Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ওরা থাকে ও ধারে

প্রাণভয়ে বাংলাদেশে, তার পর ভারতে ঠাঁই। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের এই মুহূর্তে নিজের দেশ বলতে কিছু নেই। দীক্ষা ভুঁইয়াপ্রাণভয়ে বাংলাদেশে, তার পর ভারতে ঠাঁই। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের এই মুহূর্তে নিজের দেশ বলতে কিছু নেই। দীক্ষা ভুঁইয়া

ঘরছাড়া: ভারতের ‘হোম’-এ রোহিঙ্গা মহিলারা

ঘরছাড়া: ভারতের ‘হোম’-এ রোহিঙ্গা মহিলারা

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:০০
Share: Save:

হোমের ভিতরে পাঁচটা বছর ধরে এক বোনকে নিয়ে আটকে আছেন বছর কুড়ির নুরজাহান (নাম পরিবর্তিত)। প্রাণ ভয়ে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসার সময়ে চাচাতো ভাই আর বোনেরা কোথায় যেন ছিটকে গেল। এক বোনকে নিয়ে সোজা পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, চুরি-ডাকাতি করেননি, খুন বা কোনও অপরাধ তো করেননি। পুলিশকে গিয়ে বললে তারা মায়া দেখাবে একটু। তা না করে এই হোমে এনে ফেলল পুলিশ। কিন্তু নুরজাহান হাল ছাড়েননি। রোজ চিৎকার-চেঁচামেচি করে গিয়েছেন। ফল মিলছে। পাঁচ বছর পর, মাসখানেক আগে হোম থেকে বলল, ‘মুক্তি’ মিলবে।

শুধু তিনি নন। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গা মহিলারা জানেনই না যে গত ক’ দিনের মধ্যেই এ দেশের সরকার তাঁদের অন্য এক নির্দেশ দিয়েছে।

ভারত সরকার গত ৮ অগস্ট ওঁদের জন্য এক নির্দেশিকা জারি করেছেন। যাতে বলা হয়েছে, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এমনকী ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) থেকে রিফিউজি কার্ড পাওয়া রোহিঙ্গারাও আর এ দেশে থাকতে পারবেন না।

কিন্তু ওঁরা তো নিজের দেশে ফেরত যেতে চান না। এখন দেশে ফেরা মানেই সেনাবাহিনীর গুলি খাওয়া। অথচ তা জেনেও এ দেশের সরকার তাঁদের সেখানেই পাঠাতে চাইছে। কেন? তাঁদের কী বাঁচার অধিকার নেই?

এই ‘তা হলে’-র উত্তরে অগস্টের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা থাকলে এ দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আর তাই ভারতে বসবাসকারী সব রোহিঙ্গা মুসলিমকে (বর্তমানে সংখ্যাটি ৪০ হাজার) ফেরত পাঠানো হবে। ইউএনএইচসিআর ‘উদ্বাস্তু’ হিসাবে তকমা দেওয়া ১৬,৫০০ রোহিঙ্গাও ভারতে বসবাস করতে পারবেন না। ইউএনএইচসিআর স্বীকৃতি দিতে পারে, কিন্তু ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের রিফিউজি সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করেনি। তাই তাদের দেওয়া এই স্বীকৃতি মানতে বাধ্য নয় ভারত সরকার।

কিন্তু এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলি কোন নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে? এ উত্তর দেশের সরকারে থাকা লোকজনই জানেন। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস-এর দাবি, কোনও দেশ রিফিউজি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপু়্ঞ্জের চুক্তিতে সই করুক বা না করুক, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে লঙ্ঘন করে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না।

কিন্তু এত কিছু কি বোঝেন হোমের ভিতরে কিংবা এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা রোহিঙ্গারা? বোঝেন না। তাই এ রাজ্যের হোমের ভিতরে থাকা আরুফা, নুরজাহান কিংবা সালমারা বছরের পর বছর ধরে সন্তানদের মুখ চেয়ে অপেক্ষা করে আছেন, কবে ছাড়া পেয়ে বিভিন্ন প্রান্তে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা আত্মীয়দের কাছে পৌঁছতে পারবেন। আর তাই তো প্রাণে বাঁচতে ছয় মেয়ে আর দেড় বছরের ছেলে কোলে স্বামীর হাত ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন আরুফা। দেড় বছরের উপর এ দেশে থাকলেও আরুফার কথা পুরোপুরি বাংলা নয়। বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হলেও তাঁর কথায়, ‘‘জন্ম থেকেই দেখতাম কেউ না কেউ খুন হচ্ছে বা বাড়ি লুঠ করে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে সরকারি লোকজন। ওরা বলে, আমরা নাকি ওখানকার লোকই নয়। ভয়ে স্বামী আর ছেলেমেয়ের হাত ধরে কোনও রকমে নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকি। সেখানে এক মহিলাকে টাকা দিলে সে ঠিক করে দেয় এ দেশে আসার। কিন্তু এ দেশে ঢোকামাত্র আমাদের ধরে নিয়ে আলাদা করে দেয়। বোন থাকে দিল্লিতে। সেখানে যাব বলে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন কবে যে বেরোব, তা-ই জানি না।’’

রোহিঙ্গাদের এই আর্তি কে শুনবে? না শুনেছে মায়ানমার সরকার, না বাংলাদেশ সরকার। এখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের চাইছে না ভারত সরকারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE