Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

বেজায় তালেবর তখন। কলেজে পড়ি। একে রাজা করি তো ওকে মন্ত্রী, এর গর্দান নিই তো তাকে ক্ষমা ভিক্ষা দিই। আমরা ছাড়া এ গ্রহে কেউ কিস্যুটি জানে না। যেন যাপনের প্রতি মুহূর্তে চিট পাঠিয়ে সবাইকে আমাদের অনুমতি নিতে হবে। কলেজের কোনও একটা অনুষ্ঠানে দুই বন্ধু একটু কাছাকাছি এল। তবে এক জন কম, এক জন বেশি। যে বেশি, সে মরিয়া। যে কম, সে অল্প ছোঁয়াচ-বাঁচানো।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

বেজায় তালেবর তখন। কলেজে পড়ি। একে রাজা করি তো ওকে মন্ত্রী, এর গর্দান নিই তো তাকে ক্ষমা ভিক্ষা দিই। আমরা ছাড়া এ গ্রহে কেউ কিস্যুটি জানে না। যেন যাপনের প্রতি মুহূর্তে চিট পাঠিয়ে সবাইকে আমাদের অনুমতি নিতে হবে।

কলেজের কোনও একটা অনুষ্ঠানে দুই বন্ধু একটু কাছাকাছি এল। তবে এক জন কম, এক জন বেশি। যে বেশি, সে মরিয়া। যে কম, সে অল্প ছোঁয়াচ-বাঁচানো। এর পর ক্যান্টিনে লম্বা লম্বা সেশন। কেন আমাদের বান্ধবীটির ওই বন্ধুর প্রেমিকা হওয়াই বাঞ্ছনীয়— সেই মগজ ধোলাই হেতু গোটা পঞ্চাশেক ডিমের ডেভিল আর শ’খানেক কাপ চা তো আমরা হ়জম করেই দিলাম।

অতঃপর রাধা নাচিল এবং সাত মণ তেলও পুড়িল। মাস কয়েক উড়ুউড়ু-ফুরুফুরু ভালই গেল। কিন্তু হঠাৎই এক সময় দোকলা সিনেমা, দোকলা দোসা খাওয়া, দোকলা বেড়াতে যাওয়াগুলো ওদের মধ্যে কমে এল। দেবদাস নার্ভের রোগ বাধিয়ে বসল। আমরা উতলা হয়ে পড়লাম। ফের লম্বা লম্বা সেশন। ‘হাসপাতালে ভর্তি, তুই দেখতেও যাবি না?’ বান্ধবী হাসপাতালে গেল। কিছু কান্না, কিছু সমঝোতা। সে বারের মতো টিকে গেল।

কিন্তু বেশি দিন না। বান্ধবী বলে বসল, এ সম্পর্ক চাই না। এ বার আর সেশনে কিছু হল না। বলল, ‘দ্যাখ, জোর করে কিছু হয় না। আমার ওর সঙ্গে মিলছে না। আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো আলাদা তো।’

ব্যস, আমরা গেলাম তেরিয়া হয়ে, ‘তুই তা হলে এত দিন ছিলিস কেন ওর সঙ্গে? ওকে আশা দিয়ে তার পর এ ভাবে ছিনিয়ে নেওয়ার কোনও মানে হয় না।’ আমাদের বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে আমাদের বান্ধবী দিন কয়েক কলেজে এল না। আর আমরা বন্ধুর ভাঙা-প্রেম নিয়ে এত বিচলিত হয়ে পড়লাম যে বান্ধবীর দিকটা বা তার মনটা এক বারও ভাবলাম না।

কলেজে এল না তো কী, আমরা ওর বাড়ি যাব। জবাব জবাব জবাব চাই। যেন পার্টিতে ও দাসখত লিখিয়েছে। এক দিন দলবল মিলে চড়াও হলাম। বান্ধবীর মা-বাবা দেখে তো অবাক। তার পর আমরা শুরু করলাম দোষারোপ। যতই ও বলে, এ ভাবে জোর করে হয় না, ততই আমরা বলি, তোর এ রকম করা উচিত হয়নি। এক সময় ওর মা-বাবাও আমাদের বোঝাতে এলেন। বুঝলাম না। খুব খারাপ ভাবে শেষ হল ব্যাপারটা। তেতো হয়ে গেল সম্পর্ক।

কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই বুঝলাম কাজটা ঠিক করিনি। আমরা বন্ধুর প্রেমের গার্জেন নই। এক জনের মনের ওপর জোর চলে না। প্রত্যেকের একটা ব্যক্তিগত মতামত থাকবে। এবং সেই মতামতকে সম্মান করাই অন্যদের কর্তব্য। যদি বন্ধুর প্রেম ভেঙে গিয়ে কষ্ট হয়, তা হলে বন্ধুকে সাহায্য করতে হবে, সেই অবস্থা থেকে সে যাতে বেরিয়ে আসতে পারে। এ ভাবে অন্যকে হেনস্থা করে, তাকে ছোট করে, অপমান করে প্রেম ভাঙার বদলা নেওয়া যায় না।

যত দিনে বুঝলাম, তত দিনে দূরত্ব বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। হয়তো নিজেকে নিয়ে এই লজ্জা নিজের মধ্যে লালন করে যাওয়াই উচিত শাস্তি। বহু বছর পর যখন যোগাযোগ হল, তখন আর সেই কথা তুলে মনস্তাপ করার সময় পেরিয়ে গিয়েছে।

আর সেই বন্ধু, যার জন্য আমরা বেজায় জান লড়িয়েছিলাম? সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতে না হতেই আমাদের ছেড়ে চম্পট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE