Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Job Description

পদ্মার চরে গরু, বেঁধে থানায় নিয়ে এল পুলিশ

সেই নিয়ে গন্ডগোল। কখনও দুই বাড়ির মাঝখানে থাকা সজনে গাছ নিয়ে কাজিয়া। এর মুরগি ডিম পেড়ে আসছে ওর বাড়িতে, সেই ঝামেলা মেটাও। পুলিশের চাকরির ঝক্কি বিস্তর।সেই নিয়ে গন্ডগোল। কখনও দুই বাড়ির মাঝখানে থাকা সজনে গাছ নিয়ে কাজিয়া। এর মুরগি ডিম পেড়ে আসছে ওর বাড়িতে, সেই ঝামেলা মেটাও। পুলিশের চাকরির ঝক্কি বিস্তর।

গৌরব বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ১৯:২৭
Share: Save:

পেটি’ই বলুন আর ‘পাতি’— কেস কেসই। একটু এ দিক-ও দিক হলেই ঝামেলায় পড়তে পারে খোদ পুলিশই। ফলে, তুচ্ছ জেনেও তাচ্ছিল্য করার জো নেই।

বেলা এগারোটা। নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা এক থানায় বেশ ভিড়। মাঝবয়সি এক মহিলা ভিড় ঠেলে সটান হাজির ডিউটি অফিসারের কাছে, ‘‘স্যর, আমি ওর ভাত খাব না। আপনি কেস করুন!’’

কর্তব্যরত সেই পুলিশ আধিকারিক থানায় এসেছেন সবে কিছু দিন হল। ‘ভাত খাওয়া’ কেসে তিনি তখনও দড় হননি। বেশ অবাক হয়েই বলেছিলেন, ‘‘সে কী! ভাত না খেলে, রুটি, মুড়ি— এ সব খেলেই হয়! খাওয়ার জিনিসের কি আর অভাব আছে!’’

মুখ ভেংচে ওই মহিলা বলেন, ‘‘আ মলো যা! ভাত-রুটি আমি অন্যের কাছে গিয়েও খেতে পারি। আমি বলছি, সোয়ামির ভাত খাব না। ওর সঙ্গে থাকবও না।’’ পরে বিষয়টি বুঝে আদালতে গিয়ে ডিভোর্সের মামলা করার পরামর্শ দেন ওই পুলিশ আধিকারিক।

কিন্তু উচ্চ আদালত হোক বা নিম্ন, বাঙালিকে কোর্ট দেখানোর সমূহ বিপদ রয়েছে। সে যাত্রা একটি জেনারেল ডায়রি নিতেই হয়েছিল সেই পুলিশকর্তাকে। পরে সেই মহিলা কোর্টে গিয়েছিলেন না কি অন্য কোথাও গিয়ে ভাত খেয়েছিলেন, তা অবশ্য আর জানা যায়নি।

কয়েক বছর আগে চন্দনাকে নিয়ে জোয়ারদারেরা তো বটেই, বিপাকে পড়েছিল হোগলবেড়িয়া থানার পুলিশও। চন্দনা থাকত কাছারিপাড়ায় পদ্মার একেবারে কোল ঘেঁষা জোয়ারদারদের বাড়িতে। সব ঠিকঠাকই ছিল। গোল বাধল এক রাতে। চকচকে চাঁদ দেখে চন্দনারও মনটা চনমন করে উঠেছিল নাকি নিশিতে ডেকেছিল, কে জানে! বেমক্কা নেমে গিয়েছিল পদ্মার চরে।

ও দিকে নাইট ভিশন ক্যামেরায় চোখ রেখে টানটান বসেছিলেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক জওয়ান। দূরে চন্দনাকে দেখে লেন্স জ়ুম করলেন। নাহ্, কোনও ভুল নয়। ওটা তো গরুই! গরু যখন, তখন পাচারকারীও আছে আশপাশে। বার্তা গেল এক ওয়াকি-টকি থেকে অন্য ওয়াকি-টকিতে। চুপিসারে জনা কয়েক জওয়ান গিয়ে ধরে ফেলল চন্দনাকে। পাচারকারীর অবশ্য দেখা মিলল না। চন্দনাকে নিয়ে আসা হল বিএসএফ ক্যাম্পে। সরকারি খাতায় লেখা হল— পাচারের গরু।

এ দিকে সাতসকালে জোয়ারদার বাড়িতে জোর চেঁচামেচি। দড়িটাই পড়ে আছে। চন্দনা শুধু নেই। জোয়ারদার গিন্নি কাঁদতে শুরু করলেন, ‘‘ওগো আমার চন্দনাকে কে নিয়ে পালাল? নাতিটা এ বার দুধ পাবে কোথায়!’’ কে এসে খবর দিল, ক্যাম্পে একটা গরু বাঁধা আছে। পড়িমড়ি ছুটলেন জোয়ারদারেরা। ক্যাম্পে তখন চন্দনা বেজার মুখে শুকনো খড় চিবোচ্ছিল। বাড়ির লোকজনকে দেখে খড় থেকে মুখ তুলে ডেকে উঠল— ‘হাম্বা’। জোয়ারদার পরিবারের এক জন বললেন, ‘‘ও সাহেব, ও তো আমাদের চন্দনা। নিশি কা ডাক মে কোনও ভাবে হয়তো ও বাইরে আয়া হ্যায়।’’

কিন্তু এখন তো আর হায় হায় করলে হবে না। নিয়ম নিয়মই। চন্দনাকে তুলে দেওয়া হল পুলিশের হাতে। ঠাঁই হল হোগলবেড়িয়া থানায়। কিন্তু গরুর জন্য তো আর হাজত নেই। থানার সামনে বেঁধে রাখা হল তাকে। ব্যবস্থা করা হল রাখালের, খাবারের। মামলা গেল আদালতে। সেই সময় এক পুলিশকর্মী বলেছিলেন, ‘‘কপালে এ-ও ছিল! থানা না গোয়াল, কোথায় যে ডিউটি করছি নিজেই বুঝতে পারছি না।’’

জোয়ারদারেরাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তাঁরাও উকিল ধরলেন। জোয়ারদার গিন্নির অনুরোধে গয়লাকে ছুটতে হল থানায়। বাড়ির খুদেটি যে চন্দনা ছাড়া অন্য কারও দুধ খায় না। পুলিশও সতর্ক। তাদের হেফাজতে থাকাকালীন চন্দনার কোনও বিপদ হলে চলবে না। শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ পেয়ে জোয়ারদারের জিম্মায় চন্দনাকে রাখার নিদান দিল আদালত। চন্দনাকে বিদায় জানিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল পুলিশও। তার গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জোয়ারদার বাড়ির এক সদস্য বলছিলেন, ‘‘অমন চাঁদ তো চন্দনা কত্ত দেখেছে। কিন্তু সেই পূর্ণিমায় ওকে কোন ভূতে ধরেছিল, কে জানে! এখন মনে হয়, চন্দনাটা বড্ড বোকা!’’

মুর্শিদাবাদের রানিনগর থানার পুলিশ আবার আর এক বিপাকে পড়েছিল। দু’টো বাড়ির মাঝখানে একটা সজনে গাছ। সেই গাছের ডাঁটা কোন বাড়ির লোক খাবে তা নিয়ে বিবাদ, মারপিট এবং যথারীতি থানা-পুলিশ। ধরা পড়ার ভয়ে পলাতক দুই পরিবারের লোকজন। এক পক্ষের অভিযোগ, বাড়ি ঢুকলেই তাঁদের খুন করে দেবে। সেই ভয়েই তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অভিযোগ অস্বীকার করে অন্য পক্ষের পাল্টা দাবি, ওঁরাই তো পুলিশের কাছে ‘কেস’ করে বসে আছে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘সামান্য ক’টা সজনে ডাঁটা নিয়ে আমরাও কম বিব্রত হইনি মশাই। সে ডাঁটাও চোখে চোখে রাখতে হয়েছিল আমাদেরই।’’ নিরীহ ডাঁটারও যে এমন ঝাঁঝ থাকতে পারে, কে জানত! এ দিকে দুই বাড়ির জমির মাঝখানে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে সেই সজনে গাছ। কালবৈশাখীর ঝড় সামলে ডাঁটাগুলি এখনও রয়েছে বহাল তবিয়তে।

ডোমকলে আবার এক বাড়ির মুরগি ডিম পেড়ে আসত পাশের বাড়িতে। তা হলে সেই ডিমের মালিক কে? মুরগির মালিক বললেন, ‘‘মুরগি তো আমার। তাই ডিমের দখলও আমি নেব।’’ আর যাঁর বাড়িতে মুরগি নির্লজ্জ ভাবে ডিম পেড়ে আসছে, সেই বাড়ির মালিক বললেন, ‘‘ডিম তো পাড়ছে আমার জায়গায়। ও ডিম আমার।’’ হাজার শাসন করেও বেয়াড়া মুরগিকে বাগে আনা যায় না। শেষ তক বচসা, মারামারি এবং জোড়া খুন! বছর কয়েক আগে ডিম আর মুরগির চক্করে খুনের জেরে বেশ কয়েক বছর আগে তেতে উঠেছিল তামাম এলাকা। গ্রেফতার, আদালত, জেল— সবই হয়েছিল। কিন্তু সেই মুরগির কী হয়েছিল, তা আর জানা যায়নি। মুরগি আগে নাকি ডিম? এ বিতর্ক বহু দিনের। কিন্তু ডোমকল জানে, মুরগি কেসের দৌড় বেশ লম্বা।

গাঁ-গঞ্জে পুলিশ আসলে সুপারম্যানের মতো। আলপিন থেকে আলাস্কা— সমস্ত কিছু দেখতে হয় তাঁদের। পান থেকে চুন খসলেই সেখানে হইহই কাণ্ড! তাই বলে পুলিশকে নিজের কাছে হেরোইন কিংবা ‘পাতা’ও রাখতে হবে? মুচকি হাসছেন নদিয়ার এক ওসি, ‘‘আপনারা শুধু ‘অধরা, অধরা’ লিখে যান। কিন্তু ওই সব মূর্তিমানদের ধরেও যে কী বিপদে পড়তে হয়, সে শুধু আমরাই জানি। রাতদুপুরে নেশার জিনিস না পেয়ে যা কাণ্ড শুরু করে! ফলে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু একটু দিতেই হয়। আদালতে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কোনও ঝক্কি নেই। না হলে পুলিশ হেফাজতে কোনও অঘটন ঘটে গেলে একটু-আধটু নয়, পুরো ঝামেলায় ফেঁসে যেতে হবে পুলিশকেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Job Description police risk
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE