Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সোভিয়েত ধূলিসাৎ, তিনি আজও অমর

বেঁচে থাকলে আগামী কালই শতবর্ষে পা দিতেন আলেকজান্দার সলঝেনিৎসিন। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষের এই বছরে। স্বদেশে বারংবার কারাগার এবং নির্বাসনে। এমনকী, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সময়েও তাঁর নামে ‘দেশদ্রোহী’ কলরব।বেঁচে থাকলে আগামী কালই শতবর্ষে পা দিতেন আলেকজান্দার সলঝেনিৎসিন। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষের এই বছরে। স্বদেশে বারংবার কারাগার এবং নির্বাসনে। এমনকী, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সময়েও তাঁর নামে ‘দেশদ্রোহী’ কলরব।

ছবি:  অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

অশ্রুকুমার সিকদার
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

ভোর পাঁচটা, আকাশ এখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানলার শার্সিতে পুরু বরফ, অন্ধকার ভেদ করে তিনটে আলোর রেখা। বন্দিরা যাতে পালাতে না পারে, সে জন্য দু’টো আলো এখানকার টাওয়ারে অনবরত ঘুরপাক খায়, রশ্মিগুলি একে অন্যকে ছেদ করে আলাদা হয়ে যায়। এ দিকে ওভারকোটের ওপর কম্বল চাপিয়ে, হাতে গ্লাভস আর পায়ে মোজা পরেও ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে যায়।

বন্দিশালার ওপরের বাঙ্কে শুয়ে, বিভিন্ন শব্দ ভেসে আসে সুকভ-এর কানে। করিডর দিয়ে ২০ গ্যালন মলের পিপে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে অন্য বন্দিদের ইউনিট। এতটুকু চলকে গেলে দুর্গন্ধে টেকা দায় হবে। সুকভদেরও হাড়-কাঁপানো এই ঠান্ডায় উঠতে হবে। রেশনে বরাদ্দ রোজকার দু’টুকরো রুটি, মাংসহীন সুরুয়া খেয়ে রোল-কলের জন্য দাঁড়ানো। ওই খাবারে পেট ভরে না, ইভান দেনিসোভিচ সুকভ তাই গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে-যাওয়া আধখানা রুটি বাকিদের লুকিয়ে জ্যাকেটের পকেটে ভরে নেয়।

এই ভাবেই শুরু হয়েছিল রুশ লেখক আলেকজান্দার সলঝেনিৎসিন-এর প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান দেনিসোভিচ’। ১৯৬২ সালে সেই বই রুশ ভাষায় ছেপে বেরনোর পরই বিশ্ব জুড়ে হুলস্থুল। স্তালিনের আমলে সোভিয়েত দেশ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই সব বন্দিশিবির বা ‘গুলাগ’-এর কথা তার আগে মানুষের এ ভাবে জানা ছিল না। বেঁচে থাকলে নোবেলজয়ী, বিতর্কিত সেই রুশ লেখক আগামী কালই পা দিতেন একশো বছরে। রুশ বিপ্লব এবং সলঝেনিৎসিন প্রায় সমসাময়িক!

কিন্তু বিপ্লবও স্মৃতির গম্বুজ হয়ে যায়। সলঝেনিৎসিনের বাবা ছিলেন জারের রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার, মা ইউক্রেনের এক ভূস্বামীর মেয়ে। সলঝেনিৎসিনের ছয় মাস বয়সেই তাঁর বাবা শিকারে গিয়ে দুর্ঘটনায় হত। মা টাইপিং আর স্টেনোগ্রাফির চাকরি নিয়ে কোনও ক্রমে বড় করে তোলেন তাঁকে।

দারিদ্র ছিল, আর ছিল ভয়। জারের সেনাবাহিনীতে বীরত্বের কারণে স্বামী তিনটি মেডেল পেয়েছিলেন, শিশুপুত্রের চোখের সামনেই সেগুলি মাটিতে পুঁতে চিরতরে নষ্ট করে দেন ভদ্রমহিলা। স্বামী জারের সৈনিক, তাঁর বাবা জমিদার। তাই ভয় ছিল, বিপ্লবী সরকারের কাছে যে কোনও মুহূর্তে তাঁরা শ্রেণিশত্রু প্রতিপন্ন
হতে পারেন।

কিন্তু সলঝেনিৎসিন অঙ্কে ভাল। ১৯৪১ সালে, হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কয়েক বছর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্ক এবং পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন। তার কয়েক মাস আগেই বিয়ে করেছেন রসায়নশাস্ত্রের সহপাঠিনী নাতালিয়া রেস্তোভস্কায়াকে।

বিয়ের পরই সলঝেনিৎসিন চলে গেলেন ফ্রন্টে। নাত্‌সি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত সামরিক পদকেও ভূষিত হয়েছিলেন।

কিন্তু রণাঙ্গনে একটি ব্যাপার এই সৈনিকের চোখ এড়ায়নি। জার্মানিতে সাধারণ নাগরিকের সম্পদ কেড়েকুড়ে নেয় লাল ফৌজ, বিজয়গর্বে গর্বিত সেনারা মেয়েদের ধর্ষণ করতেও ছাড়ে না। এক বন্ধুকে সে সব নিয়েই চিঠি লিখেছিলেন সলঝেনিৎসিন। সে ব্যাপারে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ‘বস’ এবং ‘গুঁফো লোকটা’কে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি।

যুদ্ধের শেষ দিকেই তাই রুশ গোয়েন্দাবাহিনী সলঝেনিৎসিনকে গ্রেফতার করে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেয়। আট বছরের কারাদণ্ড। ঠাট্টার পাত্র ‘বস’ ও ‘গুঁফো লোকটা’ যে আদতে মহামতি স্তালিন, সে কথা বুঝতে তাদের বাকি ছিল না।

কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ, তবু মুক্তি পেলেন না। বিপজ্জনক এই সেনাটিকে মস্কোয় এ বারও ঘেঁষতেই দেওয়া হল না, বরং নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর কাজাখস্তানে। স্তালিনের মৃত্যুর পর মুক্তি পেলেন তিনি।

স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছর পরই ক্রুশ্চেভের গোপন ভাষণ। স্তালিন কী কী অন্যায় করেছেন, পলিটব্যুরো সদস্যদের জানালেন তিনি। সলঝেনিৎসিন এই সময় মস্কোর কাছে এক স্কুলে অঙ্ক ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। সকালে অঙ্ক শেখান, রাতে বন্দিশিবিরের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প লেখেন। সেই স্মৃতি থেকেই লিখে ফেলেছেন ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের এক দিন’। কাগজ বাঁচাতে পাতার দু’দিকেই টাইপ করেছিলেন সেই আখ্যায়িকা।

সেন্সরশিপের দেশ, ফলে ’৬২ সালেই সেই লেখা পৌঁছে গেল পলিটব্যুরোতে। তার পর এই লেখা ছাপা উচিত কী অনুচিত, সে নিয়ে তর্ক। ক্রুশ্চেভ ছাপার পক্ষে, দেনিসোভিচ-বিতর্কে তাঁর উক্তি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে, ‘‘আমাদের সবার মধ্যেই এক জন স্তালিন আছেন। আছেন আমার মধ্যেও। এই শয়তানি নিকেশ করার জন্যই লেখাটা ছাপা হওয়া উচিত।’’

বই ছেপে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল সাড়া। সকাল থেকে সূর্যাস্ত, ইভান দেনিসোভিচের এক দিনের মধ্যে ধরা পড়েছে বন্দিশালার সমগ্র জীবন। ‘সুকভ সুখী হয়েই ঘুমোতে গেল। আজকের দিনটা সৌভাগ্যের, ওকে কেউ আইসোলেশন সেলে পাঠায়নি, দুপুরে এক বাটি স্যুপও জোগাড় করা গিয়েছিল। এ ভাবেই কাটিয়ে দিতে হবে আরও ৩৬৫৩ দিন। অতিরিক্ত ৩টে দিন লিপ ইয়ার।’

সেই ষাটের দশকেই আমার হাতে এসে পৌঁছয় পেঙ্গুইন-প্রকাশিত এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। খেয়াল হয়, এই ১৯৬২-র একশো বছর আগে, ১৮৬২ সালে বেরিয়েছিল সাইবেরিয়া-বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা দস্তয়ভস্কির ‘নোট্স ফ্রম আ ডেড হাউস।’ দস্তয়ভস্কিও তো লিখেছিলেন, বন্দিশালায় সবাই পিপের মধ্যে হেরিং মাছের মতো ঠেসাঠেসি করে থাকে। দুই লেখকের অভিজ্ঞতাতেই কিন্তু বন্দিরা মানুষের সম্মান পায়নি। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় বারংবার তাদের নম্বর ধরে ডাকা হয়েছে। দুই লেখকের প্রতিতুলনা করে আবু সয়ীদ আয়ুব ও অম্লান দত্ত সম্পাদিত ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকায় সে সময় একটা লেখাও লিখেছিলাম। সম্ভবত, এই বঙ্গে সলঝেনিৎসিন-চর্চা শুরুর অন্যতম দৃষ্টান্ত সেটিই। মনে আছে, আমার বামমনস্ক কিছু বন্ধু তখন অখুশি হয়েছিলেন।

বামেরা অখুশি হয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদের পরেও। তিনি সলঝেনিৎসিনের কিছু কবিতা অনুবাদ করে তাঁর এক কাব্যগ্রন্থে সেগুলি অন্তর্ভুক্ত করেন। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এ ব্যাপারে শুধু তাঁর জবাবদিহি চেয়ে ক্ষান্ত হননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরে ১৯৮২ সালে এক ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে ‘নেহরু সোভিয়েত ল্যান্ড’ পুরস্কার দেবে ভেবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে জানিয়েছিল। কিন্তু সলঝেনিৎসিনের কবিতা অনুবাদের অপরাধে পার্টি তখন সেই সম্মতি দেয়নি। কে না জানে, ওই ‘ইভান দেনিসোভিচ’-ই তখন সোভিয়েতভূমে সলঝেনিৎসিনের এক এবং একমাত্র আইনানুগ প্রকাশ!

সলঝেনিৎসিন অবশ্য থেমে থাকেননি। পৃষ্ঠপোষক ক্রুশ্চেভ ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছেন, ক্ষমতায় এসেছেন লিওনিদ ব্রেজনেভ। সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখা ছাপা হয় না, গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি দরকারে গোপনে পাণ্ডুলিপি হস্তগত করতে পারে, প্রাণসংশয় হতে পারে— কোনও সম্ভাবনাই তাঁকে টলাতে পারেনি। লেখক শুধুই লিখে ড্রয়ারের মধ্যে সেগুলি রেখে গিয়েছেন। একে একে বেরোয় ‘ফার্স্ট সার্কল’, ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’। নাভিশ্বাস-ওঠা রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী ভাবে অপচয় হয় মেধার, তা নিয়েই অঙ্কের ছাত্র সলঝেনিৎসিনের ‘ফার্স্ট সার্কল’। এই নরকে বন্দিদের ওপর অত্যাচার নেই, শুধু থাকে না তাদের কোনও ব্যক্তিগত পরিসর। তারা এমন সব সরকারি প্রকল্পে উৎসর্গীকৃত, যাদের উদ্দেশ্য কেবল কমিউনিস্ট ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা। এই উপন্যাসে অঙ্কবিদ গ্লেবরনঝিন-এর চরিত্র তাঁর নিজের জীবনকে ভিত্তি করেই লেখা।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়েই ছিল তাঁর ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’। কর্কট রোগ সন্দেহে উপন্যাসের চরিত্রদের মতো লেখককেও যেতে হয়েছিল কাজাখস্তানের হাসপাতালে। উপন্যাসে তো সে রকমই হরেক চরিত্রের ভিড়। নায়ক কোস্তোগ্লোতভকে হাসপাতালের এক রোগী বলে, ‘‘গ্রেফতার হয়ে তো আপনারা বেঁচে গিয়েছিলেন। আর ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে আমাদের মিটিং-এ নিয়ে যাওয়া হত, যাতে আপনাদের এক্সপোজ করা যায়। আপনাদের ওরা বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত, আর আমাদের হাততালি দিতে বাধ্য করত।’’ কর্কট রোগে ব্যথার উপশম হয়, কিন্তু নিরাময় নয়। স্তালিন মারা গেলেও নয়। সিস্টেম ভিতরে ভিতরে ঝাঁজরা হতেই থাকে।

‘ফার্স্ট সার্কল’ আর ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’, দুই রুশ উপন্যাসই ছেপে বেরিয়েছিল বিদেশে। সলঝেনিৎসিন ইতিমধ্যে ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে দিয়েছেন তাঁর ম্যাগনাম ওপাস ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’। স্তালিনের আমলে সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যে বন্দিশিবির, সেখানে কী ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, বন্দিদের কী ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়, তারই বৃহদায়তন তন্নিষ্ঠ বিবরণ। বিশ শতকে প্রায় ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু এই গুলাগে, সেই তথ্যও সলঝেনিৎসিনের কলমে প্রথম জানল দুনিয়া। বইটা সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রকাশিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু এর পরই রুশ প্রচারযন্ত্র লেখককে দেশদ্রোহী, হিটলার-সমর্থক ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করে। লেখক তখন নিজভূমে প্রায় পরবাসী!

পরবাসী এবং খুনের নিশানা। সোভিয়েত লেখক সঙ্ঘ ইতিমধ্যে সলঝেনিৎসিনকে তাদের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করেছে। তাঁর অপরাধ, সেন্সরশিপের প্রতিবাদে সঙ্ঘকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। কিন্তু জাঁ পল সার্ত্র থেকে হাইনরিশ বোল, আর্থার মিলার, কার্লোস ফুয়েন্তিস... বিশ্বের অনেক শিল্পীই তখন লেখকের সমর্থনে। সলঝেনিৎসিন সে সময় একটা কথাও বলেছিলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের কাজ মিথ্যায় অংশ না নেওয়া। লেখক, শিল্পীদের, কাজটা আর একটু বড়। মিথ্যেকে পরাস্ত করা।’’

মিথ্যেকে পরাস্ত করতেই ক্ষমতার রোষানলে-পড়া, স্বদেশে ছাপা-না-হওয়া গৃহবাসী লেখক চেয়েছিলেন ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ প্রথম সোভিয়েত রাশিয়ায় ছাপা হোক। পাণ্ডুলিপির মাইক্রোফিল্ম তখন প্যারিস ও নিউ ইর্য়কের প্রকাশকদের কাছে গোপনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বইটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ছেপে বেরনোর অপেক্ষা। এই সময়েই রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি সলঝেনিৎসিনের সেক্রেটারির কাছ থেকে একটি গোপন কপি বের করে। লেখকের সেক্রেটারিকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, অতঃপর তাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। হত্যা না আত্মহত্যা, তৎকালীন কেজিবি ছাড়া কেউ জানে না। তার পরই লেখক সেই রুশ উপন্যাস প্যারিসে প্রকাশককে ছাপার অনুমতি দেন। হত্যার হুমকি আসে, সরকারি সংবাদপত্র প্রবল গালিগালাজ করে। সলঝেনিৎসিন দেশ ছাড়তে চাননি, স্বদেশে থেকেই নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।

নোবেল পুরস্কারের ঘটনায় এই সত্য আরও পরিষ্কার। ১৯৭০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় একদা বন্দি শিবিরে অন্তরীণ এই লেখককে। সলঝেনিৎসিন কিন্তু পুরস্কার নিতে সুইডেন যাননি। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এক বার দেশ ছাড়লে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না।

পুরস্কারের চার বছর বাদে সেই আশঙ্কা সত্যি হল। ১৯৭৪ সালে ফেব্রুয়ারির এক রাতে মস্কোর বাড়ি থেকে সলঝেনিৎসিনকে গ্রেফতার করা হল। পর দিন সকালে জানানো হল, তিনি আর এ দেশের নাগরিক নন। এখনই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। বার্লিনগামী বিমানে ওঠার আগে সলঝেনিৎসিন সে দিন শুধু দু’টো জিনিস নিজের সঙ্গে নিয়েছিলেন। কাজাখস্তানে বন্দি শিবিরে থাকার সময়কার একটা টুপি ও বিবর্ণ এক উলের কোট। দেশহীন লেখককে সে দিন প্রথম আশ্রয় দিয়েছিলেন জার্মান গল্পকার হাইনরিশ বোল।

জার্মানি থেকে আমেরিকা। ১৭ বছর সেখানেই থাকলেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টরেট’ সম্মানে ভূষিত করল। কিন্তু সেখানেও তিনি প্রতিবাদী, নিঃসঙ্গ লেখক। হার্ভাডের বক্তৃতায় বললেন, পণ্যমনস্কতাই আমেরিকার সব, আত্মিক বা ঐশ্বরিক অনুভূতি থেকে সে বঞ্চিত। মার্কিন পপ সঙ্গীতকেও তুলোধোনা করলেন তিনি, ‘‘এখানকার ক্লান্তিকর টেলিভিশন প্রোগ্রাম, অসহ্য গানবাজনা ইত্যাদি যে অভ্যাস, মানুষের আত্মা চায় তার চেয়েও বৃহৎ ও মহৎ কিছু।’’

পরে ১৯৯৩ সালে এক বক্তৃতায় আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘আইনের শাসনে প্রতিটি নাগরিকের যে স্বাধীন পরিসর, তা অনেক পথ পেরিয়ে অর্জন করতে হয়। পশ্চিমি সভ্যতা এই সত্য বিস্মৃত না হলেই ভাল।’’ ট্রাম্প, এর্দোগানদের সময়ে আজ ওটি ভবিষ্যদ্বাণী বলে বোধ হয়।

১৯৯৪ সালে দেশে ফিরলেন লেখক। সরাসরি মস্কো নয়, উড়ানে প্রথমে সাইবেরিয়ার রাজধানী ভ্লাদিভস্তক। সেখান থেকে ট্রেনে মস্কো। লেনিন, স্তালিনদের কমিউনিজম এত দিনে অপসৃত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছে বিভিন্ন স্বাধীন দেশে। সলঝেনিৎসিন রেলপথে দেখে নিতে চান সে সব। আমেরিকায় থাকার সময় তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ তাঁর সঙ্গে এক বার দেখা করতে গিয়েছিলেন, সলঝেনিৎসিন রাজি হননি। তাঁর ধারণা ছিল, গর্বাচভ তাঁর ‘গ্লাসনস্ত’ নীতিতে আসলে সোভিয়েতকে বাঁচাতে চান। বরিস ইয়েলৎসিনকেও তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। শেষ দিকে, ২০০৭ সালে পুতিনের দেওয়া সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, পুতিন রুশ সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে যথার্থ চেষ্টা করছেন। তখনও সমালোচকরা তাঁকে জাতীয়তাবাদী বলে কড়া সমালোচনা করেছিলেন।

পরের বছর, ২০০৮ সালে, ৮৯ বছর বয়সে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে গেলেন তিনি। হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছিল। তার আগে সোভিয়েত সিস্টেমের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে গিয়েছেন। ওই সিস্টেম বন্দিত্ব আর নির্বাসনের বাইরে অন্য কোনও পুরস্কার দেয়নি তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE