Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

তন্ত্রধারিণী

তিনি বাগদি সম্প্রদায়ের মহিলা। শবরীমালায় যখন মেয়েদের প্রবেশ নিয়ে হুলস্থুল, হাওড়ার এক মন্দিরে কালীপুজো করেন তিনি। তিনি বাগদি সম্প্রদায়ের মহিলা। শবরীমালায় যখন মেয়েদের প্রবেশ নিয়ে হুলস্থুল, হাওড়ার এক মন্দিরে কালীপুজো করেন তিনি।

পূজারিনি: কালীমন্দিরে রুমা মালিক। ছবি: সুব্রত জানা

পূজারিনি: কালীমন্দিরে রুমা মালিক। ছবি: সুব্রত জানা

নুরুল আবসার
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ নিয়ে যখন বিতর্ক হচ্ছে, তখন অন্য রকম ছবি হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে। এখানে কালীমন্দিরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন রুমা মালিক। জাতিতে তিনি বাগদি। প্রতিদিন দু’বেলা মন্দির পরিষ্কার করা তো বটেই, পুরোহিত হিসাবে দু’বেলা নিত্যপুজোও করেন। এই সবই চলছে ২০০৭ সাল থেকে। মধ্যবয়সি রুমাদেবী স্নাতক, পৌরোহিত্য করার জন্য শিক্ষকদের কাছে সংস্কৃত শিখেছেন। ধারণ করেছেন উপবীত। তাঁকে পুজোর দায়িত্ব দিয়েছে মন্দির পরিচালন কমিটি।

মন্দিরটি পরিচালনা করে ‘জাগ্রত ভারত’ নামে স্থানীয় একটি সংস্থা। গত ৪০ বছর ধরে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করে আসছেন সংস্থার সদস্যেরা। কেন রুমাদেবীকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হল? মন্দির পরিচালন কমিটির কর্তারা জানান, নিচু জাতের মহিলারা তো বটেই, পুরুষরাও অনেক জায়গায় মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন না। সমাজের সেই অসাম্য ভাঙতেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এই সংস্থা প্রতি বছর সমাজের সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসারে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয় মাসিক বৃত্তি। এ বছরও স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করছে এমন এক মুসলমান ছাত্রীকে মাসিক বৃত্তি অনুমোদন করেছে সংস্থা। এক সময়ে পড়াশোনার জন্য এই সংস্থার কাছেই সাহায্য চাইতে আসেন রুমাদেবী। তাঁর বাড়ি পাশের গ্রাম শিবানীপুরে। তাঁকে তখন বইপত্র ও টাকা দিয়ে সহায়তা করা হয়। আমতা রামসদয় কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। এখন রুমাদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী হিসাবে কাজ করেন।

২০০৭ সালে এই কালীমন্দিরের পুজারী মারা যান। তার আগে থেকেই পুজোর কাজে তাঁকে সহায়তা করতেন রুমাদেবী। পুরোহিতের মৃত্যুর পরে মন্দির পরিচালন সমিতি পুজোর ভার রুমাদেবীর হাতেই পুরোপুরি তুলে দেন। পরিচালন সমিতির কর্ণধার, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শিশুতোষ সামন্ত বলেন, ‘‘আমি মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মানুষ। ছেলেবেলায় পড়াশোনা করেছি গ্রামের স্কুলে। জাতপাত নিয়ে কদর্যতা নিজের চোখে দেখা। আমি নিজেও তার শিকারও বটে। তাই ছাত্রজীবনেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সুযোগ পেলে জাতপাতের ভেদাভেদ রুখতে কিছু একটা করব।’’

শিশুতোষবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের এলাকায় নিচু জাতের মানুষকে অনেক জায়গায় মন্দিরে উঠতে দেওয়া হয় না। শাস্ত্র পড়ে দেখেছি, মন্দিরে ওঠার অধিকার সব মানুষের আছে। আছে পুজো করার অধিকারও। এই ব্যাপারে নারী-পুরুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। তবে পুজো করার যোগ্যতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে।’’ সেই লক্ষ্য নিয়েই রুমাদেবীকে মন্ত্রোচ্চারণ শিখিয়েছেন শিশুতোষবাবু। সংস্কৃত ভাষাও শিখিয়েছেন। তাঁকে উপবীত ধারণ করিয়েছেন। তার পরেই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্দিরের।

গোড়ায় বেশ বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল রুমাদেবীকে। তিনি বলেন, ‘‘আমাকে দেখে পুজো না দিয়ে ফিরে যেতেন অনেকে। কেউ পইতে দেখতে চাইতেন।’’ শিশুতোষবাবু নিজেও জানালেন, এক জন নিচু জাতের মহিলাকে কেন মন্দিরের দায়িত্ব দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন তুলে অনেকে তাঁকে প্রাণে মারারও হুমকি দিয়েছিলেন তখন।

রুমাদেবীকে উপবীত ধারণ করিয়েছেন যুগলকিশোর শাস্ত্রী, যিনি আবার পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক পুরোহিতও বটে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজে প্রাচীন কালে মেয়েদের সমস্ত রকমের ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। মধ্যযুগে এসে তা খর্ব হয়। কিন্তু শাস্ত্রে আছে, মহিলা বা পুরুষ হওয়াটা বড় কথা নয়, পুজো করার যোগ্যতাটাই আসল। রুমাদেবীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তিনি পৌরোহিত্য করার যোগ্য। তাই তাঁকে উপবীত ধারণ করিয়েছি।’’

উপবীতের প্রশ্নে আবার একটু ভিন্ন মত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির। তাঁর কথায়, ‘‘উপবীত ধারণ করার অর্থই তো ব্রাহ্মণ্যবাদকে মেনে নেওয়া। তা হলে আর সমাজে অসাম্য দূর হল কী ভাবে?’’ একই সঙ্গে এই উদ্যোগের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও শোনা গেল তাঁর গলায়। তিনি বললেন, ‘‘বাড়ির মহিলারা পুজো যে করেন না তা নয়। আবার বিশেষ অনুষ্ঠানে মহিলাদের পৌরোহিত্য করার কথাও শোনা যায়। কিন্তু এক জন অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলা এত বছর ধরে মন্দিরে টানা পৌরোহিত্য করে আসছেন, এমন ঘটনা বৈপ্লবিক না হলেও বিরলতম। এই রকম আমি শুনিনি।’’

কোনও অপমানই গায়ে মাখেননি রুমাদেবী। মন্দির ছেড়ে চলে যাননি। তিনি বললেন, ‘‘এখন সবাই আমাকে দিয়ে পুজো করান। অনেক মানুষ, বহু বড় ব্যবসায়ী পুজো দিতে আসেন। তাঁরা আমার হাত দিয়ে ছাড়া মাকে পুজো দেন না। এটা আমার বড় জয়।’’ আনন্দের জল তাঁর চোখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Female Priest Kali Temple Sabarimala
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE