Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ধা রা বা হি ক র হ স্য উ প ন্যা স

স্বাধীনতা তুমি...

একটা জিনিস কিন্তু অলকেশকে ভাবাচ্ছে। তাঁর দৈনন্দিন কাজের জগৎটা নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবার লোক নন অলকেশ। যেটুকু কাজ না দেখালেই নয়, তার বেশি কাজ করা, বা সে কাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পক্ষপাতী নন তিনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৩
Share: Save:

• (গত সংখ্যার পর) •

একটা জিনিস কিন্তু অলকেশকে ভাবাচ্ছে। তাঁর দৈনন্দিন কাজের জগৎটা নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবার লোক নন অলকেশ। যেটুকু কাজ না দেখালেই নয়, তার বেশি কাজ করা, বা সে কাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পক্ষপাতী নন তিনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না।

কয়েকটা প্রশ্ন। সারা দিনের বিরক্তি, হতাশা, ক্লান্তির অবসন্ন ধোঁয়াশার মধ্যেও ছোট্ট একটা অনুজ্জ্বল টুনি লাইটের মতো ক্রমাগত জ্বলছে, নিভছে, আবার জ্বলে উঠছে। স্পষ্ট দেখা যায় না। আবার অগ্রাহ্য করাও যায় না। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, হিজড়েরা আর পাঁচ জনের মতো ট্রেনে যাওয়া আসা করে না তা নয়, তবে সচরাচর তাদের দেখা যায় যূথবদ্ধ ভাবে চলাফেরা করতে। অন্ততপক্ষে চার-পাঁচ জনের একটা ছোট দল নিয়ে তারা ঘোরাফেরা করে। সেটা সামাজিক নির্যাতনের ভয়ে কি না, অতশত ভেবে দেখার কখনও প্রয়োজন বোধ করেননি অলকেশ!

কিন্তু এ একা কোথায় যাচ্ছিল?

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, একটা গুলি হৃদ্‌যন্ত্র ফুঁড়ে রিব কেজ-এ আটকে গেছে। একটা বাড়তি নিশ্বাস ফেলারও সময় পায়নি লোকটি। গুলি করল কে? কী ভাবে করল? একটা দূরপাল্লার ট্রেনের জনাকীর্ণ কামরায় এক জন আর এক জনকে গুলি করল আর কেউ দেখতে পেল না? এটা সম্ভব? এল কোথা থেকে গুলিটা?

প্রশ্নচিহ্ন, পুনশ্চ?

‘গুলির আঘাতে তাহার মৃত্যু ঘটিল ইহা সত্য, কিন্তু সেই গুলি কোথা হইতে আসিল তাহা কেহই বলিতে পারিল না! একটি নহে, দুইটি নহে, পর পর পাঁচটি গুলি। কিন্তু মামলা যখন আদালতে উঠিল, তখন সরকার পক্ষ এমন কোনও সাক্ষী পেশ করিতে পারিলেন না যাহারা অভিযুক্তদের শনাক্ত করিতে পারে, অথবা আদালতে বর্ণনা করিতে পারে সেদিন ঠিক কী ঘটিয়াছিল! অথচ ঘটনাটা ঘটিয়াছিল প্রকাশ্য দিবালোকে, বিদ্যালয়ের জনাকীর্ণ প্রাঙ্গণে!

‘সে সব আজিকার কথা নহে। যে সময়ের কথা লিখিতেছি তখন সরকারের উচ্চতম স্তরের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র ছিল না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা পশ্চিমি দুনিয়ায় শুরু হইয়া গিয়া থাকিলেও ভারতবর্ষে তখন তাহা সুদূরপরাহত। স্থানে স্থানে চলচ্চিত্র গ্রহণ যন্ত্র বা ‘সিকিউরিটি ক্যামেরার’ আবির্ভাব তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। মেদিনীপুরের মতো মফস্‌সল শহরে তাহার প্রচলনের সামান্যতম সম্ভাবনাও তখন উন্মোচিত হয় নাই, বলাই বাহুল্য।

‘আজিকার দিনে যাঁহারা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভি আই পি’র শিরোপায় ভূষিত হন, স্বগৃহের নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করিয়া বহির্বিশ্বে পদার্পণ করা মাত্রই যে ধরনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী তাঁহাদের চতুর্দিকে রচিত হয় সেকালে তাহার লেশমাত্রও ছিল না। ইহার অর্থ অবশ্য এই নহে যে ইংরাজ রাজন্যবর্গ সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রাজপথে নির্গত হইতেন। সিপাহি, সান্ত্রি, পাইক, বরকন্দাজ তাঁহাদের সঙ্গে ভাল মতোই থাকিত। কিন্তু তাহাদের সশস্ত্র উপস্থিতিই জনসাধারণের মধ্যে ভীতির উদ্রেক করিবে, অস্ত্র ব্যবহার করার প্রয়োজন তাহাদের কখনও হইবে না, এই রূপ একটা মনোভাবই তখন বিদেশি শাসকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ইহা যে শুধুমাত্র চূড়ান্ত অহংবোধ প্রসূত তাহাই নহে, তৎসহ ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞারও পরিচায়ক। সেই দিন, উনিশ’শো একত্রিশ খ্রিস্টাব্দের সাতই এপ্রিল, আমার দুই অগ্রজপ্রতিম সুহৃদ বিমল দাশগুপ্ত এবং জ্যোতিজীবন ঘোষ বন্দুকের মাধ্যমে এই অসূয়া, তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞার প্রতিই প্রত্যাঘাত করিয়াছিলেন।

‘জেম্স পেডি তখন মেদিনীপুরের জেলাশাসক। তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষা-সংক্রান্ত একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করিতে সভাস্থলে উপস্থিত হইয়াছিলেন। সেই স্থলে ওই দুই নির্ভীক তরুণ তাঁহাকে লক্ষ করিয়া গুলি চালায়। এত দিন পরে স্মৃতি মাঝেমধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, কিন্তু যত দূর মনে পড়ে বিমলদার গুলিতেই জেমস পেডি নিহত হন। বিমলদা এবং জ্যোতিদা ঘটনাস্থল হইতে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হইয়া যান। সিপাহি-সান্ত্রিরা কেহ তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিতে সাহস করে নাই। আমি তখন বালকমাত্র। সেই দিন সভাস্থলে আমি আমার পিতৃদেবের সহিত উপস্থিত ছিলাম। বিমলদাকে চিনিতে পারিয়া উত্তেজনাবশত তাঁহার নাম ধরিয়া “বিমলদা” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া উঠিয়াছিলাম। আমার ওই অপরিণামদর্শিতার ফলেই বিমলদার পরিচয় প্রকাশ হইয়া যায়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে বিচারপতির পক্ষে বিমলদাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা সম্ভব হয় নাই। তাঁহার দ্বীপান্তর হইয়াছিল। উনিশ’শো উনচল্লিশ সন অবধি বিমলদা আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার কারাগারে বন্দি ছিলেন।

‘বিমলদা এবং জ্যোতিদা আমার নিতান্ত পরিচিত। তাঁহাদের আমি অগ্রজের আসনে অধিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। তাঁহারাও অগ্রজের স্নেহে ও প্রশ্রয়ে আমার মনকে সিঞ্চিত করিয়াছিলেন। আমি যে দ্বাদশ বৎসর বয়সেই অগ্নিযুগের আদর্শে দীক্ষিত হই, তাহার সূত্রপাত উহারাই ঘটাইয়াছিলেন। ইহা আমার আত্মশ্লাঘার কারণ। তাঁহারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করিয়া দেশমাতৃকার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। সেই দিন দূরদর্শন যন্ত্রে দেখিলাম, জনৈক ইতিহাসবিদ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী বলিয়া অভিহিত করিলেন। বিমলদা এবং জ্যোতিদা আজিকার বিচারে সন্ত্রাসবাদী? তাঁহারা এই মর্মে চিহ্নিত হইতে পারেন, এই সম্ভাবনায় আমি শুধু বিস্মিত হই নাই, গভীর দুঃখে নিমজ্জিত হইয়াছি। বিমলদা এবং জ্যোতিদার তখন কতই বা বয়স? ওই ঘটনার সময় বিমলদা ছিলেন একবিংশতি বৎসরের তরুণ। জ্যোতিদার বয়সও বোধকরি অনুরূপ। তাঁহারা ব্যক্তিগত জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়া, জীবনসংশয় তুচ্ছ করিয়া এক অত্যাচারী বিদেশি শাসককে হত্যা করিয়াছিলেন।

‘জেম্স পেডি ইংরাজ। ভারতবর্ষের এক প্রান্তে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ভিত আরও সুদৃঢ় করা ছিল সেই ব্যক্তির লক্ষ্য। তাহার শাসনে যাহারা দিনাতিপাত করিত, সেই সব গরিব নিরন্ন গ্রামবাসীকে ক্রমাগত শোষণ করা ছিল তার কর্মজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। বিস্তীর্ণ মেদিনীপুর জিলার প্রত্যন্ত গ্রামেও দরিদ্র কামার-কুমোর-জেলে-জোলা-কৃষক কেহই তাহার রোষদৃষ্টির কোপমুক্ত ছিল না।

‘বিমল এবং জ্যোতির লক্ষ্য ছিল ওই ব্যক্তি, আর কেহ নহে। তাহাদিগের সেই অকুতোভয় অভিযানে নিহতের সংখ্যা এক। ইহার সহিত ক্যানাডার মন্ট্রিয়ল শহর হইতে দিল্লি অভিমুখে যাত্রারত ভারতের জাতীয় বিমানসংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে বিস্ফোরণ ঘটাইয়া কয়েক শত নিরপরাধ নারী, পুরুষ এবং শিশুকে মধ্যগগনে নির্মম ভাবে হত্যা করার কোনও তুলনা হয়? পেডিকে হত্যা করা আর কণিষ্ক নামক বিমানের নির্দোষ যাত্রীদের রক্তে স্নান করা এক? তাহা হইলে আর মনুষ্যত্বের অবশিষ্ট থাকিল কী? রবীন্দ্রনাথ কাহাকে, বা কাহাদের উদ্দেশ্য করিয়া লিখিয়াছিলেন, ‘পশুপাখি এমনিতে পশুপাখি, মানুষ বহু চেষ্টায় মানুষ?’

‘অবশ্য এই বাক্য লিখিতে গিয়া একটি বিপ্রতীপ চিন্তা উপস্থিত হইল। জেম্স পেডি কঠোর এবং অত্যাচারী জেলাশাসক ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাঁহার আকস্মিক মৃত্যু কি আরও কয়েকটি নির্দোষ জীবনে বিপর্যয় ডাকিয়া আনে নাই? জেমস পেডি কী বিবাহিত ছিলেন? তাঁহার কি পুত্র-কন্যা ছিল? এখন এ তথ্য আমি আর অবগত নহি। কোনও কালে জানিতাম কি না তাহাও মনে করিতে পারি না। মৃত্যুর সময় কত বয়স হইয়াছিল ভদ্রলোকের? উহার পিতা-মাতা কি জীবিত ছিলেন? বহু দূর বিদেশের মাটিতে সন্তানের অকালমৃত্যুতে তাঁহারা কীরূপ শোক পাইয়াছিলেন?

‘আজ জীবনের উপান্তে আসিয়া যাহাকে আমরা শত্রু ভাবিয়া হত্যা করিয়াছিলাম তাহার সম্বন্ধে জানিতে ইচ্ছা করে। যে ব্যক্তিকে অত অত্যাচারী জেলাশাসক হিসাবে আমরা দেখিতাম, শৈশব, কৈশোরে সে কেমন ছিল? ইংলন্ডের কোন অঞ্চলে তাহার জন্ম? কাহাদের কাছে তাহার শিক্ষালাভ? তুমি কি আমাকে কোনও রূপে জেম্স পেডির অতীত জীবন সম্বন্ধে কোনও তথ্য সংগ্রহ করিয়া দিতে পারিবে? তাহা হইলে এই বৃদ্ধ বয়সে নিতান্ত উপকৃত বোধ করিব। অবশ্য তুমি এই কার্য সমাধা না করিতে পারিলেও যে সমাজের বিরাট কোনও ক্ষতি সাধন হইবে তাহা নহে!

‘জীবনের গতিপথ বিচিত্র। যে দেশের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র আজ সেই ব্রিটেনের নাগরিক! ইহাকে অদৃষ্টের পরিহাস ব্যতীত আর কী বলিব? ভাবিও না, তোমার প্রবাসে থাকার সিদ্ধান্ত লইয়া আমার কোনও অনুযোগ বা অভিমান আছে। তাহা নহে। তোমার প্রবাসজীবন যে সুখের হইয়াছে, তাহা আমি অবগত আছি। জীবন কাহারও নিয়ম অনুযায়ী অগ্রসর হয় না। তোমার জীবন চলে তোমার নিয়মে, আমার জীবন অতিবাহিত হয় আমার নিয়মে।

‘এ যাত্রায় তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইল না। ইহা আমারই দুর্ভাগ্য। ইন্দ্রাণী লিখিয়াছে তুমি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার উদ্দেশ্যেই দিল্লিতে আসিয়াছিলে। তুমি দিল্লিতে উপস্থিত হইবার দুই দিন পূর্বেই আমি হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিতে বাধ্য হই। আশ্রম হইতে গুরুদেব আমাকে স্মরণ করিয়াছিলেন। নিতান্ত জরুরি প্রয়োজনেই। আর তোমরা তো অবগত আছ যে বিশ্বসংসারে ওই একজন ব্যক্তির আদেশ আমি লঙ্ঘন করিতে অক্ষম! তুমি আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করিও। বধূমাতা এবং বুম্বাকেও আমার স্নেহাশীষ জানাইও। বুম্বা এখন কত বড় হইয়াছে?

‘তুমি দুর্গাপূজার সময় অন্যান্যবারের মতো এইবারেও সপরিবারে কলিকাতায় আসিবে কী? আসিলে সাক্ষাৎ হইবে অবশ্যই। অবশ্য যদি জীবিত থাকি! জেম্স পেডি হত্যা মামলায় যে চৌদ্দজন অভিযুক্ত হইয়াছিলেন তাঁহারা কেহই এখন আর জীবিত নাই। কোথা হইতে খবর পাইয়া, পুলিশ আমার সন্ধানে আসিয়াছিল। কিন্তু তখন আমার বয়স দশ বৎসর মাত্র। তাই তাহারা আমাকে গ্রেফতার করে নাই! প্রধান ষড়যন্ত্রকারী বলিয়া যাঁহারা সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ক্ষীরোদদা, প্রফুল্লদা, পরিমলদা, ফণিদা, অর্থাৎ ফণিভূষণ কুণ্ডু, সকলেই আজ মৃত। গত কয়েক বৎসর যাবৎ, মৃত্যুচিন্তা আমার মনের দুয়ারেও ইতস্তত করাঘাত করিতেছে। তুমিও লিখিয়াছ যে দিল্লি হইতে ফিরিবার পথে এক ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুর তুমি সাক্ষী। সেই ব্যক্তি কে, কিছু জানিতে পারিলে কী?’

চিঠি থেকে মুখ তুলে তাকাল অর্ণব। বদ্ধ বাতাসে এক ঝলক রজনীগন্ধার সৌরভ। এত ক্ষণ স্মৃতির অতলে ছিল মন, কখন যে সুবেশিনী বিমানবালিকাটি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি। মেয়েটি বেশ সুন্দরী। পরিপাটি পোশাকে রজনীগন্ধার আঘ্রাণ। হাসিমুখে ঝুঁকে আছে তার দিকে।

‘ক্যান আই গেট ইউ এনিথিং স্যার? এনি ড্রিঙ্ক? ওয়াটার পারহ্যাপস?’

এমিরেটস-এর আন্তর্জাতিক এই উড়ানটির খুব প্রশংসা শুনেছিল অর্ণব। আগে সে অন্য বিমানে কলকাতা যাওয়া-আসা করত। এদের সঙ্গে এ বারই প্রথম। ব্যবস্থা সত্যিই ভাল। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের ফার্স্ট ক্লাস বা বিজনেস ক্লাসে খাওয়া-দাওয়া এমনিতেই বেশ ভাল থাকে। এদের তো একেবারে অসাধারণ ভাল। ফার্স্ট ক্লাসের আসনগুলি এত সুন্দর ভাবে বিন্যস্ত যে প্রতিটি যাত্রীর অপর্যাপ্ত জায়গা, এমনকী আরামে পা ছড়িয়ে ঘুমোবার ব্যবস্থা পর্যন্ত আছে। বিমান-সেবিকাদের ব্যবহার ভদ্র, যেটা আজকাল সব আন্তর্জাতিক উড়ান সম্বন্ধে বলা যায় না। এই মেয়েটি তো অসামান্যা সুন্দরী।

‘কুড আই হ্যাভ আ স্মল হুইস্কি প্লিজ? জাস্ট আইস, নো ওয়াটার?’

আকাশপথে খুব একটা মদ্যপান করে না অর্ণব। ফ্লাইটে একটু বেশি ড্রিঙ্ক করলেই তার মাথা ধরে যায়। আজ কেন যেন মনে হল, শরীর চাইছে একটু পানীয়। দামী হুইস্কিতে চুমুক দিতেই আবার অমিয়ভূষণ মুখোপাধ্যায় এসে দাঁড়ালেন চোখের সামনে! এ কথাটাও তো কখনও জানানো হয়নি বাবাকে! অর্ণবের প্রবাস-জীবন ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি ভদ্রলোকের, তবু নিজের কঠোর নীতিবোধের নিরিখে মেনে নিয়েছেন। এই অভ্যাসটার কথা জানতে পারলে কী বলতেন?

তামাক কোনও দিন স্পর্শ করেননি বাবা। পান, বিড়ি, সিগারেট কোনওটার ধার দিয়েও যাননি কোনও দিন। তাঁর প্রজন্মের শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই ধূমপায়ী। অমিয়ভূষণের তিন ভাই। তিন জনই ধূমপান করেন, নানা ভঙ্গিমায়। অর্ণবের এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে বড় কাকা অম্লানভূষণের ঠোঁটের কোণে কামড়ে ধরা পাইপ। পরনে কেতাদুরস্ত স্যুট। ভাইদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে সাহেব। ধানবাদের কাছাকাছি একটা কয়লাখনিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, পরে কোল ইন্ডিয়ার বড় অফিসার। বাইরের মোড়কটা দেখলে মনে হয় বড় দাদার একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ। কিন্তু পরিবারের লোকজন জানে, এই দুই ভাই আসলে একই ছাঁচে তৈরি।

দুজনেই কেতাদুরস্ত— অমিয়ভূষণের ধবধবে সাদা, পাটভাঙা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি, পরিপাটি চাদর, অম্লানভূষণের দামি থ্রি-পিস স্যুট, কাফ-লিংক দেওয়া ধবধবে শার্ট, সিল্কের টাই-এ রুচিশীল আভিজাত্যের ছাপ, কোটের পকেট থেকে উঁকি মারছে তিন কোনা আকারে ভাঁজ করা রুমাল। দুই ভাই-ই প্রচুর লেখাপড়া করেন। অমিয়ভূষণের পছন্দ সাহিত্য, বিশেষত বাংলা
গল্প-উপন্যাস, কবিতা। অম্লানভূষণ ইংরেজি ভাষার অনুসারী, নন-ফিকশন, অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান, নানা বিষয়ে নানা ধাঁচের প্রবন্ধ তাঁর অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র। তবে স্যুট-বুটের মোড়কে ঢাকা থাকলেও বড়কাকা মানুষটি বাবার থেকে অনেক বেশি স্নেহশীল।

শৈশব থেকেই অমিয়ভূষণ-আরোপিত একটা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার ঘেরাটোপের মধ্যে বড় হয়েছে অর্ণব এবং তার ভাই-বোনেরা। তার শৈশবের সেই বৃহৎবৃত্ত, যৌথ পরিবার। হিন্দুস্থান রোডের উপর ঠাকুরদার তৈরি বিশাল চারতলা বাড়ি। ঠাকুরদাকে দেখেনি অর্ণব। তারা বড় হয়েছে বাবা-কাকাদের দেখে। মা-কাকিমাদের অপার স্নেহ আর অনাবিল প্রশ্রয়ে। তিনতলা-চারতলা জুড়ে কড়ি-বর্গাওয়ালা বড় বড় ঘরগুলিতে ছড়িয়ে থাকত সেই স্নেহের উত্তাপ। শৈশবের গন্ধমাখা ছাদ। চারতলা টপকে দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বিশাল একটা উঠোনের মতো। শীতের পেলব দ্বিপ্রহর লুটিয়ে আছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। যে দিকে তাকাও ছাদে ছাদে ছড়িয়ে থাকা কলকাতা শহর। এক-একটা বাড়ির ছাদে, খোলা জানলার ফাঁক দিয়ে, শীতের দুপুরের গভীর, শান্ত, ঢিলেঢালা জীবনের টুকরো টুকরো ছবি।

• (ক্রমশ) •

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mystery Novel Rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE