ছবি: সুমন চৌধুরী
৫ মার্চ, ১৯৭৬। কোনও এক আদ্যিকালের কথা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের উলটো দিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গায়ে এক চিলতে সবুজ পরিসর, যেতে গেলে ঠিক একটি নালা পেরোতে হয়। সেখানে বইমেলার প্রথম আসর জমে, ৩৪টি প্রকাশক ও ৫৪টি স্টল।
ওই মাঠেরই একটেরে একটি ত্রিপল-ঢাকা জায়গায় ছিল ছ’টি মাত্র চার তাকের র্যাক, এলেবেলে প্রকাশক ও ছোট পত্রিকা কম টাকায় একটি করে র্যাক ভাড়া নিতে পারত। বন্ধুরা মিলে ‘অন্য অর্থ’ নামে সামাজিক অর্থনীতির একটি পত্রিকা বার করতাম, উৎসাহের খামতি ছিল না। বইমেলাতে পাওয়া এই জাহিরি সুযোগ কি ছাড়া যায়? বন্ধু ও বান্ধবীদের কাছে মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে পাবলিশার্স গিল্ডের বিমল ধরের দফতরে প্রয়োজনীয় টাকা জমা দিয়ে ‘অন্য অর্থ প্রকাশন’-এর নামে একটি র্যাক বুক করলাম।
কিন্তু ‘অন্য অর্থ’ তো মাত্র কয়েকটা সংখ্যা ছাপা হয়েছে। একটি তাকও ভরবে না। বন্ধুরা শলা করলাম। সমভাবাপন্ন ‘প্রস্তুতিপর্ব’ ও ‘কথাশিল্প’ থেকে, ‘সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা’ থেকে কিছু প্রকাশন নিয়ে তাক ভরলাম। ওই সবের পাশাপাশি রাখা হল শঙ্কর বসু (রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়)-র লেখা উপন্যাস ‘কমুনিস’, ‘অকালবোধন ও অন্যান্য গল্প’, থাকল ভারতের আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে কিছু পুস্তিকা। বাড়ি থেকে একটা পুরনো ট্রাঙ্কও জোগাড় করেছিলাম, সারা দিনের ব্যবসার হিসেব মিলিয়ে, র্যাকের বই ট্রাঙ্কে রেখে তালা দিয়ে, ওই র্যাকের সঙ্গেই শেকলে বেঁধে মাঠ ছাড়তে হত। শুভেন্দুই এই সব নজর রাখত। কাকে কত কমিশন দিতে হবে, না-বিক্রি হওয়া কপিও কে ফেরত পাবে, ‘অন্য অর্থ’-র ব্যবসায়ী হিসাবনিকাশে ভুল থাকলে চলবে না।
মনে আছে, এক দিন এক সম্ভ্রান্ত শান্ত চেহারার মহিলা আমাদের ‘অন্য অর্থ’ পত্রিকা খুব খুঁটিয়ে দেখে দু’-একটা সংখ্যা কিনলেন। তখনও র্যাকে জায়গা আছে। ঝোলা থেকে তিনটে মাত্র বই বার করে মহিলা বললেন, ‘তোমরা একটু রাখবে?’ কবিতার বই, লেখিকা বিজয়া মুখোপাধ্যায়। রেখেছিলাম, একটি কপি বিক্রিও হয়েছিল। মেলার শেষ দিনে মাঠে লেখিকাকে দেখতে পেয়ে বই বিক্রির পাওনা ও দুটো অবিক্রীত বই ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। মুখে হাসি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, দাম দিতে হবে না, আমাদের উদ্যোগে ওটাই ওঁর সাহায্য, আর বাকি বই দুটো সময় পেলে যেন আমরাই পড়ি। বই বস্তুপণ্য সেটা তো জানতাম, অর্বাচীন র্যাকওয়ালা হিসেবে প্রথম বইমেলায় আমার প্রথম হাজিরা। কিন্তু বেচাকেনার অঙ্গনে বই বিশিষ্ট অবয়বী, বিশেষ ব্যবহারে, ইঙ্গিতে ও কথায় ওই পণ্যের অবয়বী রূপ নিমেষে হৃদয়সংবেদী হয়ে ওঠে, বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের আচরণে সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। ওই বইমেলাতেই বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আর কোনও দিন যোগাযোগ হয়নি।
‘র্যাক’ থেকে ছোট স্টল, ‘অন্য অর্থ’-এর বিবর্তনটা ১৯৮৫ পর্যন্ত চলেছিল, তত দিনে বইমেলার বহরও বেড়ে গিয়ে বিড়লা তারাঘরের সামনে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। হিরণ মিত্রের তৈরি করা ‘অন্য অর্থ’ ও সিনে ক্লাব–এর ছিমছাম যুগ্ম স্টলে বন্ধুদের পালা করে ডিউটি পড়ত, স্টলের সুবাদে মেলায় যথেচ্ছ ঢোকবার ও বেরোবার দুটো ছাড়পত্র পেতাম। দুপুর থেকে রাত আটটা— আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া আর নানা স্টল ঘুরে বই নাড়াচাড়া করার ক্লান্তিহীন খেলা। মেলা প্রকাশনের বার্ষিকী মোচ্ছবে সবাই তখনও সড়গড়় হয়নি, অনেক স্টল পুরনো বইয়ের সম্ভার সাজাত, শেষ দুই দিন মাঠে বই-বাজারও হত। দু’-তিন বছরের মধ্যেই অবশ্য এ হেন বাজার পাবলিশার্স গিল্ড ফতোয়া জারি করে বন্ধ করে দেয়। এই সময়েই এক বার একরাশ বই কিনে অধ্যাপক নির্মল চন্দ আমাদের স্টলে কিছু ক্ষণের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। কী কী বই কিনলেন জিজ্ঞেস করতে অধ্যাপকমশাই মোক্ষম উত্তর দেন, ‘মাঝে মাঝে চেনা বইগুলি র্যাকে দেখি না, বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মেলার এক জায়গায় অনেক স্টল আছে, সেই পালিয়ে যাওয়া বইগুলির পুরনো কপি জোগাড় করে আবার Fill up the gap করছি আর কী।’
১৯৮০-র দশকে কলকাতার বইমেলা বা তখনকার ‘ক্যালকাটা বুক ফেয়ার’টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, নিয়মমাফিক ২৫ জানুয়ারি উদ্বোধন শুরু হয়। সময় গড়িয়ে চলে, উদ্বোধনী বক্তৃতার পাশাপাশি নানা দিনে একাধিক স্মারক বক্তৃতার আয়োজন হয়, বক্তাদের নামের তালিকাটি একেবারে দেশি-বিদেশি বিদ্বজ্জনদের ‘হু’জ হু।’ ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে মেলার ফোকাল থিমে থাকে নানা কালচার। মেলায় গ্লোবাল ও লোকাল কাটাকুটি খেলতে আরম্ভ করে, অসম, ওড়িশা, ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশ, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিলি, মেক্সিকো ও কিউবা।
তবে বড় পরিবর্তন ঘটে আড়াআড়ি সংযোগে। কলকাতা বইমেলার প্রাক্ বৃত্তে শুরু হতে থাকে নানা জেলার বইমেলা। আশির দশকের কয়েকটি বছর ডিসেম্বরে রবীন্দ্রসদনের উলটো দিকে সরকারি বইমেলাও চালু ছিল, অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলি ওই বইমেলা থেকেই বই কিনত। একাধিক বইমেলার টান ও প্রচারের সমবেত ধাক্কায় কলকাতার বইমেলায় লোকসমাগম বছর বছর বাড়তেই থাকে, জনসমাবেশের নিরিখে পৃথিবীর অনেক বইমেলাকে ছাড়িয়ে যায়। সরকারি বিদ্বৎ সংস্থাগুলির বাৎসরিক ঘুম ভাঙে, নানা সার্ভে প্রতিষ্ঠান তাদের গুদাম থেকে অসাধারণ সব প্রতিবেদন এই মেলার স্টলে ছাড় দিয়ে বিক্রি করে, লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রাঙ্গণও বড় হয়। পাইকারি লেনদেন নয়, খুচরো বিক্রিতে কলকাতার বইমেলা অন্য সব দেশের সবাইকে ছাপিয়ে যায়।
কেবল বই নয়, বেনফিশ থেকে চাউমিন ও ফুচকা— সব পাওয়া যেতে থাকে। শিল্পী ও পটুয়ারাও মাঠে তাঁদের পসরা নিয়ে বসেন। খোলা মাঠে কোপারনিকাসের তত্ত্বের বিরুদ্ধে নিজের বই এক জন লেখক জেহাদি সুরে গলা ফাটিয়ে একা বিক্রি করছেন— এ দৃশ্য কলকাতা বইমেলাতেই দেখা সম্ভব। সব মিলিয়ে শিষ্ট সংস্কৃতে মেলা হয়ে ওঠে ‘জনসংঘট্ট’। এই সমাবেশের ধাক্কাতে ১৯৮৮-তে বইমেলা ময়দানে চলে যায়। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে, আড়ে বহরে পরিসরের পরিমাপ হয় ২৩ একর।
তত দিনে ‘অন্য অর্থ’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু আমি বইমেলার নেশুড়ে হয়ে পড়েছি। মেলায় র্যাকওয়ালা হিসেবে আমার আর কোনও প্রবেশাধিকার নেই, সিজ্ন টিকিট কিনে ঢুকি। নিজেও ছোটখাটো ‘অথর’ হয়ে পড়েছি, সেই সুবাদেই ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘সুবর্ণরেখা’-র স্টলে বসতে পারি।
গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে আমাদের মতো অনেক মেলা-নেশুড়েরই ঠেক ছিল ‘সুবর্ণরেখা’। মধ্যমণি ইন্দ্রনাথ মজুমদার। বরাবরই চৌকোনা করে বিমল মজুমদার স্টলের বিন্যাস করতেন। ঢোকার মুখে লোকশিল্পের আদলে তৈরি খুপরিতে থাকত প্রকাশনের সদ্য ছাপা বই, ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বা ‘কলিকাতা দর্পণ’। চার পাশের র্যাকে বাঁধানো ‘এক্ষণ’ বা ‘ইতিহাস’ বা ভারতবিদ্যার নানা দুষ্প্রাপ্য বই, বিষয়ানুসারে সজ্জিত।
স্টলের মাঝখানে একটা বড় পাটাতন। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত লম্বা, উপরে হরেক রকমের বই ও পত্রিকার গাদা। ওই পাটাতনের চার পাশে নানা বয়সি ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকত, গাদা থেকে যে যার দরকার মতো বই বেছে কিনত। প্রতি দুপুরে দোকান খুললেই ওই পাটাতনে ঝাঁকা করে আরও বই ছড়িয়ে দেওয়া হত। বেছে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠক-পাঠিকার। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ‘পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন’। যেমন, এক বার ওই স্তূপের এক কোণে ছিল একরাশ ‘যেন ভুলে না যাই’, একেবারে মিনি গ্রিয়ারসন। বরিশালের কোনও এক মহিলা পুব বাংলার প্রতিটি এলাকার বাক্রীতি ও উচ্চারণে গল্প বলেছেন। এক বার আমি প্রাক্ সিগনেট প্রেস পর্বের ছাপা বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ খুঁজছিলাম। পাটাতনেই পেয়ে গেলাম ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে জগদানন্দ রায়ের লেখা বিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো। প্রচ্ছদসহ; রেখা ও রঙের কারিগরিতে প্রচ্ছদে বৈজ্ঞানিক সত্যকে দৃশ্যমান করা হয়েছে। এঁকেছেন নন্দলাল বসুর হাতে গড়া সে দিনের নবীন শিল্পীরা— বিনোদবিহারী, মণীন্দ্রভূষণ ও রামকিঙ্কর বেজ।
বইয়ের বিচিত্র সম্ভারের চেয়েও আকর্ষক ছিল ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ব্যক্তিত্ব। জেলা থেকে নানা লোকে স্টলে আসত, কারণ জেলার বইমেলায় তাদের চাহিদা মেটাতে ইন্দ্রদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। ওই স্টলে দেখা হত বসন্ত চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু পত্রী, নিখিল সরকার, সৌম্যেন মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে। সবার নিজস্ব চাহিদা। ইন্দ্রদা সবার সঙ্গে একই রকমের খাতিরদারি করতেন, ভেদাভেদ ছিল না।
১৯৮৯ থেকে মেলাতে বইয়ের ক্যাটালগ বেরোতে শুরু করে। তার আগে ও পরে কোনও স্টলে নতুন কী বই বেরোল, সেই সব তথ্যের ভাণ্ডারী ছিলেন ইন্দ্রদা। মেলায় বিহার, ওড়িশা, অসম বা ত্রিপুরা থেকে আসা বইওয়ালারা তাঁদের আনা পসরার খবর ‘সুবর্ণরেখা’-তে জানাতেন, সে খবরটুকু সঠিক খরিদ্দারের কাছে যথাসময়ে পৌঁছে যেত। আবার বেনফিশ কেমন মাছ ভাজছে আর কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া এসেছে কি না, সেই সংবাদও রসিক ইন্দ্রদার কাছে থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে সুবর্ণরেখা-তে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতাম, স্টলটাকে ঘিরে বইয়ের সওদা করতাম, মেলা ভাঙার আগের দিন লিস্ট মিলিয়ে বিন্ধ্যেশ্বর বইগুলি একটা গাড়িতে তুলে দিত, সম্বৎসরের মেলায় আমার এককালীন সংগ্রহ। টানা সাত-আট বছর এ ভাবেই চলেছিল। বইমেলায় ‘সুবর্ণরেখা’-র সেই সোনালি দিনগুলিতে বই কিনেছিলাম প্রচুর, কিন্তু জেনেছিলাম আরও বেশি। আর বিচিত্র বইপড়ুয়া দেখেছিলাম আরও অনেক বেশি।
এক বার বইমেলাতেই ঘুরতে ঘুরতে দেখি যে, দে’জ বুক-এর সামনে বসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর লেখা বইতে সই করে তরুণ-তরুণীদের দিচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে বলছিলেন, ‘দেখছ না, পেছনে বিভূতিভূষণ, মানিক, পরশুরাম আর সতীনাথ ভাদুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের বইগুলোতেও সই নাও। কেবল আমারটা নিলেই হবে?’ বইমেলাতে জড়ো হওয়া নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে এক লোচনদাস কারিগর ওই ভাষাতেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পরম্পরাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন।
মেলায় দেখা হত ঐতিহাসিক রত্নলেখা রায়ের সঙ্গে। তিনি এখন প্রয়াতা। কলেজে আমার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন, ‘দিদি’ বলে ডাকতাম। মেয়েকে পড়ানোর অছিলায় বিশ্ব সাহিত্যের নানা বিখ্যাত লেখকের রচনার বঙ্গীয় অনুবাদ কিনতেন। দেব সাহিত্য কুটির-এর ছাপানো কিশোর সংস্করণ। বুঝতাম যে, ওই বইগুলো উনি নিজেই আবার গোগ্রাসে পড়তেন, ফিরে যেতেন নিজের পুরনো পড়ার আনন্দজগতে।
কৈশোরে ওই বঙ্গীয় সাঁকো দিয়েই আমরা ছুঁতাম ডিকেন্স, রবার্ট লুই স্টিভেনসন বা দুমা-কে। পরে হয়তো দু’-একটা আসলি লেখা পড়তাম, তবে সেগুলো মাঝে মাঝে হয়ে উঠত ক্লান্তিকর পণ্ডিতি পড়া। ছেলেবেলার চেনা বিশ্বমানসের রোমাঞ্চকর জগৎকে ছুঁতে পুরনো গাইডদের প্রতি রত্নলেখাদি আস্থা রাখতেন। যেমন, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ রাহা বা মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। মেলায় এঁদের পেয়েও যেতেন কখনও পুরনো মোড়কে, কখনও বা নতুন তবকে।
১৯৯৭, কলকাতার বইমেলার ক্যালেন্ডারে এক ঘটনাবহুল বছর। জাক দেরিদার উদ্বোধনী ভাষণ ও মেলার ষষ্ঠ দিনেই আগুন লেগে গোটা বইমেলাটা পুড়ে যায়। ওই সব হাসি-কান্নার ইতিহাসের মধ্যে আমার স্মৃতিতে লালিত আছে আর এক কথা। উদ্বোধনী সভায় বই-টেক্সট নিয়ে দেরিদার ভাষণের উপর ‘অন্য অর্থ’-এর প্রাক্তন সম্পাদক অজিত চৌধুরী অননুকরণীয় ভঙ্গিতে এক লম্বা টিপ্পনী দেন। দেরিদা শোনেন ও বলেন যে, বক্তব্যটা হৃদয়ঙ্গম করতে তাঁর সময় লাগবে, পরে লিখে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। বইমেলায় ভাষণ ছাপাবার রীতি গিল্ড কর্তৃপক্ষদের নেই, দেরিদার প্রতিক্রিয়াও অন্য কোথাও নজরে পড়েনি। দেরিদা আমাদের অনুক্ষণ ভাবান। সেদিন অজিতের বক্তব্য দেরিদাকেও বেশ ভাবিয়েছিল, গ্লোবাল-লোকালের মোকাবিলায় লোকাল পাঞ্জা লড়ে গেল। বইমেলায় পাওয়া সেই আত্মপ্রসাদটুকু আজও ভুলিনি। অধম বাঙালির দুর্বলতার জন্য পোস্ট মর্ডানিস্ট পাঠক নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করবেন।
বইমেলার অর্থনীতি আছে, নববর্ষকে পিছনে রেখে বইমেলাতেই আজকের সব প্রকাশক তাঁদের নতুন বই প্রকাশ করেন, নানা অনুষ্ঠান করেন— বাংলা প্রকাশন বাজারে বড় একটা পরিবর্তন। আবার বইমেলা তো গণপরিসর, রাজনীতিও নানা স্তরে চলে। পরিবেশ রক্ষার দায় ও রাজনীতি থেকে ওঠা মামলা আদালতে গড়িয়েছিল। ফলে ২০০৭ থেকে গোটা বইমেলাই সল্টলেক স্টেডিয়াম ছুঁয়ে মিলনমেলায় চলে যায়। ২০১১ সালে মেলায় প্রবেশ অবাধ হয়, টিকিট আর লাগে না। এতদসত্ত্বেও মেলার সাহিত্যবাসরে এক বার আমন্ত্রণ পেয়েও সলমন রুশদি আসতে পারেননি, তবে সেই সব বড় ঘরের বড় কথা।
মেলায় রাজনীতির ইতিহাসটা আমি এক ভাবে পড়েছিলাম। ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়। এক বছর বাদে ১৯৯৪-এর জানুয়ারিতে মেলা প্রাঙ্গণে সাহিত্য অকাদেমি বড় মণ্ডপ তৈরি করে। সারা মণ্ডপ নানা মুখের ছবিতে শোভিত। নানা দিক থেকে উঁকি মারছেন ত্যাগরাজ ও গালিব, প্রেমচন্দ ও মহম্মদ হোসেন আজাদ, ইসমত চুগতাই ও আশাপূর্ণা দেবী। মণ্ডপের কেন্দ্রে ছিল রবীন্দ্রনাথ ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি। লতানো আল্পনার আকারে ছড়িয়ে আঁকা হয়েছিল নানা ভারতীয় ভাষার বর্ণমালা আর বর্ণের খুপরিতে ছিল ঠিক সেই ভাষার বই।
বই তো ভাবনার পরিসর ও প্রসার। সেদিন অকাদেমির মণ্ডপ ছাড়িয়ে আমার ভাবনা চলে গিয়েছিল ভারতীয় লোকসাধনার উপর বিনোদবিহারীর তৈরি ম্যুরালে ও সতীনাথের ঢোঁড়াই-এর হেঁটে যাওয়া পাককীতে। ওই পন্থ ও পাককীর তো কোনও শেষ ছিল না। ‘ক্লোজার’ও থাকে না। সব ফরমান, ফতোয়া ও অনুশাসনের গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা ছুটে চলে। তাদের ঠেকায় কার সাধ্যি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy