালে জাগরূক থাকত তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রবণতার স্পষ্টতা। সমসময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক যে প্রগতিপন্থার ঢেউ উঠেছিল, তার একটি অভিমুখ ছিল আন্তর্জাতিক এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্ব-পরিপ্রেক্ষিতের সংলগ্ন। কিন্তু বিনয় ঘোষের সামগ্রিক ‘জীবনের কাজ’ কতটা অনন্য ও যুগযন্ত্রণায় সম্পৃক্ত, তা সম্পূর্ণ ভাবে বোঝার জন্য তাঁর জীবনকথা খানিকটা জানা দরকার।

বিনয় ঘোষের আদি বাস্তু তৎকালীন যশোহর জেলার বনগাঁর গোয়াপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম বিশ্বেশ্বর ঘোষ, মা সরসীবালা। কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে বিনয় স্নাতক হন। কিন্তু সারা জীবন স্বনির্ভর অধ্যবসায়ে একক পরিচর্যায় নিজস্ব পাঠক্রম তৈরি করে নানা বিষয়ের চর্চা ও অনুসন্ধানে গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে কয়েক সহস্র বই ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ নেননি। ইতিহাস ও সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার আদি বৃত্তান্ত বিষয়ে যথেষ্ট সমুৎসুক ছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে কোনও দিনই ভাবেননি যে, জীবন বিকাশে আর্থিক সমুন্নতিগত স্বস্তি দরকার। তাই অনবরত জীবিকান্তরে চলে গেছেন। তবে মোটামুটি তাঁর নির্ভরতা ছিল সাংবাদিকতায় এবং স্পন্দমান রচনাবৈচিত্রের দিকে। বিষয়গত একঘেয়েমি তাঁকে গ্রস্ত করেনি কখনও, কারণ নিত্যনব প্রসঙ্গে বা কোনও উপেক্ষিত বিষয়ে আলোকসম্পাতের আবেগে তিনি সক্রিয় থাকতেন। গ্রন্থপাঠের একাগ্রতা থেকে এই নানাচারী সামর্থ্য তাঁকে অর্জন করতে হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে সংবাদপত্রঘটিত কাজে তৎপর ও তুখড় বাস্তব দৃষ্টিকোণের চর্চা করেছিলেন বলে চটজলদি ও স্পষ্টবাক লেখনীর ঔজ্জ্বল্য তাঁর গদ্যকে ঋজু রেখেছিল। স্বচ্ছন্দে ইংরিজি ও বাংলায় লিখে যেতেন। ‘ফরওয়ার্ড’, ‘যুগান্তর’ ও ‘দৈনিক বসুমতী’র সম্পাদকীয় রচনায় তিনি সুনাম পেয়েছিলেন, তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুকূল বলে ‘অরণি’ পত্রিকায় তাঁর সক্রিয়তা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ছিল।

স্ত্রী বীণা ঘোষের সঙ্গে বিনয় ঘোষ।

বিনয় ঘোষকে জানার জন্য যেমন সমসময়ের উত্তাল ও অগ্নিগর্ভ দেশ ও বিতন্ডাগ্রস্ত মানবসমাজকে সামনে রাখতে হবে, তেমনই মনে করা চাই কেমন পরিবেশ ও পরিবারে তাঁর জন্ম। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর হাজরা লেনের (বর্তমানের ল্যান্সডাউন প্লেস) নিম্নমধ্যবিত্ত পল্লিতে তাঁর জন্ম। ৯০ বছরের লিজ নেওয়া টিনের ছাউনির বাড়ি, চার ফুট উঁচু সিমেন্টের গাঁথনির ওপর কঞ্চির বেড়ায় মাটির প্রলেপ লাগানো দেয়াল। প্রতিবেশীদের অবস্থাও তথৈবচ। অদূরে কয়েকটি বড়লোকের বাড়ি। তবে তাঁদের ছিল একটা সংহত পাড়া, পরস্পরের দুঃখে-সুখে ভাগ করা। বিনয় যেমন টের পেয়েছিলেন ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমির অন্তঃস্পন্দ, তেমনই দেখেছিলেন অভাবী মানুষদের নিত্যকার লড়াই। তাঁর সারা জীবনের ঘোর লেগে ছিল দুঃখী মানুষের প্রতি মমতাবোধে ও তাদের প্রতিকার প্রার্থনায়।

বাবা বিশ্বেশ্বর ঘোষ ছিলেন শক্তপোক্ত মানুষ। নির্ভীক ও স্পষ্টভাষী। সামান্য কেরানিগিরি থেকে শুরু করে, সততাবোধে ও কর্মকুশল তৎপরতায় উন্নীত হন উচ্চতর পদে। অফিস ইউনিয়নের সংগঠনে, তার আদর্শ ও নীতি-প্রণয়নে তিনি অগ্রণী ছিলেন। এমনকি তখনকার দিনে ভবানীপুরের রক্ষণশীল পল্লিতে বিধবাবিবাহ দিয়ে তিনি সম্ভ্রম ও স্বাতন্ত্র্যবোধের শিরোপা পান। তাঁর একনিষ্ঠ কঠোরতার পাশে মা সরসীবালার স্নেহময়ী মূর্তিটাই জ্যেষ্ঠ সন্তানকে ঘিরে থাকত। বাবার প্রতাপ আর মায়ের আদর যুগপৎ পেয়েছেন বড় ছেলে। বিনয়ের বিদ্যারম্ভ হয়েছিল পাড়ার কাছে মনোহরপুকুরে নীরদ মাস্টারের পাঠশালায়। পরে ক্যাথিড্রাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং আশুতোষ কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাশ করেন। তাঁর ছিল অর্থনীতিতে অনার্স। অনেকটা পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি (নৃতত্ত্ব) বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। তাঁকে নৃতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে উৎসাহ দেন প্রখ্যাত অধ্যাপক ও প্রগতিভাবুক নীহাররঞ্জন রায়। বিনয় ঘোষ নিজেও চেয়েছিলেন নীহারবাবুর অধীনে গবেষণা করে পিএইচ ডি করতে। কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি, কেননা নীহাররঞ্জন কারারুদ্ধ হন। মুক্তি পান ১৯৪৫ সালে। তত দিনে বিনয় ঘোষ অন্যতর কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাই শেষ পর্যন্ত অ্যাকাডেমিয়ার রাজসিক জীবিকার বদলে চলে গেলেন সমাজ-সংস্কৃতি-নৃতত্ত্বের সরেজমিন উদ্‌ঘাটনের ব্রতে।

বিনয় ঘোষকে যথার্থ রূপে জানতে তাঁর স্ত্রী বীণা ঘোষের কথাও জানা জরুরি। বীণা সিলেটের এক উদার ও সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মান। বিনয়ের মতো একই বিষয়ে এমএ পাশ করে বিটি পড়েন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় বীণার সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় ছিল। ১৯৪১ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। বীণা একটানা ৩২ বছর ‘স্যার নৃপেন্দ্রনাথ গার্লস স্কুল’-এ শিক্ষকতা করেন এবং সংসারের রাশ ধরে রাখেন।

জন্মের একশো বছর পরে বিনয় ঘোষের মতো এক জন অজানা লেখকের যে কোনও রকম মূল্য নির্ধারণের কাজে সব সময় মনে রাখতে হবে, তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল এই বিচিত্র ও বহুমাত্রিক পশ্চিমবঙ্গকে সরেজমিন দেখে ও বুঝে নানা বীক্ষণকোণ থেকে উন্মোচন করা। যে কাজে তাঁর প্রখর নাগরিক চৈতন্য, অধ্যয়নসঙ্কুল জ্ঞানতত্ত্বের নিজকীয়তার সঙ্গে যে অভিনব পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছিল, তার মূলে শক্তিশালী ছিল পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, ঘুরে ঘুরে, গ্রামে গাঁথা স্বদেশের হৃদয়কে আবিষ্কার করার আত্মকর্তব্য। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান বা খ্যাতনামা ব্যক্তিবিশেষের উপদেশ-নির্দেশে তাঁর এই দেশ জানার খ্যাপামি জাগেনি। অথচ সে কালের সংবাদপত্রের কর্মীদের বেতনগত শীর্ণতা, অপ্রতুল দক্ষিণার লেখকবৃত্তি থেকে কষ্ট করে টাকা জমিয়ে তিনি এত বিদেশি বই সংগ্রহ করেছিলেন, যা তাঁর জ্ঞান-বুভুক্ষু সত্তার অন্তর্বার্তা ঘোষণা করে। শেষ দিকে অর্থনৈতিক চাহিদার বাধ্যতায় তাঁর বিপুল গ্রন্থসংগ্রহের অনেকটা বিক্রি করে দেন এক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ নিয়ে তাঁকে ঘিরে কিছুটা বিতর্ক জেগে ওঠে, তবে এটাও জানা যায় যে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকায় সেই বইগুলি কেনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু অর্থাভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দুটি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এটাও নিতান্ত সময়ের অভিশাপ। এখনকার সময়ে এমন ঘটনা কি ঘটতে পারত?

আপাতত মনোযোগ দিতে পারি বিনয় ঘোষের ‘জীবনের কাজ’ প্রসঙ্গে। দেখে নেওয়া যেতে পারে তাঁর কিছু কিছু মত ও মন্তব্য। প্রথমেই বলেছেন: ‘‘লেখার প্রামাণিকতার জন্য যতদূর যাহা করা সম্ভবপর তাহা আমি করি। আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়া আমি উপকরণ সংগ্রহ করি।’’ এখানে যে কথা অনুক্ত তা হল, তাঁর এই ‘নিজের দৃষ্টিভক্তি’ বলতে বহুলাংশে মার্ক্সীয় চেতনার কথা বুঝতে হবে। আর একটি মৌলিক ভাষ্য: ‘লেখার জন্য লেখা, আমার জন্য লেখা, চিরন্তন সত্যের জন্য লেখা, এমন আগডোম বাগডোম কথার কোনও মূল্য নেই, ইতিহাসে নেই, মানুষের জীবনে নেই, মানুষের সমাজে নেই। ‘‘চিরন্তন সত্য’’ ইত্যাদি চিরন্তন অত্যাচারী অমানুষদের মুখের বুলি।’

বিনয় ঘোষের দৃঢ় প্রত্যয়ী জীবনাদর্শ, যা রূপ পেয়েছে তাঁর নানা স্বাদের গদ্যরচনায়, তার অভিমুখ ও ঝোঁক কোন দিকে, সে কথা বুঝতে আমরা তাঁর কবুলতি পড়তে পারি: ‘স্বাধীন শিল্পী, স্বাধীন লেখক হওয়া সহজ নয়। উৎকেন্দ্রিকতা স্বৈরাচারের দাসত্ব করা, স্বাধীনতা নয়। বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীর সমস্ত ন্যায্য অধিকারের স্বাধীনতাই আসলে স্বাধীনতা, আসল গণতন্ত্র। ফ্যাসিস্ট রাজত্বেও স্বাধীনতা থাকে, সামরিক একনায়কতন্ত্রেও স্বাধীনতা থাকে, ইমারজেন্সির সময়েও স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু কাদের সেই স্বাধীনতা? যারা ফ্যাসিস্টদের ও স্বৈরাচারীদের গোলামি করে, তাদের স্বাধীনতা। তারা কারা? সমাজের শতকরা দু’চার জন লোক। এই গোলামির স্বাধীনতা লেখকের জন্য নয়। লেখকের স্বাধীনতা যেহেতু সকল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা, তাই তাঁকে সেই স্বাধীনতা ‘‘ডিফেন্ড’’ করতে হয়, কারণ সেই স্বাধীনতা বিপন্ন হলে লেখাও বিপন্ন হয়।’ এখানে ‘ডিফেন্ড’ করা শব্দটি খুব দ্যোতক, অন্তত বিনয় ঘোষের কৃতিকে বুঝতে।

১৯১৭ সালে জন্মেছেন বিনয় ঘোষ। কিন্তু তাঁর বয়স বিশ বছরে পৌঁছনোর আগে থেকেই সারা পৃথিবী উত্তাল ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদী তাণ্ডবে। ১৯৩৫-এর ২১ জুন রোমা রঁলা, মাক্সিম গোর্কি ও আঁরি বারবুসের উদ্যোগে বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি ও শিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় প্যারিসে। তার নাম ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব রাইটার্স ফর দ্য ডিফেন্স অব কালচার’। তাতে যোগ দেন অলডাস হাক্সলি, আঁন্দ্রে মালরো, আঁদ্রে জিদ্, ই এম ফর্স্টারদের মতো প্রতিবাদী ও বিবেকবান ব্যক্তিরা। অন্যত্রও তার প্রভাব পড়ে। ১৯৩৫-এ লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রেরা গড়ে তোলেন ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ। তাতে ছিলেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানী ভট্টাচার্য, মুল্‌করাজ আনন্দ, ইকবাল সিংহ, মাসুদ জাফর, রাজা রাও প্রমুখ। ১৯৩৬ সালে ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ঘোষিত হল নতুন এক সং‌গঠন, ‘সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। এর একটি শাখা প্রতিষ্ঠা হল কলকাতায়। ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রগতি লেখক সংঘের কার্যকলাপ মন্থর হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই সালেই কলকাতায় ‘ওয়াইসিআই’ (ইয়ুথ কালচারাল ইনস্টিটিউট) নামে সংগঠিত অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংস্থা কাজ শুরু করে। আলোচনাসভা, বিতর্কসভা, প্রদর্শনী, নাটক ইত্যাদি সৃষ্টিশীল নবচেতনাশ্রিত সম্মেলনের পাশাপাশি গণসংগীতের সূচনা ঘটে এখানেই। এই ওয়াইসিআই থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে জেগে ওঠে আরও কয়েকটি সংগঠন। ‘সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি’ (১৯৪১), ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ (১৯৪২) এবং ‘গণনাট্য সংঘ’ (১৯৪৩) এমন তিনটি সংগঠন একই সঙ্গে প্রতিবাদ ও নবসৃষ্টির কাজে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সঙ্গী: গাজন উৎসবে মানুষের ভিড়ে বিনয় ঘোষ।

এই সব ভাবান্দোলনের কথা উঠল এই কারণে যে, সেই ওয়াইসিআই থেকে আইপিটিএ পর্যন্ত সব ক’টি সংগঠনে বিনয় ঘোষ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিলেন এবং তাঁর জীবনগঠনে ও লেখকতার অভিমুখ নির্মাণে এ সব সমাবেশ ও উদ্দীপনা, বিশেষত এর সঙ্গে জড়িত মানুষগুলির সান্নিধ্য খুবই প্রেরণাদায়ক হয়েছিল। তাঁকে বিশেষ ভাবে প্রেরিত করেন সোমনাথ লাহিড়ি, মুজফ্ফর আহমেদ, হিরণকুমার সান্যাল, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুবোধ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সরোজ দত্ত, চিন্মোহন সেহানবিশ, বিনয় রায়, গোপাল হালদার ও বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এই ভাবান্দোলনের অন্যতম সৃজনমুখর কাজ ছিল কয়েকটি প্রগতিচিন্তার পত্রপত্রিকা প্রকাশ—যেমন ‘অগ্রণী’, ‘অরণি’, ‘পরিচয়’, ‘জনযুদ্ধ’। এর সব ক’টির সঙ্গে বিনয় ঘোষ জড়িত ছিলেন— লেখকরূপে তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রচারে, বিপণনে, সম্পাদনায় ও সমর্থনে। এই সব পত্রিকার সঙ্গে যে-সব ভাবুক ও কর্মী জড়িত ছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ভাবতরঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন, বিতর্ক, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। বিনয় ঘোষ সর্বতোভাবে এ সময়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে, নিজের লেখাকে শাণিত ও তীক্ষ্ণ করতেন। মহাযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, জনযুদ্ধ, কমিউনিজ়ম, সোভিয়েত রাশিয়া ও চিনের রাজনীতি, ইংরেজদের কূট চাল— জাগ্রত প্রসঙ্গ তো সে সময়ে কম ছিল না! দেশ-কাল-সমাজের প্রত্যেকটি সঙ্কট এবং তাতে যথার্থ মানবিকতার ভূমিকা নিয়ে তিনি ভাবতেন ও লিখতেন।

বিনয় ঘোষের লেখালিখি ও রচনাধারায় স্পষ্ট দুটি পর্ব আছে। একটা সময়ে তিনি গণনাট্য সংঘের গঠনমূলক স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে ‘ল্যাবরেটরি’ নামে একটি নাটক লেখেন এবং তা অভিনীত হয়। সংঘের গানের দলেও থাকতেন তিনি। নানা পত্রিকায় তাঁর মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা রচনাগুলি বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে বেগবান ছিল। এ পর্বে লেখা বিনয় ঘোষের কয়েকটি স্পষ্টোচ্চারিত রাজনৈতিক বই বেরোয়, যেমন ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’, ‘সোভিয়েত সভ্যতা’ ১ম ও ২য় খণ্ড, ‘ফ্যাসিজ়ম ও জনযুদ্ধ’, ‘সোভিয়েত সমাজ ও সংস্কৃতি’। তাঁর এ-সব বই এখন বিস্মৃত ও দুর্লভ্য। এর পরের লিখনপর্বে তিনি রাজনৈতিক ঝোঁক থেকে সরে এসে মন দেন নিজের দেশের গ্রাম, নানা জনপদজীবন ও লেখকসংস্কৃতি-কেন্দ্রিক খোঁজাখুঁজির দিকে। সেই সব অন্বেষাজাত গভীর সংবেদী রচনা তাঁকে খ্যাতকীর্তি করেছে। সেই সঙ্গে তাঁর আধুনিক মন খুঁজে ফিরেছে নগরসংস্কৃতির নানা স্তর ও বিভাজন। এ জন্যে তাঁকে বহু গ্রন্থপাঠের নিঃসঙ্গ সাধনায়— বিশেষ ভাবে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও সামাজিক-নৃতত্ত্ব বুঝতে বরাবর সক্রিয় থাকতে হয়েছে। এ সব কাজের স্বীকৃতি ও পারিতোষিকও তিনি অর্জন করেন। এমনকি বিদেশ থেকে নানা আমন্ত্রণ আসে গবেষণার কাজে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত করলেন, আগে দেশটাকে সানুপুঙ্খ জানতে হবে, বুঝতে হবে পরিক্রমা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাকে ভিত্তি করে পরিভ্রমণ শুরু করলেন। ১৯৮৪ সালে বেরোয় তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বইটি। এর পরে প্রধানত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন ‘কালপেঁচা’ ছদ্মনাম নিয়ে অন্য ধারার এক অবলোকন-মূলক জীবনভাষ্য। ক্রমে ক্রমে নিবিষ্ট হতে থাকেন কলকাতা নগরের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার কাজে। তার ফলে ১৯৫৩ সালে বেরোয় ‘কলকাতা কালচার’।

ক্রমশ সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেন গ্রামবাংলার অজানা অনুদ্ঘাটিত পরিসরে অবলোপমুখী অথবা পরিম্লান জীবনযাপনের ও ভগ্ন ইতিহাসের পুরাবৃত্তের সন্ধানে। বিভিন্ন জেলার নানা বিচিত্র জনজাতি, তাঁদের সকুণ্ঠ প্রকাশপিয়াসা, জীবনযাপনের স্বাতন্ত্র্য তিনি দেখে যেতে লাগলেন মাসের পর মাস আর লিখতে থাকলেন পত্রিকার পাতায়। এ জাতীয় স্বদেশ-সন্ধানের ব্রত পালনে তিনি একাই যেতেন, ক্বচিৎ কখনও জুটে যেত এক-দু’জন সঙ্গী। তখন পরিবহণ ব্যবস্থার সহজতা ছিল না, তবে অজানা গ্রামে অচেনা পরিবেশে আতিথেয়তার অভাব ঘটেনি। হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলা দিয়ে তাঁর বঙ্গদর্শনের মুখপাত, যদিও জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির বৈচিত্র উপলব্ধির কাজে তিনি ছিলেন নিরলস। অবশ্য মনে খেদ ছিল, উত্তরবঙ্গটা তেমন করে দেখা হল না। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বইটির জন্য তিনি ১৯৫৯ সালের রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এই বইয়ের খণ্ড ক’টি বাঙালি পাঠকদের এক চিরন্তন শ্রদ্ধেয় সঞ্চয়। ভাবতে ভাল লাগে যে, বিনয় ঘোষের একান্ত ব্যক্তিগত গবেষণার অভিমুখ সর্বদাই সচেষ্ট থাকত এই বঙ্গভূমির শ্যামল কোমল মর্মোদ্ঘাটনে। দেশাত্মবোধ ছিল তাঁর রক্তমজ্জায়। তাই একা, নির্জন সংকল্পে তাঁর কাজে তিনি অবিচল ছিলেন। কাঞ্চন-কৌলীন্যের স্বপ্ন দেখেননি।

আনন্দের কথা, সমকাল তাঁকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। যেমন জানা যাচ্ছে, ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অঙ্গরূপে কর্তৃপক্ষ ‘বিদ্যাসাগর বক্তৃতামালা’র ব্যবস্থা করে।

সেই প্রথম বক্তৃতামালার বক্তা হিসাবে বিনয় ঘোষ আহূত হন। মোট ছ’টি লিখিত ভাষণ দেন তিনি। যেগুলি নিয়ে ১৯৫৭ সালে বেরোয় ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ বই, দুই খণ্ডে। তাঁর চেতনার মধ্যে ছিল আত্মব্রতের একাগ্র সাধনা। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বা জলপানির তোয়াক্কা করতেন না। তাই স্বেচ্ছাবৃত দায়িত্ব নিয়ে নবম ও দশম শ্রেণির বিদ্যার্থীদের জন্য ১৯৫৮-য় লেখেন ‘সমাজবিদ্যা’ দু’খণ্ডে। এর পরে ১৯৫৮-১৯৬০ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রকফেলার রিসার্চ ফেলো হয়ে গবেষণা করেন তাঁর প্রিয় শহর কলকাতার সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে। কলকাতা সম্পর্কে তথা নাগরিক সংস্কৃতি বিষয়ে বিনয় ঘোষের ভাষ্যরচনা বহুমাত্রিক। কখনও তা নিরবচ্ছিন্ন তথ্যে আকীর্ণ, কখনও লঘু পরিহাসে ও তির্যক অবলোকনে দ্বন্দ্বমধুর। ‘কলকাতা কালচার’ (১৯৫৩), ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ (১৯৬১), ‘মেট্রোপলিটন মন : মধ্যবিত্ত : বিদ্রোহ’ (১৯৭৩), ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (১৯৭৫) জাতীয় সিরিয়াস গদ্য রচনার পাশে উনিশ শতকীয় হুতোমী ঢঙে কালপেঁচার কলমে লেখা গদ্যের যেমন কোনও মিল নেই, তেমনই দু’ধরনের রচনাশৈলীর দেখা ও দেখানোর ভঙ্গিটিও আলাদা। এখানে দুটি ধারার দুটি নমুনা দেখা যাক।

১৯৬৭ সালে ‘মেট্রোপলিটন মন’ নিবন্ধে তিনি নির্বিকার ঔদাসীন্যে ভরা পরিহাসে লেখেন: ‘কেবল রমণ করেছে এবং খবরের কাগজ পড়েছে এমন একটি জীব হল আধুনিক মানুষ। ... দুটোই যান্ত্রিক অভ্যাস, কোনটাতেই প্রাণ নেই মন নেই। যেমন রমণের ধরন, তেমনই খবরের কাগজের পড়ন। ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক সমাজে এই হল মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি।’ এমন অবলোকনে চটকদারি নেই, আছে গভীর সন্তাপ। এর পাশে ১৯৫১ সালে লেখা ‘কালপেঁচার নকশা’ থেকে পড়ে নেব:

‘কলকাতার আসল বায়োস্কোপ দেখুন।… প্রথমে দেখুন লাট সাহেবের বাড়ি। তারপর মনুমেন্ট দেখুন, গড়ের মাঠ দেখুন, জাদুঘর দেখুন, বাসে-ট্রামে নানা রকম লোক দেখুন, রঙবাহারে সব দোকান বাজার দেখুন, দেখতে দেখতে চলে যান কালীঘাট পর্যন্ত। কালীঘাটের কালী দেখুন, কলিকালের গঙ্গা দেখুন, তারপর চিড়িয়াখানার বিচিত্র সব জন্তু-জানোয়ার দেখুন। জিরাফ দেখুন, উট দেখুন, হাতী দেখুন, গণ্ডার দেখুন, বাঘ দেখুন, ভাল্লুক দেখুন, উল্লুক দেখুন, বাঁদর দেখুন, শিম্পাঞ্জী দেখুন, গোরিলা দেখুন, বনমানুষ আর বনবিড়াল দেখুন। এরই নাম চিড়িয়াখানা, দ্বিতীয় নাম কলকাতা। অর্থাৎ যার ডাকনাম ‘ক্যাবলা’ তার ভাল নাম ‘পরমেশ্বর’, তেমনি যার ডাকনাম ‘চিড়িয়াখানা’, তারই ভালনাম ‘কলকাতা’।’

অন্তঃসারশূন্য দেখনদারিতে ভরা একটা শহরের চরিত্র বোঝাতে এতখানি খরসান কলম আগে আমরা দেখিনি। শেষমেশ বিনয় ঘোষ বলেন যে, ‘কলকাতা কালচারের মূল কথা হল ‘‘হুজুক’’ আর ‘‘বুজরুকি’’।’ কালপেঁচা বলে, ‘ওই হুজুক আর বুজরুকিটাই কলকাতার বনেদী কালচার।’ অথচ এও আশ্চর্য, সেই কালচারের মধ্যেই আদ্যন্ত বহাল থেকেও তিনি ব্যতিক্রমী।

সেই জন্য বিনয় ঘোষের মতো ব্যক্তিত্ব ও রচনাকারের বিচারে বেশ সতর্কতা দরকার। একসঙ্গে তত্ত্বগর্ভ নিবন্ধ-রচনা, সরেজমিন অনুসন্ধান, পুঁথিপত্তরদলিল জাতীয় উপাদানের ব্যবহার-দক্ষতা, নষ্টকোটির উদ্ঘাটন, বিদেশি সমাজতাত্ত্বিকদের ভাষ্যকে যাচাই করার প্রবণতা ও আন্তরিক দরদে গ্রামীণ জনপদকে ভালবাসা— এই এতগুলি কর্তব্যবুদ্ধি তাঁর কালে বা পরে আর কারও মধ্যে দেখি না। প্রয়োজনে তাঁর অচেনা গ্রামিক অন্বেষণে প্রবীণ পঞ্চানন রায় বা মানিকলাল সিংহের মতো স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গ ও সাহচর্য যেমন নিতে কুণ্ঠিত হননি, তেমনই নবীনতর উৎসুক প্রবোধচন্দ্র ভৌমিক বা প্রমোদ মুখোপাধ্যায়কে অভিযানে সঙ্গে নিয়ে— তাঁদের নির্দেশ ও সঠিক আদর্শের দিশা দেখিয়েছেন। তাঁর সহিষ্ণুতা, মনোবল, শারীরিক ক্লেশ সহনের ক্ষমতা পদে পদে লক্ষ করেছেন সহসন্ধানীরা। প্রমোদ মুখোপাধ্যায়ের জবানিতে পাই: ‘কালপেঁচার বঙ্গদর্শন আমরা কী ভাবে করতাম জানো— সাইকেলে আর হেঁটে। এমনকী আরামবাগ গেছি মোষের পিঠে কানা দামোদর পার হয়ে। কোনো রাস্তাটাস্তা কিস্যু ছিল না। একদিনে পঁচিশ তিরিশ মাইল পর্যন্ত হাঁটতাম।... বিনয় ঘোষের ভাল দিকটা হচ্ছে, ভেরিফাই না করে কোনো শোনা কথা বা বানানো কথা লিখতেন না।’ তাঁর গবেষণা-সহায়ক মোহিত রায় নদিয়া জেলার নানা জনপদে সঙ্গী ছিলেন। তাঁর জবানিতে জানা যায়: ‘একদিন কৃষ্ণনগরে আমাকে নিয়ে গেলেন নদিয়া কালেক্টরির রেকর্ড রুম-এ। এই রেকর্ড রুমই নদিয়ার অভিলেখ্যাগার। এখানেই অবিন্যস্তভাবে আছে নদিয়ার ইতিহাসের মূল্যবান আকর বহু কাগজপত্র। কীভাবে এগুলি দেখতে হয়, নোট নিতে হয় তা হাতেকলমে বুঝিয়ে শিখিয়ে দিলেন।... গোটা নদিয়া জেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করলেন। এক একটি এলাকায় ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন, অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।... বিস্তৃত এলাকার পুরাকীর্তি, লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিদ্যাসমাজ, মেলা ও উৎসব প্রভৃতির সরেজমিন ক্ষেত্র অনুসন্ধান। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি নির্দেশ দিতেন— পরদিন কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে— কী দেখতে হবে ও কী ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমরা খুব ভোরে বের হতাম, সারাদিন ঘুরে ঘুরে তথ্যাদি সংগ্রহ করতাম। রাতে সারাদিনের লেখা নোটস নিয়ে আলোচনা করতেন। আবার পরদিনের কাজের নির্দেশ দিতেন। এই ভাবে চলত কাজ। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তাঁর কোনও ক্লান্তি বা অবসাদ ছিল না। হাঁটতেও পারতেন নিরলস ভাবে।’

বিনয় ঘোষ নিছক পরিভ্রমণশীল ছিলেন, তা নয়। বিশেষ ভাবে পরিকল্পিত তাঁর কার্যক্রম থেকে জেনে নিতেন সমাজ পরিবর্তনের ও শ্রেণিবিন্যাস-ঘটিত রূপান্তরের রূপরেখা। যেমন একজন সহায়ককে বুঝিয়ে দেন ব্যাখ্যা করে যে, ‘আদি জনগোষ্ঠীর লৌকিক দেবদেবী বৌদ্ধ রূপের মধ্য দিয়ে কী ভাবে ব্রাহ্মণীকৃত হয়েছে, কী ভাবে পুরুষানুক্রমিক পেশা ও জীবিকা থেকে বিত্তবানদের অত্যাচারে উৎখাত হয়ে এক শ্রেণির মানুষ (কৃষক ও কৃষিমজুরদের একাংশ) তথাকথিত ডাকাত বলে আখ্যাত হয়েছিল আর কীভাবে তারা কৃষকদের, গরিবদের সংগঠিত করেছিল বাঁচার প্রয়োজনে।’

এ থেকে বোঝা যায় তাঁর লেখনীচর্চা শুধু পত্রপত্রিকার চাহিদা পূরণ নয়, তাঁর নিজের আত্মবোধের দায়, সত্যভাষণের তাগিদ।

তাঁকে চাক্ষুষ দেখার ভাগ্য আমার ঘটেছে, কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে বারবার তাঁর লেখা বই পঠনে উৎসাহী থেকেছি। পড়তে পড়তে অভিভূত হয়ে ভেবেছি— কত বিপুল তাঁর জানার প্রবণতা, কত নানাচারী তাঁর পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি এবং জীবন ও সমকালীন ঊর্ধ্বাধঃ সমাজ বিশ্লেষণে তাঁর উৎসাহ! তেষট্টি বছরের সীমায়ত জীবৎকালে, টলমলে জীবিকাযাপন সামলে, সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব পালন করে এবং তাৎক্ষণিক সাংবাদিকতার চঞ্চল চাহিদা মিটিয়ে বিনয় ঘোষ বাংলা ও ইংরেজিতে ৩৮খানি মৌলিক বই লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন ৫টি বই। তার মধ্যে সবচেয়ে সংরক্ষণযোগ্য দুটি সম্পাদনা ও সংকলনের কাজ হল ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’। এই সংকলনে তিনি যে সব উনিশ শতকীয় পত্রপত্রিকা তন্নতন্ন করে ঘেঁটে সে কালের সমাজচিত্র উপস্থাপন করেছেন, সেগুলির নাম: সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বেঙ্গল স্পেকটেটর, বিদ্যাদর্শন, সংবাদ ভাস্কর, সর্বশুভকরী, সোমপ্রকাশ, তত্ত্ববোধিনী। এর পাশে যে কাজটি তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে, তার নাম: ‘Selections from English Periodicals of 19th Century Bengal’। এখানেও তাঁর সঞ্চয়নক্ষেত্র সেই উনিশ শতকের বাংলার পত্র-পত্রিকা। যথা: Calcutta Monthly Journal, John Bull, India Gazette, Bengal Harkara, Reformer, Friend of India, Hindu Intelligences, Hindu Patriot।

অবশ্য সর্বাঙ্গীণ বিচারে যেমন বিনয় ঘোষের সংবাদিক সত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর সরেজমিন গবেষণা-জাত কাজগুলি, তেমনই বারবার পড়ে মুগ্ধ হতে হয় তাঁর গ্রামজীবী বঙ্গজীবনের শিল্পকলা, উৎসব, পরব, মেলা, ব্রত, লোকসংস্কৃতি, চণ্ডীমণ্ডপ, পটুয়া ও পটশিল্প, ঢোকরা শিল্পীসমাজ, মৃৎশিল্প ও গ্রামগঠনের কাঠামো বিষয়ে অনুচিকীর্ষা দেখে। নগর ও গ্রামের স্পষ্ট পরিধি ও বৈপরীত্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, শাহরিক সংস্কৃতি ও অটোমেটিক যাপনরীতি, ক্রমক্ষীয়মাণ লোকশিল্প, জনসংস্কৃতির স্ববিরোধ— এত সব বিচিত্র ও বিভাজিত প্রসঙ্গে স্বচ্ছন্দ পদাতিক ও গর্বিত বাঙালি বিনয় ঘোষকে আমরা যদি মনে না রাখি তবে তাঁর স্নেহার্দ্র নম্র সৃজনশীল ভাবাবেগকে হালফিল জীবনের সঙ্গে আমরা অঙ্গীভূত করব কী করে?

ছবি সৌজন্য: কৌশিক চট্টোপাধ্যায়।
কৃতজ্ঞতা: শিবনাথ ভদ্র, রামকৃষ্ণ দে, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, স্বদেশ রায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Binoy Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE