ভেবেছিলাম ফেলুদা-র কোনও একটা গল্প দিয়ে আমার পরিচালনা-জীবন শুরু করব। কিন্তু শেষে বেছে নিলাম ‘ফটিকচাঁদ’। আসলে তার কয়েক বছর আগেই ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ রিলিজ করেছে। লোকের মনে সে ছবির স্মৃতি তখনও টাটকা। এর পরই আমি ফেলুদা করতে গেলে একটা তুলনা চলে আসতই। তবে, বাবার কোনও গল্পই যে পরিচালনা করব, সেটা তত দিনে ঠিক করে ফেলেছি। তাই ‘ফটিকচাঁদ’। বাবার লেখা গল্পগুলোর মধ্যে এটা আমার খুব প্রিয় গল্পও বটে। একটা গল্পের মধ্যেই অনেকগুলো দিক আছে এতে। বিশেষ করে, হারুণের সঙ্গে ফটিকের সম্পর্কটা আমার ভীষণ ভাল লাগত।
সুতরাং, শুটিং শুরু হল। বাবার লেখা চিত্রনাট্য, বাবারই মিউজিক। ছবিটাতে ময়দানের মেলার একটা বড় ভূমিকা আছে। এক সময় ময়দানে প্রতি রবিবার দারুণ একটা মেলা বসত। এখন আর সে রকম মেলা বসে না। এক সময় বাবা নিজেও সে মেলায় যেতেন। সেখানে জাগলিংয়ের খেলা দেখানো হত। ফটিকচাঁদ গল্পের আইডিয়াটাও সেই ময়দানের মেলা থেকেই এসেছে।
আমরাও শুটিং শুরু হওয়ার পর ফি-রবিবার ওই মেলায় যেতে শুরু করলাম। কারণ, ছবিতে মেলার ওপরই বড় বড় দৃশ্য থাকবে। কিন্তু এক জন জাগলারের প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত অভিনেতা কামু মুখোপাধ্যায়কে জাগলারের ভূমিকায় বাছা হল। উনি জানালেন, এক সময় নাকি জাগলিংয়ে অল্প-বিস্তর হাত পাকিয়েছিলেন। অভ্যেসটা আছে। তার পর বাকিটা শিখে নিয়ে চমৎকার উতরে দিয়েছিলেন।
এ বার জাগলারের এক জন গুরু দরকার, যার কাছে তিনি জাগলিংয়ের খেলা শিখবেন। কিন্তু অনেক খুঁজেও সে রকম কাউকে পাওয়া গেল না। শেষে এক জন বলল, হায়দরাবাদে এ রকম জাগলারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অগত্যা হায়দরাবাদ দৌড়লাম। ওখানে আমাদের এক জন বন্ধু ছিলেন। তিনি সরকারি ভাবে আমাদের সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিলেন। আর আমরা ক’দিনের মধ্যে প্রায় সমস্ত অন্ধ্রটাই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে ফেললাম। কিন্তু পছন্দমত কাউকে পেলাম না। যা দেখছি, সবই মাদারির খেলা, সেটা ঠিক জাগলিং নয়। ফলে, খুব মন-টন খারাপ করে কলকাতায় ফিরে এলাম।
তখন তো আমরা প্রায় প্রতি রবিবার ময়দান যাই। ওখানে জর্জ টেলিগ্রাফের একটা তাঁবু ছিল। আমরা দুপুরের খাওয়াটা সেখানেই সারতাম। এক দিন খাওয়াদাওয়া করছি, এমন সময় এক জন এসে খবর দিল মেলায় জাগলিং দেখানো হচ্ছে। গল্পের সঙ্গে খুব মিল আছে খেলাগুলোর। আমরা দৌড়লাম। সত্যিই তো, গল্পের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! তার নাম গঙ্গারাও। তাকে পাকড়াও করে বাড়িতে বাবার সামনে হাজির করলাম। বাবা কয়েকটা খেলা দেখাতে বললেন। সে দেখাল। আমরা তো সবাই মুগ্ধ। বাবাও বলে উঠলেন, আরে এ তো ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম, হুবহু তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বলে, বাবা এক জনের নাম করে বললেন, তুমি চেনো এঁকে? আমি এঁর খেলাই দেখেছিলাম। গঙ্গারাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, উনি তো আমার মামা হন! যাই হোক, তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়ামাত্র সে রাজি হল। যাকে খুঁজতে আমরা গোটা হায়দরাবাদ চষে ফেললাম, সে আসলে আমার নিজের শহরে, আমাদের চোখের সামনেই ছিল।
তবে, ফটিকের চরিত্র বাছতে কোনও সমস্যা হয়নি। তাকে ঠিক করাই ছিল। ছেলেটির নাম রাজীব, এর আগে সে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে, পাঠশালার এক ছাত্রের ভূমিকা করেছে। সমস্যা হল প্রযোজক পাওয়া নিয়ে। দুজন এলেন এবং চলে গেলেন। এক জন তো মারাই গেলেন। এই সব ঝামেলার জন্য যেটা হয়তো ছ’-সাত মাসে শেষ হতে পারত, সেটাতে সময় লাগল প্রায় দেড় বছর। ছবির বাজেটও ছিল কম। ফলে, মাঝে অনেকখানি সময় আমাদের বসে থাকতে হয়েছে শুধু টাকার অভাবে। এমনও মনে হয়েছে, ছবিটা বুঝি আর করাই হল না। এ রকম অনেক সমস্যা মিটিয়ে শেষমেশ ছবি তো তৈরি হল। বাবার ছবি যিনি এডিট করতেন, তাঁর সঙ্গে বসে ফার্স্ট-কাট এডিটিংও শেষ। কিন্তু ছবি দেখে আমার মনে হল, ছবিটা একটু বেশিই বড় হয়েছে। সুতরাং, বাবাকে দেখালাম।
এর আগে শুটিং চলার সময় বাবাকে শুটিং দেখতে দিইনি। বাবা শুটিং ফ্লোরে এলে ভারী মুশকিল। সঙ্গে সঙ্গে কাগজে সেটা ফলাও করে ছাপত। তাই এই প্রথম বাবা ছবিটা দেখবেন। আমার এটাই প্রথম কাজ। সে নিয়ে এর আগে কখনও টেনশন হয়নি। শুধু ভেবে গেছি কাজটা খুব মন দিয়ে, ভাল ভাবে শেষ করতে হবে। কিন্তু এ বার খুব, খুব টেনশন হল।
সামনের চেয়ারে বসে বাবা ছবি দেখছেন। পিছনে বসে আমার বুক ধুকপুক করছে। ছবি দেখা শেষ হলে বাবা বললেন, আমার যে রকম চিত্রনাট্য, তাতে তো ছবিটা পৌনে দু’ঘণ্টার বেশি হওয়ার কথা নয়। এটা হয়েছে প্রায় দু’ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। আমি কিছু বলব না। তুমি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে এটাকে এডিট করো।
নিজের বানানো প্রথম ছবি। সন্তানের মতো মায়া পড়ে গেছে। প্রত্যেকটা সিন দেখেই মনে হচ্ছে, এটা কী করে বাদ দেব! কিন্তু বাবার কাছে শিখলাম, ছবি ভাল হতে হলে প্রয়োজনে রুথলেস হতে হবে। যে সিন শেষে ছবিটাকে কোথাও নিয়ে যায় না, প্রয়োজনে তাকে নির্মম ভাবে ছেঁটে ফেলতে হবে, নয়তো একেবারে ছোট করে দিতে হবে। এ বার এডিটিংয়ের সময় সেই কথাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললাম। এ বার ছবিটা দাঁড়াল ঠিক পৌনে দু’ঘণ্টা।
‘ফটিকচাঁদ’ মুক্তি পেল। সেটা ১৯৮৩ সাল। ছবি খুব ভাল সমালোচনা পেল। অনেকে আবার বললেন, বাবাই তো করে দিয়েছেন। ভাবলাম, যাক ছবিটা তার মানে ভালই হয়েছে। বাবা আসলে শুটিং ব্যাপারটা খুব ভালবাসতেন। ফটিকচাঁদ-এর সময় তাঁকে আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, সেই ‘বাবা করে দিয়েছে’ কথাটা উঠছেই, তখন আর তাঁকে বাধা দিইনি। বরং ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’-র সময় তাঁকে শুটিং দেখতে যেতে খুব উৎসাহ দিয়েছিলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy