Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ট্রা‘ভেলকি’

বেড়াতে গিয়ে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। তাই নিয়ে পাঠক-পাঠিকা চিঠি পাঠালেন। নির্বাচিতগুলো সাজিয়ে দেওয়া হল।বছর কয়েক আগে বন্ধুরা মিলে অন্নপূর্ণা বেস-ক্যাম্প ট্রেক করতে গিয়েছি। টোলকা থেকে প্রায় তিন হাজার সিঁড়ি উতরাই ভেঙে তার পর সমতলে তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে আবার তিন হাজার সিঁড়ি চড়াই পেরিয়ে লান্ডুক পৌঁছতে হয়। লান্ডুক পৌঁছে দেখা মিলল এক আইরিশ দম্পতির। প্রায় ছ’হাজার ফুট উচ্চতায় জনমানবহীন পাহাড়ে ভদ্রমহিলা তাঁর সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কোনও ডাক্তার-নার্স ছাড়াই ওই রকম একটি নির্জন স্থানে তিনি মা হয়েছেন।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

* বছর কয়েক আগে বন্ধুরা মিলে অন্নপূর্ণা বেস-ক্যাম্প ট্রেক করতে গিয়েছি। টোলকা থেকে প্রায় তিন হাজার সিঁড়ি উতরাই ভেঙে তার পর সমতলে তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে আবার তিন হাজার সিঁড়ি চড়াই পেরিয়ে লান্ডুক পৌঁছতে হয়। লান্ডুক পৌঁছে দেখা মিলল এক আইরিশ দম্পতির। প্রায় ছ’হাজার ফুট উচ্চতায় জনমানবহীন পাহাড়ে ভদ্রমহিলা তাঁর সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কোনও ডাক্তার-নার্স ছাড়াই ওই রকম একটি নির্জন স্থানে তিনি মা হয়েছেন। সদ্য-মা তাঁর বাচ্চাটিকে পরিষ্কার করছেন, তখন আলাপ করলাম ভদ্রলোকটির সঙ্গে। বললেন, তাঁরা তাদের বাচ্চাটিকে এ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। আমি শুধু ভাবছিলাম ভদ্রমহিলার মনের জোরের কথা আর বারে বারে তাকাচ্ছিলাম ফেলে আসা কষ্টকর রাস্তার দিকে।

দেবাশিস চন্দ, কলকাতা-৪৯

* গ্যাংটক। দু’পাশের দোকানে চোখ-ধাঁধানো পসরা। একটা দোকানে বাহারি প্রিন্টের ‘থ্রি-ফোল্ড’ ছাতা ঝুলছিল। ঢুকে পড়লাম। ঠিকমত খুলছে কি না দেখতে গিয়ে একটা ছাতার হ্যান্ডেল হঠাৎই খুলে চলে এল আমার হাতে। সঙ্গীরা তখন নানা দোকানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কেনাকাটিতে ব্যস্ত। একা মহিলা টুরিস্টকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে ষন্ডা দোকানদার বেশ উঁচু গলায় জেদাজেদি শুরু করল— ওই ভাঙা ছাতাই পুরো দাম দিয়ে কিনতে হবে। তর্কাতর্কি যখন চরমে, আমার বন্ধুরা দোকানে ঢুকে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে?’ দোকানি রাগে অগ্নিশর্মা। চেঁচাতে-চেঁচাতে বলল, ‘গায়ের জোর দেখাতে গিয়ে নতুন ছাতাটা এই দিদি ভেঙে ফেললেন। ছাতা খোলারও তো একটা ‘তরিকা’ আছে!’ আমি বললাম, ‘হ্যান্ডেলটা নিশ্চয়ই লুজ ছিল।’ আমাকে ভেংচে দোকানি বলল, ‘লুজ ছিল? ছাতা কী করে খুলতে হয় জানেন?’ তার পর অন্য একটা ছাতা নিয়ে খুলে দেখাতে গিয়েই ‘কট’ করে একটা শব্দ। সেই ছাতার হ্যান্ডেলটাও খুলে এসেছে তার হাতে!

সাধনা রায়, শ্যামবাজার

* বৃন্দাবন। হাজির হলাম ভজন আশ্রমে, যেখানে প্রায় দু’হাজার অনাথ মহিলা সব সময় ‘রাধা’ নাম জপ করে চলেছেন। গাইড শর্মাজি বললেন, ‘এখানকার শতকরা আশি ভাগ মহিলা অনাথ, তাদের কেউ নেই। কিন্তু বাকি কুড়ি ভাগের সবাই আছে, তবু তারা অনাথ। হয়তো স্বামীই স্ত্রীকে এখানে ছেড়ে দিয়ে গেছে।’ শুনে বিষণ্ণ মনে হাঁটছি, হঠাৎই এক বয়স্ক মহিলা ‘বাবা খোকন, তুই এখানে!’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। দেখি, কয়েক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমাদের পাড়ার রাধুমাসি। মাসির ছেলের কথা শুনে এক বৈষ্ণব নাকি মাসিকে এখানে ছেড়ে দিয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘তোমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না?’ ‘প্রথম প্রথম খুব করত, কিন্তু যখন জানতে পারলাম, যে ছেলেকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি, মানুষ করেছি, সে-ই আমাকে চায় না, তখন আর...’

হেমন্ত রায় বাগনান, হাওড়া

* পূর্ব সিকিমের ‘সিল্ক রুট’ যাত্রার প্রথম দিনে পৌঁছলাম ‘লিঙটাম’। একাই বেরিয়ে পড়লাম সান্ধ্যভ্রমণে। মাইলটাক হাঁটার পর একটি গুমটি দোকানে কথা বলে বুঝলাম, এই অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা বিপজ্জনক। দিন দুয়েক আগেই নাকি খাদে পড়ে গিয়ে স্থানীয় এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। বরং সামনের বাঁকেই যে বৌদ্ধ গুম্ফা আছে, সেটা দেখে ফিরে যাওয়াই ভাল। কিছুটা এগিয়ে কাঠের তৈরি দোতলা ছোট্ট গুম্ফাটি পেয়ে গেলাম। উপর থেকে স্তোত্রপাঠের শব্দ ভেসে আসছিল। একতলায় এক বৃদ্ধকে সিঁড়ির পাশে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম উপরে যেতে পারি কি না। কোনও সাড়া না পেয়ে লক্ষ করলাম উনি ধ্যানমগ্ন। উপরে দেখলাম, উপাসনাগৃহে, বহু মানুষ স্তোত্রপাঠ করছেন। অনেকে স্থানাভাবে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন। প্রাথমিক আশ্চর্য ভাবটা কাটতে ওঁরা আমাকে সসম্মানে বসতে দিলেন। সকলের মতো আমাকেও গরম চা ও দুটি দশ টাকার নোট দিলেন। আমিও চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্তোত্রে গলা মেলালাম। মনটা ভাল হয়ে গেল। ফেরার পথে গুমটির মালিককে ধন্যবাদ জানালাম। সব শুনে উনি আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। তার পর বললেন, আমি উপাসনা ভেবে যাতে যোগ দিয়েছিলাম, আসলে সেটি ছিল এক বিশেষ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। দুদিন আগে যে বৃদ্ধের অপমৃত্যু হয়, তারই দেহশুদ্ধিকরণ চলছিল। আমি যখন হলফ করে বললাম, কোনও মৃতদেহ চোখে পড়েনি, উনি জানালেন, ‘মরদেহটি’ একতলার সিঁড়ির কাছে বসানো ছিল!

রজত দে, বেলুড় মঠ

* আজ থেকে চোদ্দো-পনেরো বছর আগে। গ্যাংটকের হোটেলে জানলাগুলো ছিল গরাদবিহীন, খোলা। আমরা ছিলাম চারতলার একটা ঘরে। দাদা ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে উঠে বাবাকে ডাকল, ছাদে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে। বাবা বলল, আবার ছাদে যাবি কেন, ঘরের জানলা খুলেই দেখ। বলে বাবা ঘুমিয়ে পড়ল। দাদা ছোট ছেলে, খুবই রোগা-পাতলা, কিছুতেই জানলার ছিটকিনি খুলছে না দেখে বিছানায় উঠে ঝুঁকে পড়ে দু’হাত দিয়ে জোরে ছিটকিনি টানতেই, জানলা বাইরের দিকে ঝুপ করে খুলে গেল, আর দাদা ব্যালান্স হারিয়ে সোজা হাওয়ায় নীচে... মা ছিটকিনি খোলার হঠাৎ শব্দে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখেন, পা দুটো বেরিয়ে যাচ্ছে! বাবা পড়িমরি করে নীচে ছুটে গিয়ে দেখেন, বিশাল একটা টিনের চাকতির ওপর পড়ে আছে ছোট দেহটা। পাশেই একটা হোটেল হচ্ছিল, তার জন্য গর্ত খোঁড়া হয়েছিল, সেই গর্ত ঢাকা দেওয়া ছিল ওই টিন দিয়ে। দাদার পড়ে থাকা দেহটার ঠিক পাশেই একটা বড় পাথরের চাঁই। দাদাকে স্থানীয় লোক, হোটেলের সবাই মিলে ওখানকার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। সকলের ধারণা, ও বোধ হয় আর নেই। কিন্তু ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন, ওর ডান হাতের হাড় টুকরো হয়ে গেছে, বাঁ হাতটা না ভাঙলেও প্রচণ্ড আহত, আর কপাল একটু কেটেছে। কিন্তু আর কিচ্ছু হয়নি! অনেকে বলছিল, টিনের ওপর বডিটা জার্ক করায় বেঁচে গেছে। যদি ওখানে টিন না থাকত, সেই বিশাল গর্তে ও ডুবে যেত, যদি ওই বিশাল পাথরে মাথাটা পড়ত... কিন্তু না, কিছুই হয়নি। সত্যি, ভগবান যেন কোলে তুলে নিয়েছিলেন।

সায়ন্তনী চট্টোপাধ্যায়, ব্যারাকপুর

* কানহা ন্যাশনাল পার্কে জিপে করে সাফারিতে বেরিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে অনেকটা চলে এসেছি। সঙ্গে স্ত্রী, মেয়ে, আট জন টুরিস্ট ও গাইড। অদ্ভুত নিস্তব্ধ চারিদিক। এমন সময় ব্যাক করতে গিয়ে অ্যাক্সেল গেল ভেঙে। ড্রাইভার জানাল, গাড়ি আর চলবে না। উপায়? পিছনেই জিপ নিয়ে একটি দল আসছিল। তাতে ঠেলেঠুলে স্ত্রী কন্যা গাইড সমেত কয়েক জন উঠে পড়ল। গাইড বলল, সে কানহা মিউজিয়াম থেকে খালি জিপ নিয়ে ফিরে আসছে। সেটা এখান থেকে ১৯ কিলোমিটার দূর। পড়ে রইলাম আমি আর অন্য দুজন। সবাই চুপ। পাতা-ঝরা আওয়াজেও চমকে উঠছি। হঠাৎ একটা বুনো গন্ধ পেলাম। যেটা চিড়িয়াখানায় অনেক বার পেয়েছি। আমরা ভয়ে কাঠ। গন্ধটা সরে গেল খানিক পরে। প্রায় ৪০ মিনিট পর, জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল।

গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সল্টলেক

* ব্যাংকের চাকরিতে তখন আমি হাসিমারায়। কলকাতার দুই সহকর্মী বন্ধু গেছে আমার ওখানে— উত্তরবঙ্গ বেড়াতে। কলকাতায় তখন পাঁচ টাকার নোট দুষ্প্রাপ্য। কুশলদা পুরো ব্রিফকেসটা ভরে আমার কাছে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকার মতো পাঁচ টাকার নোট নিয়ে, মহানন্দে আমার সঙ্গে রওনা হল চিলাপাতার ভিতর দিয়ে কোচবিহার পৌঁছতে, সেখানে রাজবাড়ি ইত্যাদি দেখবে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শেষ সন্ধেয় বাসটা চিলাপাতার বন পেরোচ্ছে। যখন বনের প্রায় মাঝামাঝি, ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে ভেতরের আলোগুলো জ্বেলে দিল। সর্বনাশ! গাছের প্রকাণ্ড গুঁড়ি দিয়ে রাস্তা আটকানো। মুহূর্তের মধ্যেই পাঁচ-ছ’জন লোক উঠে পড়ল বাসে। ডাকাত! ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছে। এক জন চিৎকার করে বলল, তোদের মধ্যে কে আজ ভুটান লটারির টিকিট ভাঙাতে গেছিলি বল! কেউ উত্তর দিল না। হঠাৎ আমার সামনে এসেই ডাকাতসর্দার— ম্যানেজারবাবু আপনি! বলেই কেমন যেন হয়ে গেল। ইশারায় সঙ্গীদের বলল নেমে যেতে। গেঞ্জির ভিতর থেকে এক তাড়া অগোছালো নোট আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘স্যর, আমার পাশবইয়ে জমা করে নেবেন।’ তার পর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, ‘আপনারা নিশ্চিন্তে যান’ বলে নেমে গেল। গোপাল ডাকাত! পুলিশের খাতায় এক নম্বরে নাম তখন। কুশলদা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল— তোমার কাস্টমার?

গৌতমকুমার ভাদুড়ি গান্ধীনগর, কোচবিহার

* মাস দুয়েক আগে, হাওড়া-কালকা মেল চেপে চলেছি। সকাল। এলাহাবাদ স্টেশনে ঢোকার মুখে গঙ্গার ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলেছে। অদূরে আর একটি ব্রিজ। ভোরের কুয়াশায় ব্রিজটাকে মনে হচ্ছে জল থেকে উঠে আসা বিরাট পাখি। হঠাৎ শোরগোল! ট্রেনের সাফাইকর্মীরা ছুটে-ছুটে যাত্রীদের মানা করে দিচ্ছেন হাত বের করে ছবি তুলতে। তা হলেই নাকি ক্যামেরা বা মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে কিছু লোক। আমাদের কামরায় দামি তিনটে মোবাইল খোয়া গেল। আমার স্ত্রী এক জনকে বিপজ্জনকভাবে ঝুলতে দেখলেন ব্রিজের ফাঁকে। ‘কালকা-হাওড়া’ মেলে ফিরতি পথে আমি একটা পরিত্যক্ত বিস্কুটের বাক্সে শশার খোসা ভরে হাতে এমন করে ধরলাম, যেন মনে হয় মোবাইল দিয়ে ব্রিজের ছবি তুলছি। তখন সন্ধে, ট্রেন ভালই জোরে চলছে। আশ্চর্য ভাবে একটা হাত এসে বাঁদরের মতো নিপুণ ভাবে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল প্যাকেটটা!

অনিন্দ্য দাস, পলতা

* আগরা। ফতেপুর সিক্রি। সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা উঁচুতে উঠতে হয়। সুবিশাল বাঁধানো চত্বর। দক্ষিণে বিশাল উঁচু গেট। ‘বুলন্দ দরওয়াজা’। দরজার গায়ে দীর্ঘ প্রাচীর। বাইরে একটা সুগভীর তালাও। ধুতি-শার্ট পরা, বেঁটে এক দেহাতি লোকের সঙ্গে আলাপ হল। সঙ্গে একটা ছোট্ট ছেলে। লোকটা বলল, আকবর বাদশা প্রজাদের সাহস পরীক্ষার জন্য সুউচ্চ প্রাচীর থেকে তালাওয়ে ঝাঁপ দিতে বলতেন। আমাদের অবিশ্বাসের হাসি দেখে, রেগে বলল— বিস্ওয়াস নহি হোতা? রুপয়া দিজিয়ে, ম্যাঁয় দিখলাউঙ্গা। কুড়ি টাকায় রফা হল। ১৯৮৪ সালে টাকাটা কম নয়। জামাকাপড় খুলে বাচ্চাটার হাতে দিয়ে শুধু ল্যাঙট পরে লোকটা কোথায় উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ ১৭০ ফুট উঁচু প্রাকারের উপর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা গেল— ইধার হুজুর! উপরে তাকিয়ে দেখি লোকটা পুতুলের মতো হাত নাড়ছে। তার পরই ডাইভ দিল। চোঁ করে নীচের তালাও-এ ঝপাং। সব চুপচাপ। কোনও সাড়া নেই। জলে বুদবুদ। ভুস করে লোকটা ভেসে উঠল। রুটি-রুজির জন্য দুঃসাহসিক পেশা।

পরেশ নাথ মালিক, চন্দনদহ

* ’৮৯ সালের সেপ্টেম্বর। স্ত্রীকে নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে গেছি। শালিমার গার্ডেনে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো দেখতে গেলাম। ফেরার গাড়ি ধরতে গিয়ে বিড়ম্বনা। সন্ধে সাতটা বেজে গেছে, শেষ বাসও চলে গেছে। অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটি কন্টেসা গাড়িকে শেয়ারে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করানো গেল। আমাদের সঙ্গে তিন জন যুবকও গাড়িতে সওয়ার হল। তখন কাশ্মীরের রাস্তার ধারে ধারে বাংকার। ফৌজিদের বুটের আওয়াজ। হঠাৎই এক জায়গায় ফৌজিরা হাত দেখাল গাড়ি থামানোর জন্য। থামতে না থামতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির ওপর এবং ওই তিন যুবককে পাকড়াও করল। তাদের পোশাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ল এ.কে.৪৭ রাইফেল! আমরা তো কাঁপছি। ফৌজিরা খুব ধমক দিল আমাদের, আবার আমাদের হলিডে হোমে পৌঁছেও দিয়ে গেল। সে বছরই নভেম্বর থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেল।

প্রদীপ সেনগুপ্ত ব্যান্ডেল, হুগলি

* ট্রেক করে বিকেলে ঘাতি নামে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। ফরেস্টের গেস্ট হাউসের সামনে অনেকটা সমতল জমি। চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, নীচে নদীর পাড়ে যে গ্রাম, সেখান থেকে দলে দলে মানুষ আসছে। চৌকিদার বলল, শহর থেকে কেউ এলে ওরা ওষুধের খোঁজে আসে। আমার সঙ্গে বেশ কিছু ওষুধ ছিল। ওদের একে একে কাছে ডেকে চৌকিদারের মাধ্যমে কথা বলছিলাম। বেশির ভাগ মানুষেরই সমস্যা ঠান্ডা লাগার। সর্দি-কাশি-হাঁপানি। এক বৃদ্ধা, লম্বা-ঘোমটা-দেওয়া পুত্রবধূর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তিন বছর হল ছেলের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু বাচ্চা হয়নি, ওষুধ চাই। কী করে বোঝাই, এর ওষুধ আমার কাছে নেই। এ দিকে ওষুধ না দিলে মনঃক্ষুণ্ণ হবে। বি-কমপ্লেক্স ক্যাপসুল দিয়ে বললাম, রোজ একটা করে খাবে। বৃদ্ধা জোড়-হাত করে এমন প্রণাম করল, যেন মনস্কামনা পূর্ণ হয়েই গেছে। আমায় জানাবে বলে আমার ঠিকানাও নিল। ঘুট্টুতে পোস্ট অফিস আছে, ওর ছেলে মাঝে মাঝে যায়। পরের বছর পোস্টকা়র্ড এল ঘুট্টু থেকে। পোস্টমাস্টার নিজে লিখেছেন: আপনি যে মেয়েটিকে ওষুধ দিয়েছিলেন, তার পুরো পরিবার আপনাকে শতকোটি প্রণাম জানাচ্ছে— কারণ, মেয়েটি এখন মা হয়েছে।

মলয় পাল, কলকাতা-৫৫

* ১৯৮৪। স্বামী-স্ত্রী স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারী। এক বছরের ছেলে। সবাই বড়লোক ভাবলেও, আমাদের তখন বাড়িভাড়া, দুই দিকের বিশাল পরিবারের খরচ— সব সামলে আর চলে না। এই সময় আমার স্বামীর হঠাৎ ইচ্ছে হল, এক বার শুধু নিজেরা বেড়াতে যাব। অনেক কুড়িয়ে-কাচিয়ে জোগাড়যন্ত্র করে, একটা ক্যামেরাও কিনে, ট্রেনে উঠলাম— স্লিপার ক্লাস। স্বামী আমার হাতব্যাগ হালকা করতে ট্রাভেলার্স চেক, আরও কিছু জিনিসও নীচে সুটকেসে রেখে শুতে গেল আপার বার্থে। পাশের কুপের চেঁচামেচিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জানতে পারলাম, তাদের সুটকেস চুরি গেছে। নীচে তাকিয়ে দেখি, আমাদেরটাও। গাড়ি থামানো হল। আমার স্বামী খালি পায়ে স্টেশনে নেমে হাউমাউ কান্না। তবু যাত্রীদের কথায় নৈনিতাল অবধি পৌঁছলাম। ওখানকার স্টেট ব্যাংকে আমাদের সব কথা শুনে কিছু টাকা ধার দিল, ক্যান্টিনে টিফিন খাওয়াল, সেক্রেটারি আমাদের হলিডে হোমে ঘর বুক করে দিলেন, বিকেলে সামান্য কিছু জামাকাপড় কেনারও ব্যবস্থা করে দিলেন। সত্যিই সে বার নৈনিতাল, কৌশানী, রানিখেত— সব ঘুরেছিলাম। এক ভদ্রলোক একটা ক্যামেরা অবধি ধার দিয়েছিলেন। খাওয়ার কষ্ট খুব পেয়েছি, ভাল জামাকাপড়ও ছিল না। তবু ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছিল, কারণ বয়স তখন খুবই কম— মনটা জর্জরিত ছিল না। সে সময় এত লোকের এত সাহায্য পেয়েছি, দিনগুলো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

কৌশিকী কর (বন্দ্যোপাধ্যায়), ফিডার রোড

* কলকাতা থেকে একা যাচ্ছি, এন জে পি স্টেশনে কর্তা নামিয়ে নেবেন। এল মালদা স্টেশন। কী হইচই, লোকারণ্য! জানা গেল, এন জে পি থেকে কিছু দূরে একটা মালগাড়ি লাইনচ্যুত। না সরানো পর্যন্ত কোনও গাড়ি যাবে না। আমার উলটো দিকের ভদ্রলোক তাঁর মোবাইল ফোনে বাড়িতে বেশ সব খবর দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার তো মোবাইল নেই। হাঁচোড়পাঁচোড় করে নামলাম। প্রত্যেকটা বুথে লম্বা লাইন। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। হঠাৎ চোখে পড়ল— সেই উলটো দিকের ভদ্রলোক। লজ্জা ত্যাগ করে বললাম, একটু মোবাইলটা দেবেন? খুব বিরস মুখে দিলেন। বাড়িতে জানানো মাত্রই হইহই। কী করবে, কী ভাবে করবে— লম্বা কথা শুরু হচ্ছিল। ভদ্রলোক মুখের অবস্থা দেখে কেটে দিলাম। দু’মিনিট পর ওঁর ফোনে এল আমার বাড়ির ফোন। কথা বললাম। টাইম টু টাইম খোঁজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হল, এবং অবশ্যই কত্তাই ফোনটা করবেন, ওঁর ফোনের ব্যালান্স শেষ করার প্রশ্নই নেই, ইত্যাদি। এ বার হল আসলি মজা। ভদ্রলোক যেখানে যান, আমি হেঁচড়ে-হেঁচড়ে সেখানে। একটু হাসবার চেষ্টা করি। কিন্তু না, ভদ্রলোকের মুখ বেজায় অখুশি। তাতে কী? যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক... এরই মধ্যে দু-দু’বার বাড়ি থেকে ফোন। ভদ্রলোক এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা দিলেন। হঠাৎ দেখি, একটি ছেলে তার মা-কে নিয়ে বিপদে পড়েছে। ওরা শিলিগুড়িই যাচ্ছে। প্রস্তাব দিলাম: একটা গা়ড়ি ভাড়া করে রওনা দিই, মাথাপিছু ভাড়াটা ভাগ করে নেব। ওঁরা এক কথায় রাজি। কিন্তু আমার যে ওই ভদ্রলোকটিকে চাই-ই। তিনিও রাজি হলেন। ওঁরই ফোন ধার করে, ব্যাপারটা বাড়িতে জানালাম। একটা গাড়ি পাওয়া গেল, সন্ধে নামার আগে রওনা দিলাম। বিপদ শুরু হল এ বার। মিনিটে মিনিটে ফোন। কত দূর এলে, অ্যাঁ এখনও এইটুকু, ইত্যাদি। প্রত্যেক বার ভদ্রলোক ফোনটা দেন, এবং বিরস বদনে। ডালখোলা পেরোবার পর বললেন, এ বার আপনার হাজব্যান্ডকে বলুন আমার ব্যাটারি শেষ হয়ে আসছে, যদি একটু... বাড়ি পৌঁছলাম অনেক রাতে। দু’দিন পর বড় মেয়ে দিল্লি থেকে এসেই বলল, ‘চলো দোকানে, আজই মোবাইল কিনে দেব!’ এই হল আমার মোবাইল কেনার নেপথ্য-কাহিনি।

মুক্তি চন্দ, শিলিগুড়ি

* ২০১০। আমরা করমন্ডল এক্সপ্রেসে চড়ে চেন্নাই যাচ্ছি। দুপুর দুটো নাগাদ ভাইজাগ স্টেশনে ট্রেন থামতেই হুড়মুড়িয়ে আমাদের কামরায় ঢুকে পড়ল তিনটে উটকো লোক। হাতে রাইফেল। বুকটা ধড়াস করে উঠল। কামরাতে ঢুকেই তারা ঝপাঝপ দরজা ও জানালা বন্ধ করে দিল। হুমকি ছাড়ল়— চেঁচালেই গুলি! পান্ডাটার আবার ইয়া মোটা গোঁফ, আগেকার সিনেমার ডাকাতদেরই মতো। এ বার গোঁফওলা লোকটা আধো-আধো হিন্দিতে বলল, ‘মা, ভাই ও বোনেরা, ভয় পাবেন না, আমরা ডাকাত নই, বহুরূপী। গরিব লোক আমরা, দয়া করে একটু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করুন। বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে।’ হুঁশ ফিরে পেতে কিছু ক্ষণ গেল। তার পর যে যতটুকু পেরেছিল, টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল।

শতরূপা মৈত্র ফুলপুকুর, চুঁচুড়া

* ‘বার্ধক্যে বারাণসী’র কথা মনে রেখে ছেলের কাছে বায়না ধরলাম, বিশ্বনাথের মন্দির দর্শন করব। এক সকালে সবাই মিলে বেনারস পৌঁছলাম। স্টেশনে আমাদের বসিয়ে ছেলে জায়গা ঠিক করতে গেল। তখনই আলাপ হল বাবুলালের সঙ্গে। ফর্সা মতো বছর কুড়ির বাঙালি ছেলে। রানাঘাটে বাড়ি। ঘর খুঁজছি শুনে বলল, ওর চেনা বাড়ি আছে, ভাল জায়গায় আর সস্তায় হবে। ছেলে ফিরতেই ছেলেকে বললাম, আর সবাই মিলে বাবুলালের সঙ্গে গেলাম। সত্যি ভাল ঘর। পরের ক’টা দিন দারুণ কাটল। বাবুলাল আমাদের ফ্যামিলির এক জন হয়ে উঠল। আমি ভাবতেই পারিনি এই বয়সে দশাশ্বমেধ ঘাটে নেমে স্নান করতে পারব। ও আমার হাত ধরে-ধরে স্নান করাল, তার পর বিশ্বনাথ মন্দিরের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পুজো দেওয়াল। আমি বললাম, তুই আমার আর এক নাতি। আসার আগের দিন প্রচুর বাজার করলাম। বাবুলালকে জোর করে একটা জামা কিনে দিলাম। আসার দিন ন’টার সময় হোটেলে খেতে যাচ্ছি, বাবুলালও আছে। ও বলল, আমাদের ঘরে ওর ব্যাগ পড়ে আছে। আমার ছেলে ওকে ঘরের চাবিটা দিল। আমরা হোটেলে খেয়েদেয়ে বসে আছি, ওর পাত্তা নেই। ঘরে গিয়ে দেখি, ফাঁকা। আমাদের এত বাজার, ছেলের ক্যামেরা, আমার পানের ডিব্বা, তার নীচে টাকার পুঁটুলি— কিচ্ছু নেই। ছেলেকে পুলিশের কাছে না যেতে দিয়ে ফেরার ট্রেন ধরলাম। মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসা— এগুলো দুমড়ে-মুচড়ে বেনারসে ফেলে রেখে বাড়ি ফিরলাম।

অন্নপূর্ণা খান মুড়াগাছা, নদিয়া

* পারমাদনের অভয়ারণ্যে সে দিন পর্যটক ভীষণ কম। আমি আর শম্ভু অনেকটা ভিতরে পৌঁছে গেছি। এক দিকে মোটা তারের জালে ঘেরা জঙ্গলে হরিণদের বাস, অন্য দিকে নদী। শম্ভু তার ক্যামেরায় হরিণের ফটো তুলছে, কিন্তু তারের জালগুলো ফ্রেমে চলে আসছে। শম্ভু হঠাৎ জাল বেয়ে নেমে গেল বেড়ার ও-পারে। এ কী রে! শম্ভু বলল, ‘ভাল ফটো তুলতে হলে এ রকম রিস্ক নিতেই হয়।’ হঠাৎ সাইকেলে চড়ে দুজন হাজির। ওরা এই অভয়ারণ্যের রক্ষী। এক জন তার ক্যামেরায় ফটো তুলে নিল— জালের ও-পারে শম্ভু। অন্য জন বলল, ‘ব্যস, কেস খেয়ে গেল।’ ওরা বলল, বেরোবার সময় যেন আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করে যাই, ওরা গেটের পাশে অপেক্ষা করবে। আমাদের তো মাথায় হাত। কী করি? তখন ভাবলাম, নদী পেরিয়ে ও-পারে চলে গেলে আর গেট দিয়ে বেরোতে হবে না। চোখে পড়ল ডিঙি নিয়ে এক জন নদীতে মাছ ধরছে। ডেকে বললাম, ‘তোমার নৌকায় আমাদের নিয়ে যাবে?’ অনেকটা দূরে গিয়ে একটা গ্রামের ঘাটে নামলাম, সেখান থেকে অভয়ারণ্য দেখা যায় না। গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন বড় রাস্তায় উঠলাম, হেসে গড়িয়ে পড়ছি। রক্ষীরা কি এখনও গেটে দাঁড়িয়ে আছে?

দেবাঞ্জন বেরা বিনগ্রাম, হুগলি

* পঞ্জাব ঘুরে, ফেরার জন্য পৌঁছলাম অমৃতসর স্টেশনে। হাতে প্রচুর সময়। রিজার্ভেশন অমৃতসর মেল-এ। উঠে পড়লাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে এল, তবু সব কামরা অন্ধকার। টাঙাচ্ছে না যাত্রী-তালিকাও। আমরা অবশ্য মালপত্র সেট করে ফেলেছি, রীতিমতো চেন দিয়ে বেঁধে, তালা লাগিয়ে। ট্রেনে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। নামলাম প্ল্যাটফর্মে। হঠাৎ কী মনে হওয়ায়, বাবার কাছ থেকে টিকিটগুলো চাইলাম। চক্ষু চড়কগাছ! আমাদের টিকিট অমৃতসর এক্সপ্রেসের, মেল-এর নয়। চোখ তুলে দেখি, দুটো প্ল্যাটফর্ম দূরে, ছাড়বে-ছাড়বে করছে অমৃতসর এক্সপ্রেস। আলো-ঝলমলে কামরাগুলোয় লোক ভর্তি। বৈদ্যুতিন বোর্ড বলছে, ওটা ছাড়তে আর মিনিট চারেক বাকি। আমার চিৎকারে মা-মাসি-মামির জমাটি মজলিশ ভেঙে খানখান। সব শুনে বাবা-মেসো-মামা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় টেনে আনছে সুটকেস, খুলছে চেনের তালা। আমি পিঠে-কাঁধে-কাঁকালে যতগুলো পেরেছি ব্যাগ নিয়ে, লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে। তার পর আর একটা অপেক্ষমাণ লোকাল ট্রেনের ভিতর দিয়ে গলে আরও একটা প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে সোজা অমৃতসর এক্সপ্রেসের টিকিট চেকারের সামনে। তাঁর হাত চেপে ধরলাম। বাঙালির ট্রেডমার্ক জটায়ু-মার্কা হিন্দিতে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি। অনেক কষ্টেও ‘বাত’-এর হিন্দি মনে এল না। বললাম, সঙ্গের মহিলাদের হাঁটুতে দর্দ। হাত দিয়ে দেখালাম বাত-কাতর মা-মাসির প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টাকে। চেকারের মন গলল। একে একে ট্রেনে উঠল সবাই। যা-ই হোক, সে যাত্রা বেশ লেট করেছিল অমৃতসর এক্সপ্রেস। এবং অমৃতসর মেল আমাদের জিভ ভেংচে হুউউশ করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

অর্পিতা রায়চৌধুরী, কলকাতা-৫২

* ভোরে পৌঁছলাম পণ্ডিচেরি। সে দিন দীপাবলি। আগে থেকে বুক করা মোটামুটি নামী হোটেলে উঠলাম। খাওয়ার সময় ওই হোটেল সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে আলাপ হল বেশ কয়েকটি নবদম্পতির সঙ্গে। সন্ধেয় হঠাৎ আমার ছোট্ট মেয়ের গা গরম হতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে রুমে যখন ফিরলাম, মেয়ের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মেয়েকে জলপট্টি দিতে দিতে সবে চোখ জুড়ে এসেছে, দরজায় প্রবল ধাক্কা। খুলে দেখি, ফ্লোরে প্রচুর পুলিশ। এক-একটা রুমের দরজা খুলিয়ে টেনে বের করে আনছে ওই স্বামী-স্ত্রীদের, লক-আপে নিয়ে যাবে বলে। ওরা নাকি সব নকল স্বামী-স্ত্রী, মধুচক্র চলছে! এ বারে পুলিশ আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার স্বামী বললেন ‘ভেতরে এসে দেখে যান। মেয়ের প্রবল জ্বর, জলপট্টি দিতে হচ্ছে। আমরা টুরিস্ট, কলকাতা থেকে আসছি।’ পুলিশ ভদ্রলোক পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘ও, ঠিক আছে, আপনারা ঘরে ঢুকে যান।’ আমরা দুজনেই সমস্বরে: ‘আপনি বাঙালি! বাব্বা, ধড়ে প্রাণ এল।’ হেসে উনি বললেন, ‘আমি থানার ওসি। এটা দীপাবলির স্পেশাল রেড!’

মিতা মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৪৫

* ম্যাসাঞ্জোরে পশ্চিমবঙ্গ যুব কল্যাণ দপ্তরের যুব আবাসটা দূর থেকে গল্পে পড়া দুর্গের মতো দেখাচ্ছিল। কাছে এসে অবাক। দরজায় পেল্লায় তালা। কী করব ভাবছি, এমন সময় চমকে দেখি, পেছনের ঝোপ থেকে উঠে আসছে এক মিশকালো দেহাতির রোগা লম্বা মূর্তি। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘আমি গেছলাম আপনাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। হেঁহেঁ।’ চাবি নিয়ে সে দরজাটা খুলতেই সামনের বিরাট হলরুমটা আমাদের ছ’জনকে গিলে নিল। দু’পাশে ডর্মিটরি আর বেশ কয়েকটা রুম নিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জন অনায়াসে থাকতে পারে। আমরা দুটো মোটে অণু-পরিবার! চৌকিদার ‘নিশ্চিন্তে ছড়িয়ে থাকো। হেঁহেঁ’ বলে চলে গেল। ফিরল রাত আটটায়। সঙ্গে কয়েকটা গামছা মোড়া ডেকচি। বলল, ‘রাতের খাবার। খেয়ে নিও বাবু। আমি ঘরে যাব। বেটির বহুত বুখার। রাতে দরজা খুলবে নাই মোটে।’ রাতে ঘুম ভাঙল বোমের আওয়াজে। কখনও এগোচ্ছে, কখনও পিছোচ্ছে। আচমকা দূর থেকে একটা কোলাহল এগিয়ে আসতে লাগল কাছে। সঙ্গে বোমের আওয়াজ। জানলা ফাঁক করে দেখি নীচের দিকে নদীর চর বরাবর সার সার লণ্ঠনের আলো যুব আবাসের দিকে উঠে আসছে। একটু বাদেই ছাদের উপর ধুপধাপ শব্দ, পায়ের আওয়াজ। জানলা বন্ধ করে দিলাম। এ বার দরজায় দাম-দাম পেটানোর শব্দ। ভেঙে ফেলবে না কি? সাহস করে চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘কে ওখানে? কী চাই’ চেনা গলা শুনতে পেলাম। ‘আমি চৌকিদার বাবু, দরজা খোল। কোনও ভয় নাই।’ বাইরে স্পষ্ট হল বাচ্চাদের চিৎকার, কান্নাকাটি আর চাপা ফিসফাস। দিলাম কপাল ঠুকে দরজা খুলে। ‘বাবু রে ওদের বাঁচা... হাতির পাল গ্রামে ঢুকে বাড়ি ভাঙছে... খাবার লুটছে। মরদগুলান পটকা ফাটিয়ে লড়ছে, বাচ্চা আর মেয়েরা বুড়াদের নিয়ে এখানে চলে এসছে। আজ রাতটা ছাদে থাকবে কেনে... কাল ফর্সা হলেই ঘরে চলে যাবে সব। অনুমতি দে বাবু।’ বললাম, ‘ছাদে কেন, ঘরে এসেই থাকুক না’। ওরা শুনল না। সবাই ছাদে চলে গেল কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।

শৈবাল দাস, কেষ্টপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

robibasoriyo cover story travelki travel experience
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE