Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Bengalis

প্রযুক্তির ইতিহাসে বিস্মৃত বাঙালি

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে স্বদেশি মোটরগাড়ি তৈরি করেছিলেন বিপিনবিহারী দাস। সেই গাড়ি ব্যবহার করতেন মোতিলাল নেহরু। টিটাগড়ের গোকুলচন্দ্র তৈরি করেন দেশের প্রথম স্টিম ইঞ্জিন। তড়িদাহত হওয়ার ভয়কে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বাড়িতে প্রথম বৈদ্যুতিক আলো আনলেন গগন ঠাকুর। তবু প্রযুক্তির ইতিহাসে কলকাতা আজ বিস্মৃত। ১৮৫৪-৫৫ সালে কোনও কোনও সায়েবি অঙ্গনে রাস্তায় কেরোসিন তেলের আলো এবং ১৮৫৭ সালে গ্যাসের আলো জ্বালার ব্যবস্থা হল। এই সময় বাড়ির প্রবেশপথে আবশ্যিক আলো দেবার ব্যবস্থা উঠে যায়।

সেতুবন্ধন: পন্টুন ব্রিজ থেকে রবীন্দ্র সেতু, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্যতম নিদর্শন

সেতুবন্ধন: পন্টুন ব্রিজ থেকে রবীন্দ্র সেতু, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্যতম নিদর্শন

শংকর
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২০ ০০:৫৪
Share: Save:

ছিয়াশি বছরের জীবনে কম জনের সঙ্গে পরিচয় হয়নি, কিন্তু মাত্র ছ’জনকে মনে পড়ছে যাঁরা আমাদের কারিগরি ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা কৌতূহলী ছিলেন। প্রথম জন বাংলায় জন্মানো এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্র রমাপ্রসাদ গোয়েন্‌কা।

তিনি দুঃখ করতেন, “অনেক কোম্পানির মালিক হলাম, কিন্তু টেকনোলজিকে তেমন করে সন্ধান করা গেল না। বিদেশ থেকে ইমপোর্ট করা টেকনিকের ওপর নির্ভর করেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে, আমাদের কোম্পানিগুলোয় হোমমেড টেকনোলজির কোনও গুরুত্ব দেখতে পাই না। স্ক্রুড্রাইভার টেকনোলজির ওপর নির্ভর করেই চলে আমাদের জীবন, এই অবস্থার কী ভাবে পরিবর্তন হবে, তা ভেবে পাই না। আমার দাদামশাই স্যর বদ্রিদাস গোয়েন্‌কা প্রেসিডেন্সিতে স্যর জে সি বোস ও স্যর পি সি রায়ের ছাত্র ছিলেন। কলেজ ছাড়ার পরেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। প্রায়ই বলতেন, টেকনোলজির দুই গুরুকে হাতের কাছে পেয়েও আমরা শিল্প-বাণিজ্যে তেমন কিছুই করতে পারলাম না।” রমাপ্রসাদ আরও বলতেন, “দিল্লিতে যাঁরা লাইসেন্স বার করেন, তাঁদের মাইনে টেকনিক্যাল অফিসারদের চেয়ে অনেক বেশি। মেড ইন ইন্ডিয়া অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্তু আমাদের ইন্ডিয়ান উদ্যমের গলায় পরানো আছে বিদেশের টেকনোলজির শেকল। টেকনোলজিকে নিজেদের আয়ত্তে না আনলে আমাদের মুক্তি নেই, তা জেনেবুঝেও আমরা কিছু করতে পারি না।”

শিল্পপতি রমাপ্রসাদ গোয়েন্‌কা সেই দুঃখেই সম্ভবত প্রথম আইআইটি খড়্গপুরের সাম্মানিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বলতেন, “এই কাজটা আমাকে বিশেষ আনন্দ দেয়, যদিও জুট টেকনোলজির বিলিতি ডিপ্লোমা ছাড়া আমার নিজের কিছুই জানা নেই।”

নতুন নতুন টেকনোলজির জন্মস্থান খড়্গপুরে তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন এবং তাঁকে সঙ্গ দিতে যেতেন সিইএসসি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি বি ঘোষ, যিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যর পি সি রায়ের প্রিয় ছাত্র জ্ঞান ঘোষের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পরবর্তী সময়ে আইআইটি-র ডিরেক্টর আর এক জন অমিতাভ ঘোষ। তিনি বলতেন, “নতুন টেকনোলজিকে যেন তেন প্রকারেণ বাধা দেওয়াটাই বাঙালিদের ধর্ম, সেই পলাশির যুগ থেকে।”

সেই কলের জলকে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে দ্রুতগতি রেলকে সন্দেহের চোখে দেখা, ফোটো তোলালে পরমায়ু কমে যাবে, বিদ্যুতে পারিবারিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে থেকে আরম্ভ করে কম্পিউটার হচ্ছে বাঙালি কেরানির শত্রু, ইত্যাদি কত অভিযোগ না বাঙালি প্রথমে করল, কত সময়ই না নষ্ট হল এবং তার পর, বাঙালি যখন নতুন টেকনোলজির মাহাত্ম্য বুঝল, তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।

বাহন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত গাড়ি

আপনি জ্যোতি বসুকে পর্যন্ত জিজ্ঞেস করুন, কেন তিনি সারা রাত পাহারা দিলেন কম্পিউটার যেন কোনও আপিসে না ঢোকে এই কলকাতায়, আর এখন বাড়ির কাজের মেয়েরাও হাতের বালা বন্ধক রেখে ছেলেকে কম্পিউটার শেখাতে চাইছে। অর্থাৎ আমাদের বিজ্ঞান অভিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু আমরাই। জ্যোতি বসুর বাবাও আমেরিকায় শিক্ষিত ডাক্তার, নিজেও তিনি বিলেতে শিক্ষিত ব্যারিস্টার, তা সত্ত্বেও তিনি কেন বাঙালির মুখে চুন-কালি মাখালেন তা জানতে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, “আমরা রাত জেগে যে কম্পিউটারকে বাধা দিয়েছিলাম, সে হল কেরানি বাঙালির চাকরি খাওয়ার যন্ত্র। যে কম্পিউটার আজকের বিশ্বের হৃদয় জয় করেছে সে অন্য যন্ত্র, সে যন্ত্র সম্বন্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। এই কম্পিউটার অবশ্যই বাঙালির প্রিয় যন্ত্র, এই যন্ত্রে ব্যুৎপত্তিই বাঙালির অন্যতম বিশেষত্ব।”

এই প্রসঙ্গে আরও গল্প আছে। বিখ্যাত চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় বলতেন, “আমাদের নজর ওস্তাদের দিকে, একটা কিছু আবিষ্কার বেরিয়ে গেল সেটাই বড় কথা, তার পর বছরের পর বছর পুরনো আবিষ্কারকে ঠাকুরের মতো আঁকড়ে ধরা, নতুনকে সেখানে না ঢুকতে দেওয়াটাই আমাদের উৎকর্ষ, তাই সর্ব বিষয়ে আমাদের বৈষয়িক ঔদ্ধত্য। তাই আমাদের সেরা তালা, সেরা ছুরি, সেরা সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, সেরা ওষুধপত্তর কালের অবহেলায় পিছিয়ে পড়ে আমাদের বার বার দুর্বল করে তুলেছে। অন্য জাতদের অনেকেই অন্য রকম, তারা পুরাতনকে সম্মান জানিয়েও প্রতি বার নতুন কিছু বিশ্ববাসীর হাতে তুলবার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে।”

এই সব দুঃসময়ে আমরা কেন বৈজ্ঞানিক পথকে সমর্থন না জানিয়ে বার বার আইনশৃঙ্খলাকে অধঃপাতে পাঠিয়েছি, তা আজও স্বদেশে এবং বিদেশে তেমন ভাবে আলোচিত হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের নব নব আশীর্বাদ মাথায় তুলে নিতে আমাদের যে কোনও দ্বিধা ছিল না, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও যশস্বী আমেরিকান অধ্যাপক গলব্রেথের বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে৷ এমআইটি-র এই স্বনামধন্য অধ্যাপক ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রায়ই ইংল্যান্ডে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নানা আলোচনায় মশগুল হতেন। তাঁরা এক বার তুললেন নানাবিধ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা, যার অধিকাংশই সাধারণ মানুষের কী কাজে লাগে তা নেহরু বুঝতে পারেন না। প্রশ্ন উঠল, কোন দুটি আবিষ্কার মানুষের সবচেয়ে কাজে লেগেছে। পরের দিন চায়ের আলাপের সময় প্রধানমন্ত্রী নেহরু বললেন, “যে দুটি আবিষ্কার সাধারণ মানুষের সবচেয়ে কাজে লেগেছে, সে দুটি হল বাইসাইকেল এবং ইলেকট্রিক বাল্‌ব।” মার্কিন অধ্যাপক আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হলেন এবং দুটি যন্ত্রের গবেষকদের ধন্যবাদ জানালেন।

বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক বাংলায় ডজন-ডজন লেখা হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় পাশ করাতে, কিন্তু পড়তে পড়তে মজা পাওয়ার মতো কলকারখানার ইতিহাস তেমন নজরে আসেনি। অর্থাৎ কলকারখানার ইতিহাস জেনে লাভ নেই, ওসব স্থাপন করবেন সায়েবরা। সেখানে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ! তাঁদের সঙ্গে গৃহস্থ বাঙালির কোনও সম্পর্ক থাকবে না। ওঁরা মিস্ত্রি, আমরা ভদ্রলোক। ওঁদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের কথা জেনে আমাদের কোনও লাভ নেই।

অর্থাৎ এক দিকে মিস্ত্রিগিরি, অন্য দিকে বাবুগিরি— মাঝখানে আর কিছু নেই। বাড়তি খবর নেওয়ার মধ্যে ইতিহাস-সংক্রান্ত কিছু রচনা, যার সংখ্যা বাংলায় বেশ কম। এরই মধ্যে এক জন লেখক আমার মন জয় করেছিলেন, তিনি সিদ্ধার্থ ঘোষ। তাঁর কয়েকটি বই পড়ে খুব ভাল লেগেছিল, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। তার পর শুনলাম তাঁর অকালপ্রয়াণের কথা।

‘কলের শহর কলকাতা’-র লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষ নতুন পথের পথিকৃৎ, কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। বাঙালিও কলকারখানার যে-আদিকথা শুনতে চায়, তা স্পষ্ট করে আর বলা গেল না। দুঃখের বিষয়, সিদ্ধার্থ ঘোষ দীর্ঘজীবী হননি। জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৪৮, দেহাবসান ৩১ অক্টোবর ২০০২। বাংলা ভাষায় প্রযুক্তির ইতিহাসবিদ হিসেবে কিছু নাম হলেও তিনি তাঁর যোগ্য সম্মান পাননি।

টেকনোলজির ইতিহাসে আমাদের অধিকার এবং সেই প্রসঙ্গে মনে পড়ে এক দরিদ্র ইশকুল-মাস্টারের কথা। সংবাদপত্রে এঁর কারিগরি সম্পর্কে ছোট্ট প্রবন্ধ পড়ে আমার জিতেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছে হয়। আমার বন্ধু, প্রয়াত অভীক দত্ত সানন্দে এই যোগসূত্রের কাজ করেছিল। আমি শুনেছিলাম, অখ্যাত ইশকুল-মাস্টার অভাব-অনটন সত্ত্বেও কেমন আগ্রহী হয়ে ওঠেন বঙ্গের কারিগরি ইতিহাসে। সুযোগ পেলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন বৃদ্ধ মিস্ত্রিদের সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গের বিদ্যুৎশিল্পের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি ‘দে, শীল অ্যান্ড কোম্পানি’ সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ডক্টর প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের সুবর্ণবণিক সমাজে পাঠান আরও খোঁজখবর করতে। সেখানেই এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাঁকে ৬ নম্বর সাগর ধর লেনে যেতে বলেন। সেখানে ছিল শীল-পরিবারের বাস। সেখানকার আর এক জন বৃদ্ধ তাঁকে পাঠালেন সিমলা রোডের বাসিন্দা গোরাচাঁদ শীলের কাছে। এই ভাবে বেরিয়ে এল ‘দে, শীল অ্যান্ড কোম্পানি’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস শীলের কথা।

জিতেনবাবুর বইটি প্রকাশে আমার সামান্য একটু ভূমিকা ছিল। আমি ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স’-এর তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট শিশির বাজোরিয়াকে ধরি এবং তাঁদের আর্থিক সাহায্যে বাংলায় বইটি প্রকাশে সমর্থ হই। উৎসাহের বশবর্তী হয়ে বইটির একটি মুখবন্ধও আমি রচনা করি। সেখানে লিখেছিলাম, ‘যে কোনও জাতের ইতিহাস এমনই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, তার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব কেবল বিদগ্ধ ঐতিহাসিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।’ লিখেছিলাম, কালীঘাটের আশুতোষ মল্লিক ১৯০৮ সালে অতি উন্নতমানের হস্তচালিত ক্যালকুলেটর যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি রাজকৃষ্ণ কর্মকার নামে এক মিস্ত্রি সিমলা পাহাড়ে বয়লার বসিয়ে পাউরুটি-কারখানা স্থাপন করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি নেপালে হাজির হন এবং ওখানে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে রাজাকে মুগ্ধ করেন।

আরও জেনে বিস্মিত হই, টিটাগড়ের গোকুলচন্দ্র ১৮২৬-২৭ সালে এ দেশের প্রথম স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করলেও সায়েবদের কারসাজিতে পরবর্তী কালে তাঁর অস্তিত্ব মুছে যায়।

আরও মজার তথ্য আছে। জাহাজি জগতে ‘সারেং’ শব্দের উৎপত্তির পিছনে রয়েছেন বাংলার বিখ্যাত স্টিমার-বিশেষজ্ঞ মহম্মদ হানিফ সারেং। এঁর জন্ম চট্টগ্রামে। আরও বিস্মিত হয়েছিলাম জেনে, কলকাতায় স্বদেশি মোটরগাড়ি তৈরি করেছিলেন জনৈক বিপিনবিহারী দাস, তাঁর গ্যারাজটি ছিল আজকের বালিগঞ্জ ফাঁড়ির খুব কাছে। ভারতবর্ষের প্রথম স্বদেশি গাড়িটি কিনেছিলেন মদনমোহন মালব্য। এটি ব্যবহার করতেন স্বয়ং জওহর-পিতা মোতিলাল নেহরু।

বহু চেষ্টা করেও জিতেন্দ্রনাথ রায়ের বইটা বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারিনি। আমাদের ইশকুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও বিজ্ঞান ও টেকনোলজির ইতিহাসের কদর নেই। জিতেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী তাঁর সব গয়না বিক্রি করে স্বামীর গবেষণাকার্যে নীরবে সাহায্য করে গিয়েছিলেন।

আমাদের মহাকবি আশ্বাস দিয়েছেন, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। অবশেষে সন্ধান পেলাম তরুণ অধ্যাপক শুভব্রত সরকারের। তিনি তখন ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখন রবীন্দ্রভারতীর ইতিহাসের অধ্যাপক। শুভব্রতর খোঁজখবরের বিষয় ভারতের শিল্প-প্রচেষ্টায় স্বদেশি ও বিদেশি চরিত্ররা। এই নেশায় বুঁদ হয়ে তিনি এক দিন বিদেশযাত্রা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশে বিদ্যুদয়নের পথিকৃৎ ক্রম্পটন সায়েবের জীবনবৃত্তান্ত রচনা।

ক্রম্পটন সায়েবের জীবনচরিতে আমার আগ্রহ নানা কারণে। এই পথিকৃৎ ইংরেজনন্দনের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আমার শ্বশুরমশাই। ওঁদের ইলেকট্রিক ল্যাম্প ও ফ্যানের তখনও যথেষ্ট সুনাম। তার পর দুর্দিন এল। সঙ্কোচনের চাপে পড়ে আমার কেরানি শ্বশুরমশায় বেশ অসুবিধেয় পড়ে গেলেন। পরে শুনলাম, শুধু ফ্যান-লাইট নয়, ক্রম্পটন এ দেশে বিদ্যুৎ ব্যবসারও পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি আজকের সিইএসসি কোম্পানির সূচনাতেও ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আরও জানলাম, কলকাতায় বিদ্যুৎ আনয়নে, তারও আগে দার্জিলিং-এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের বিদ্যুদয়নে এবং পরবর্তী কালে বোম্বাই ইলেকট্রিকেও তাঁর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। এই ক্রম্পটন সায়েব সিইএসসি-র প্রতিষ্ঠাকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এই কোম্পানি কেন তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল, তা আজও আমার ঠিকমতো জানা নেই। পরবর্তী কালের ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরাও কেন তাঁকে ভুলে গেলেন, তা-ও জানা নেই। শুধু মনে হয়েছে, টেকনোলজি ও বিদ্যুতের ইতিহাস আজও বিশদে লেখা হয়নি।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে ইতিহাস সুরক্ষিত করার কোনও প্রচেষ্টা নেই। মূল্যবান সব নথিপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যতটুকু এখানে-ওখানে পড়ে আছে তাও আর বেশি দিন নয়। আমাদের ভরসা শুধু উনিশ ও বিশ শতকের কিছু সংবাদপত্র রিপোর্ট। বড় বড় কোম্পানি মহাফেজখানা তৈরি করে ইতিহাসকে সম্মানিত করার প্রয়োজন আজও অনুভব করেননি।

শুভব্রত সরকারের নতুন এই বইটির নাম ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। তাঁর অনুসন্ধানের কালপর্ব ১৮৮০-১৯৪৫। কলকাতায় বিদ্যুতের প্রথম আবির্ভাব ১৮৯৯ সালে। বলা হয়, ওই বছরের এপ্রিল মাসে, ইংরেজ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর কলকাতায় নবযুগের সূচনা হল, সেখানে বিদ্যুৎ সহজলভ্য এবং সুলভ হল। কলকাতায় বিদ্যুতের আবির্ভাব বেশ অন্য রকম।

অষ্টাদশ শতকে স্কটল্যান্ডের উইলিয়ম মার্ডক গ্যাসের আলো জ্বেলে কারখানার কর্মীদের মুগ্ধ করেন। সাধারণ মানুষের সামনে গ্যাসলাইটের আত্মপ্রকাশ সেই প্রথম। ১৮২০ সালে নানা দেশে এবং লন্ডন, প্যারিসের মতো শহরের রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলতে দেখা যায়।

কলকাতা কেন পিছিয়ে থাকবে? উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতা কর্পোরেশন নির্দেশ জারি করলেন, কৃষ্ণপক্ষে প্রতিটি বাড়ির মালিককে বাড়ির প্রবেশপথের সামনে সন্ধ্যার পর আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। অগতির গতি রেড়ির তেল। পরে ১৮৫৪-৫৫ সালে কোনও কোনও সায়েবি অঙ্গনে রাস্তায় কেরোসিন তেলের আলো এবং ১৮৫৭ সালে গ্যাসের আলো জ্বালার ব্যবস্থা হল। এই সময় বাড়ির প্রবেশপথে আবশ্যিক আলো দেবার ব্যবস্থা উঠে যায়।

গ্যাস কেরোসিন ছেড়ে এ বার বিদ্যুতে প্রবেশ করার সময়। জিতেন্দ্রনাথ রায় জানাচ্ছেন, ১৮৭৯ সালের ২৪ জুলাই কলকাতার কিছু নাগরিক বিজলি বাতির আলোকছটা প্রথম দর্শন করেন। ওই দিন পি ডব্লু ফ্লেউরি অ্যান্ড কোম্পানির মালিক ছোট

একটি ডায়নামো চালিয়ে তার সাহায্যে কার্বন আর্ক ল্যাম্প জ্বালিয়ে উপস্থিত কলকাতার দর্শকদের অভিভূত করেন।

শুভব্রত সরকার সংবাদপত্র থেকে জানাচ্ছেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের খবর। ১৮৮৩ সালে পুরো গ্রেট ইস্টার্ন ভবনটি বৈদ্যুতিক আলোকে সুশোভিত হয়ে সংবাদপত্রের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। হোটেল কর্তৃপক্ষের আশা, এই আলোয় বিস্মিত হয়ে আরও খরিদ্দার সেখানে আসবেন।

আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে, ১৮৯১ সালে হ্যারিসন রোড আলোকিত করল কিলবার্ন কোম্পানি, তার জন্যে ব্যবহৃত হল হ্যালিডে স্ট্রিটের পাম্পিং স্টেশনের ডায়নামো। এই প্রচেষ্টার মিউনিসিপ্যাল কনসালট্যান্ট ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।

এ বারে সিইএসসি-র প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে কিছু কথা। এঁর পুরো নাম রুক্‌স এভলিন বেল ক্রম্পটন, জন্ম ১৮৪৫, দেহাবসান ১৯৪১। ইনি আবিষ্কারক, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এবং অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার এবং অবশ্যই ব্যবসায়ী। ইনিই তৎকালীন ভারত সরকারকে দেশের প্রথম ‘ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট’ প্রণয়নে সাহায্য করেছিলেন। ক্রম্পটনের কীর্তি অনন্যসাধারণ— ল্যাম্প, সুইচ বোর্ড এবং ডায়নামো তৈরি। প্যারিসে ১৮৮১ সালে যে আন্তর্জাতিক মেলা হয়েছিল, সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করে স্বর্ণপদক জয়ী হন।

১৮৯৬ সালে কর্নেল ক্রম্পটন ভারত সরকার কর্তৃক এ দেশের ‘ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট’ তৈরিতে সাহায্যের জন্য আমন্ত্রিত হন। দেখা যাচ্ছে, বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লি ১৮৯৫ সালে ‘ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট’ পাশ করেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেলভেডিয়ারে লাট ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহের টেন্ডার আহ্বান করেন।

শোনা যাচ্ছে, কলকাতার লাইসেন্সের জন্যে ‘ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোং লিমিটেড’ যখন আবেদন করলেন, তখন তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মান সংস্থাটির নাম ‘এজে বোল্টন অ্যান্ড কোম্পানি’। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সই করলেন পি ডবলিউ ডি-র সেক্রেটারি জে ডবলু এইচ গ্যাস, তারিখ ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৬। ‘কিলবার্ন অ্যান্ড কোং’ যে দিন লাইসেন্স হাতে পেলেন, সেই ঐতিহাসিক তারিখটি ৭ জানুয়ারি ১৮৯৭। পরের মাসেই বিলেতে এক সভা করে ‘ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি’ হয়ে গেল ‘কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোং লিমিটেড’।

প্রথমে আশঙ্কা ছিল, ১৮৯৯ সালের গোড়ায় কলকাতার বিদ্যুৎ সম্ভব হবে না, তার অন্যতম কারণ চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্কট মনটিফ সবেমাত্র বিয়ে করেছেন! কিন্তু ক্রম্পটন সায়েব নাছোড়বান্দা, তিনি নিজেই উঠেপড়ে কাজে লেগে গেলেন এবং স্বপ্ন পরিণত হল বাস্তবে— তারিখ, ১৭ এপ্রিল ১৮৯৯।

আরও একটি মজার বিষয়, বিদ্যুতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে হাতে-টানা পাখারও যুগাবসান। শুভব্রতবাবু জানাচ্ছেন, ১৯০২ সালে হেয়ার স্ট্রিটের মেটকাফ হলে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা হচ্ছে লাইব্রেরি পাঠকদের মাথা ঠান্ডা রাখার জন্যে। শুধু লাইব্রেরি নয়, টাঁকশালেরও নজর পড়েছে বিদ্যুতের দিকে। কলকাতার ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েটে খরচের কথা ভেবে সরকার রাজি হলেন না, কারণ পাখা আর বছরের কত দিন চালানো যাবে! কিন্তু স্ট্র্যান্ড রোডের টাঁকশাল পিছিয়ে থাকতে রাজি হল না, তারা ১৯০৪ সালে বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় সুস্বাগতম জানাল। তাই দেখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও এগিয়ে এল একই বছরে।

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কলকাতার কারা প্রথম বিদ্যুতের সুবিধে পেলেন? একটা পুরনো খবরের কাগজের রিপোর্ট উল্লেখ করে শুভব্রত সরকার জানাচ্ছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডিসেম্বর ১৮৯৮ থেকে যে-সব ঐতিহাসিক বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল ক্লাব, ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল এবং কয়েকটি প্রাইভেট বাড়ি। কলকাতা হাইকোর্ট পাংখা-র বদলে ইলেকট্রিক ফ্যানের সিদ্ধান্ত নিল ১৯ আগস্ট ১৮৯৯।

বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে নবাগত টেকনোলজির নানা খবরাখবর। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, কলকাতায় বিদ্যুতের শুভাগমন প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা ভাল চোখে দেখেননি, তখন ছিল বাড়ি ইলেকট্রোকিউশনের ভয়। পূর্ণিমার সাহসী পিতৃদেব সব আশঙ্কা সরিয়ে বিদ্যুতের আবেদন করলেন। উৎসাহী সিইএসসি কোম্পানি বৈদ্যুতিক কানেকশনের জন্য ঠাকুরবাড়িকে কোনও চার্জ করেননি— তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন পূর্ণিমা দেবী।

তথ্যসূত্র:

Engineering & Entrepreneurship in colonial Bengal–Suvobrata Sarkar–Cambridge University Press;

বাংলার কারখানা ও কারিগরি বিদ্যার ইতিহাস—জিতেন্দ্রনাথ রায়, দে’জ পাবলিশিং; প্রবন্ধ সংগ্রহ— সিদ্ধার্থ ঘোষ, বুক ফার্ম ১ম ও ২য় খণ্ড

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengalis Technology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE