Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৪

শেষ নাহি যে

দরিয়ার চা খাওয়া শেষ। দুটি ছেলেমেয়ে কলকাতা শহরের রাস্তা দিয়ে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় অফিস-ফেরতা মানুষের ঢল নেমেছে। তিলধারণের স্থান নেই।

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: সনৎ ফোন করে জানতে চায় বিহান কোথায় আছে। কিন্তু কেন সে বিহানের খোঁজ করছে তা বলতে চায় না। এ দিকে বিহানের মন চলে যায় অতীতে। নানা স্মৃতির ফাঁকে তার মনে পড়ে অভিভাবকদের লুকিয়ে এক দিন দরিয়া ও মণিদীপার সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে আসার কথা।

দরিয়া বিহানের কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”

চায়ের ভাঁড় ডাস্টবিনে ফেলে, দুটো চায়ের দাম মিটিয়ে বিহান বলল, “সরস্বতী পুজোর দিন তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমাকে আমি ভালবাসি। মানে, ভালবাসা কাকে বলে আমি জানি না। তাও...”

দরিয়ার চা খাওয়া শেষ। দুটি ছেলেমেয়ে কলকাতা শহরের রাস্তা দিয়ে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় অফিস-ফেরতা মানুষের ঢল নেমেছে। তিলধারণের স্থান নেই। বাস, প্রাইভেট গাড়ি আর ট্যাক্সির উপদ্রবে রাস্তা পেরোনো অসম্ভব ব্যাপার। দরিয়া সন্তর্পণে বিহানের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমার কাছ থেকে তুমি কী শুনতে চাও? আমি তোমাকে ভালবাসি কি না?”

বাসকে পাশ কাটিয়ে, ট্যাক্সিকে ডজ করে, পথচারীদের গুঁতো খেয়ে রাস্তা পেরোল দু’জনে। বিহানের হাত ছাড়েনি দরিয়া। ওপারের ফুটপাতে উঠে বলল, “হ্যাঁ বিহান। আমি তোমাকে ভালবাসি। এই যে তোমাকে ছুঁয়ে আছি, এতেই আমি খুশি। এই যে তোমার চুলে হাত বোলাতে পারছি, এতেই আমি খুশি। এখন মরে গেলেও আমার আর কোনও দুঃখ থাকবে না। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কায়দা যদি জানতাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম। কিন্তু সেটা জানি না। তুমি ছাড়া নিজেকে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়।”

“অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ ভায়া?’’ জিজ্ঞেস করল সুদাম। চটকা ভেঙে বিহান দেখল, ট্রেন বাহারবেড়িয়া জংশনে দাঁড়িয়ে। এটা বেশ বড় স্টেশন। এখান থেকে হাওড়া পৌঁছতে বেশি ক্ষণ লাগার কথা নয়। বিহান বলল, “কী আর ভাবব? বৌটার কথা ভাবছিলাম। কখন যে ওর কাছে পৌঁছতে পারব...”

“গিন্নিকে খুব ভালবাসা হয়?” ভাববাচ্যে জিজ্ঞেস করল সুদাম।

উত্তর না দিয়ে হাই তুলে বিহান বলল, “ক’টা বাজে গো?”

সুদাম বলল, “সাড়ে বারোটা। ট্রেন ঠিকঠাক চললে বাহারবেড়িয়া থেকে হাওড়া স্টেশন পাক্কা এক ঘণ্টা।”

“এখনও পর্যন্ত তো ঠিকই চলছে,’’ বলল বিহান। তার কথার মধ্যে কিশোর বললেন, “আর চলবে বলে মনে হয় না। খরাজ পার্টির লোকেরা আমাদের ধরে খুব পেটাচ্ছে। এ বার আমাদের পাল্টা মার দিতেই হবে।”

সুবীর তাঁর থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, “ও লে বাবা লে! কী মিত্তি ছেলে সব। সারা রাজ্য জুড়ে লুঠতরাজ চালিয়ে এখন ভিকটিম কার্ড খেলা হচ্ছে।”

আবার ঝগড়া শুরু হয়ে গিয়েছে কিশোর আর সুবীরের মধ্যে। ট্রেনের যাত্রীরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে চেঁচাচ্ছে। তার মধ্যে বেজে উঠেছে বিহানের ফোন। তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বার করে সে দেখল সাম্যব্রত ফোন করেছেন।

কানে ফোন দিয়ে বিহান বলল, “হ্যালো!”

“তুমি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলেন সাম্যব্রত।

বিহান উত্তর দিল, “বাহারবেড়িয়া জংশন। আর ঘণ্টাখানেক লাগবে। দরিয়াকে একবার ফোন দিন।”

সাম্যব্রত নিচু গলায় বললেন, “ও একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

“একটু অসুস্থ মানে?” চিৎকার করে উঠেছে বিহান, “কী হয়েছে ওর?”

সাম্যব্রত বললেন, “তুমি রাস্তায় রয়েছ। উত্তেজিত হোয়ো না। এক্ষুনি মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল। তুমি তাড়াতাড়ি এসো, প্লিজ়!”

বিহান কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিয়েছেন সাম্যব্রত। কারণ এক জন সেবিকা কোমরে হাত দিয়ে, ভুরু কুঁচকে তাঁকে দেখছে। সাম্যব্রত ফোন কাটতেই সেবিকা বলল, “আমি আপনাকে ডেকে পাঠালাম যাতে মেয়ের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে পারেন। আপনি এসেই মিডিয়াকে ফোন করা শুরু করে দিলেন?”

সাম্যব্রত অবাক হয়ে বললেন, “মিডিয়া? আমি তো জামাইকে ফোন করেছিলাম।”

“আপনাদের ওই সব কোড ওয়ার্ড আমি জানি না ভেবেছেন?” গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাচ্ছে সিস্টার, “মামা মানে পুলিশ, জামাই মানে মিডিয়া, ভাইপো মানে পাড়ার গুন্ডা— সব জানি।”

“বিশ্বাস করুন দিদি! আমি আমার মেয়ের বরকে ফোন করেছিলাম। কোনও মিডিয়াকে চিনি না।”

“সব্বাই তাই বলে,” কাঁসরের মতো গলায় বলল সিস্টার, “এর পর পেশেন্ট মরে গেলে জামাইদের নিয়ে চলে আসে। তাই না মন্টুদা?”

মন্টু ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে দরিয়ার মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “যা বলেছেন নমিতাদি। এক্কেবারে খাঁটি কথা।”

জলের ঝাপটায় দরিয়ার জ্ঞান ফিরেছে। সে সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, “বিহান এসেছে?”

“না। আমি এক্ষুনি ওকে ফোন করেছিলাম। সিস্টার বকাবকি করলেন বলে লাইন কেটে দিলাম,” নিচু স্বরে বললেন সাম্যব্রত।

নমিতা সিস্টার গলা আবার চড়িয়ে বলল, “মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে। পেশেন্ট পার্টি বাইরে যান।”

সাম্যব্রত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। মন্টু ট্রলি ঠেলে একটা বড় হলঘরে দরিয়াকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে বেরিয়ে গেল।

দরিয়া বুঝতে পারছে, এটা লেবার রুম। আশেপাশে হবু মায়েরা শুয়ে। হঠাৎ ‘ট্যাঁ ট্যাঁ’ করে বাচ্চার গলার আওয়াজ শোনা গেল।

সদ্যোজাত শিশুর কান্না শুনে বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে এল দরিয়ার। তার মধ্যে অজস্র অনুভূতি খেলা করছে। কখনও ভয় করছে, কখনও দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কখনও বিহানের উপরে তীব্র অভিমান হচ্ছে। পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে, তার গর্ভের সন্তান বিহান আর তার ভালবাসার ফসল। বিহানকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।

দরিয়ার চিন্তাস্রোতে বাঁধ দিতে চলে এসেছে নমিতা সিস্টার। খ্যারখ্যার করে বলছে, “গুনগুন মাসি, এ দিকে এসো।”

গুনগুন মাসি আবার কে? ঘাড় ঘুরিয়ে দরিয়া দেখল, বছর ষাটের এক মহিলা দুটো সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাগুলোকে রেলিং দেওয়া কটে রেখে দরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এর স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে। বদলে দিই?”

“দাও,” ছোট্ট উত্তর দিল নমিতা সিস্টার। সে এত ক্ষণ দরিয়াকে পরীক্ষা করছিল। হাত থেকে গ্লাভস খুলে বলল, “তোমার ডেলিভারি হতে দেরি আছে মা ঠাকরুন। এখন লেবার রুমে ঢুকে ভিড় বাড়িও না। ওয়ার্ডে গিয়ে শুয়ে থাকো।”

গুনগুন মাসি স্যালাইনের পাউচ বদলে দিয়েছে। ডেকে এনেছে মন্টুকে। তাকে দেখেই নমিতা সিস্টার চেঁচাল, “একে এখানে আনলে কেন? বাচ্চা হতে দেরি আছে। শিগ্‌গির মেটারনিটি ওয়ার্ডে নিয়ে যাও।”

মন্টু বলল, “আমি কী জানি! ঘোষ স্যর এখানে পাঠিয়ে দিলেন। এই মেয়েটার পায়ে বোমা লেগেছিল।”

“ইনজুরি?” নমিতা সিস্টারের চোখ কপালে উঠেছে, “একে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি না করে এখানে কে ভর্তি করল?”

“ঘোষ স্যার,” হাসছে মন্টু।

“লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কমপ্লিট ম্যাড,” আবার চেল্লাচ্ছে নমিতা, “মন্টুদা, তুমি টিকিট আর পেশেন্ট নিয়ে আবার ইমার্জেন্সিতে যাও। এই পেশেন্ট মেটারনিটি ওয়ার্ডে নয়, সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হবে।”

মন্টু আবার ট্রলি ঠেলে লেবার রুম থেকে বেরিয়েছে। সিমেন্টের চোকলা-ওঠা মেঝে দিয়ে ট্রলির নড়বড়ে চাকা যাওয়ার সময়ে সেটা থরথর করে কাঁপছে। কিছু ক্ষণ ট্রলি চলার পরে দরিয়া দেখল, তাকে আবার ইমার্জেন্সিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ট্রলি দাঁড় করিয়ে মন্টু বলল, “স্যর! নমিতা সিস্টার এই পেশেন্টকে ভর্তি নিল না।”

ডক্টর ঘোষ মোবাইলে কথা বলছিলেন। মন্টুর কথা শুনে ফোন কেটে বললেন, “এক জন পেশেন্টকে সিস্টার ওয়ার্ডে ভর্তি করতে চাইছে না! কেন জানতে পারি?”

মাথা চুলকে মন্টু বলল, “সিস্টার বলল, বাচ্চা হতে দেরি আছে। এখন একে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করে দিন। পায়ের সমস্যা মিটলে তার পরে মেটারনিটি ওয়ার্ডে যাবে।”

“আচ্ছা?” দরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে, কণ্ঠস্বরে শ্লেষ মিশিয়ে ডক্টর দত্ত বললেন, “রুগি কোন ওয়ার্ডে ভর্তি হবে, সেটা কে ঠিক করবে? ডাক্তার না সিস্টার? সিস্টারের এত সাহস হয় কী করে?”

“আমি জানি না স্যর,” মন্টু হাসছে। মন্টুর হাসি দরিয়ার বিসদৃশ লাগছে। পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়ার পরেও এই লোকগুলো তাকে একটা বেড জোগাড় করে দিতে পারছে না। সেই জন্যে কোনও লজ্জাও নেই। বোকার মতো হাসছে!

ডক্টর ঘোষের হাতে টিকিট দিয়ে মন্টু বলল, “আপনি যা করার করুন। আমি একটু বসি।”

মন্টু টুলে বসে পা নাচাচ্ছে। ডক্টর ঘোষ মোবাইলে কাউকে ধরেছেন। এ বার যেটা শুরু হল, সেটা শুনে কিছু ক্ষণের জন্য দরিয়া যাবতীয় শারীরিক এবং মানসিক অসুবিধে ভুলে গেল।

ফোনালাপ শুনে বোঝা যাচ্ছে, ওপারে রয়েছে নমিতা সিস্টার। ডক্টর ঘোষ বলছেন, “নমস্কার। আপনার একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যাবে? নিদেন পক্ষে সেলফি? অথবা খুরের ধুলো? হ্যাঁ হ্যাঁ, খুর। যাকে আমরা ভাল বাংলায় লেগ ডাস্ট বলি। আপনার লেগ ডাস্ট না নিলে আর কার নেব বলুন? আপনার পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। পেশেন্ট কোন ওয়ার্ডে ভর্তি হবে, সেটা আপনি যে ভাবে এক জন ডাক্তারকে ডিক্টেট করছেন তাতে আমি আপ্লুত। সেই কারণেই অটোগ্রাফ চাইছিলাম!”

ও দিক থেকে নমিতা সিস্টার কী বলল শোনা গেল না। কিন্তু এ দিকে ডক্টর ঘোষের মুখচোখ বদলে গেছে। তিনি মন্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সর্বনাশ। সিস্টার এখানেই আসছে। আজ আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

ডক্টর ঘোষের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমার্জেন্সিতে চলে এসেছে নমিতা সিস্টার। সে গটগট করে ডক্টর ঘোষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এ বার বলুন।”

ডক্টর ঘোষ মিনমিন করে বললেন, “পেশেন্ট কোন ওয়ার্ডে ভর্তি হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আপনার না আমার?”

নমিতা সিস্টার কিছু ক্ষণ ডক্টর ঘোষের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরে বিকট চিৎকার করে বলল, “মেটারনিটি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকার সময়ে ইনজুরির কারণে পেশেন্ট মারা গেলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আপনি?”

দরিয়া অবাক হয়ে ভাবল, এরা সবাই ভাবছে কেন যে সে মরে যাবে? তার তো কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে না। তা হলে?

নমিতার চিৎকার শুনে ডক্টর ঘোষ ধড়ফড়িয়ে উঠে বললেন, “ঠিক আছে! ঠিক আছে। অত চেঁচাতে হবে না। আমি পেশেন্টকে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করছি। এ বারে চুপ করুন, প্লিজ়!”

“যা বলি আপনার ভালর জন্যেই বলি। কথাটা মনে থাকে না কেন?” নাক সিঁটকে বলল নমিতা সিস্টার। তার পরে জুতোর টকাটক আওয়াজ তুলে লেবার রুমে চলে গেল।

ইমার্জেন্সিতে এখন নীরবতা। ভাগ্য ভাল যে অন্য কোনও পেশেন্ট নেই। ডক্টর ঘোষ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মন্টুর দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “বোকার মতো হাসছ কেন? যাও! মেয়েটাকে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করে দাও।”

“ঠিক আছে স্যর!” এখনও হাসছে মন্টু।

দরিয়ার জন্য আবার নতুন বেড টিকিট বানানো হল। ডক্টর ঘোষ নতুন নিদানপত্র লিখলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Indranil Sanyal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE