Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

যে নাটকটা আজও দেখা হয়নি

সুকান্ত সরকার

বসন্ত যাই যাই করছে। গরম কাল এল বলে। ১৯৭১-এর দুপুর, পুলেমামার বাড়ি গানের রিহার্সাল। গান গাইবে রমাদি, শিখাদিরা। নূপুরদাদের বাড়িতে আবৃত্তির তালিম দিচ্ছে চন্দনদা। টিফিনে বাড়ি এসে আর ইস্কুলে ফিরতাম না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচ-গানের রিহার্সাল শুনতাম। সে বার বড়দের নাটকের নাম ছিল ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’। তখন আমি ‘থিরি’। ইস্কুলের ‘ফোর কেলাস’-এর ঘরে রিহার্সাল চলত রাতে। ছোটদের রাতে বেরনো বারণ, রিহার্সালও দেখা হত না তাই।

বৈশাখে নাটক। দিন গুনছিলাম, আর এগারো দিন...দশ.. নয়... ইস্কুল মাঠে স্টেজ তৈরি হবে। আগেই ঠিক হয়ে যেত, কোন কোন বাড়ি থেকে চৌকি-তক্তপোশ নেওয়া হবে। নাটকের দিন সকাল থেকে বড়রা এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে চৌকি আনতে শুরু করলেন। পেছন পেছন ছোটরাও দল বেঁধে ঘুরছিল। ফতুল্লাপুরের বাঁশবাগান থেকে বাঁশ কেটে আনা হত। ক্লাবে কয়েকটা লাল, নীল, সাদা কাপড় ছিল। তাতে হত না। পাড়ার কাকিমা, বউদি, মাসিমার পুরনো কাপড় চেয়ে আনা হত, স্টেজ বাঁধতে।

শুধু কী আনন্দ? ভয়ও ছিল। কালবৈশাখীর ভয়। ব্যাং মেরে তাকে চিৎ করে কবর দেওয়া হত। বিশ্বাস, বৃষ্টি হবে না। এখানেই শেষ নয়। বিকেল থেকে ‘কচার ডাল’ ভাঙা হত। আশপাশের পাড়া থেকেও অনেকে আসবে, তাদের মধ্যে কিছু ‘শত্রু’ও থাকতে পারে। সেই ‘শত্রু’দের উচিত শিক্ষা দিতেই কচার ডাল চাই।

সে দিন বাড়িতে ঢোকার পর আর বেরোতে পারলাম না। বড়রা ফরমান জারি করলেন, রাতে নাটক দেখতে যাওয়া যাবে না। চার দিক থেকে গন্ডগোলের খবর আসছে ক’দিন ধরেই। কয়েক মাইল দূরে ‘লাশ’ পড়ে থাকার খবর নিয়ে কানাকানি। কিন্তু আমাদের নাটক দেখায় কীসের বাধা? রাতে মেজদাকে মা বলছিল, ‘কত নাটক-ই তো ছিল। ওই রক্তাক্ত রোডেশিয়া-ই তোদের করতে হবে!’ আমরা জানতাম না রোডেশিয়া কোথায়, কেনই বা তার জন্য গন্ডগোল হবে। বুঝলাম কয়েক দিন পর।

আফ্রিকার দেশ রোডেশিয়া-র গেরিলা যুদ্ধ স্থান করে নিয়েছিল সিনেমাতেও।

১৯৬৯’এর তথ্যচিত্র ‘রোডেশিয়া: কাউন্টডাউন’-এর পোস্টার

পাড়ার পশ্চিমে বল-খেলার মাঠ। এক দিন সকালে সেই মাঠ দিয়ে জন পনেরো-কুড়ি ছেলে পাড়ায় ঢুকল। মেজদাদের বয়সি সেই ছেলেদের মুখে কোনও কথা ছিল না। পাড়ার বড়দের দু’এক জনের সঙ্গে তাদের কথা হল খুব নিচু গলায়। তার পর তারা কোথায় গেল জানি না। শুনলাম, সিআরপি নাকি ওদের তাড়া করেছে। সারা দিন পাড়াটা কেমন থম মেরে রইল।

ক’দিন পর। সকাল দশটা। পুকুরে চান করতে নামব, ইস্কুল যেতে হবে। হঠাৎ বুম বুম বুম। পুব দিক থেকে। মা ছুটে এসে আমার হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। পাড়ার ও-দিকটা থেকে চেঁচামেচি। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল দিদি। মা-কে বলল, ‘গণশক্তিগুলো পুড়িয়ে ফেলো। ওরা ঘরে ঘরে ঢুকে সার্চ করছে।’ দিদি নিজেই মেজদার ঘর থেকে কাগজগুলো নিয়ে, আমগাছতলায় আগুন ধরিয়ে দিল। কিছু ক্ষণ প়র বাড়িতে দুজন ছেলে এসে মেজদার এক বন্ধুর খোঁজ করল। আমাদের বাড়িতে নাকি লুকিয়ে আছে সে। ঘরে ঢুকে খাটের তলা, বাথরুম, ছাদ দেখল, কাউকে না পেয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় মেজদার নাম করে বলে গেল, সে যেন পাড়ায় না আসে। এলে ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’র মতোই রক্তাক্ত করে দেওয়া হবে। সেই প্রথম আমি ভয় পেলাম।

বিকেলে পাড়ায় বেরিয়ে বন্ধুদের দেখা পেলাম না। শুনলাম, মেজদার বন্ধুরাও সব কোথায় চলে গিয়েছে। কেমন চুপচাপ হয়ে গেল পাড়াটা। কয়েক দিনের মধ্যে আমার কিছু বন্ধুও বাড়ির বড়দের সঙ্গে পাড়া ছেড়ে চলে গেল। আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে গেল। মাঠে অন্য কারা খেলে। তারা আমার বন্ধু না।

বাড়ি ছাড়লাম আমরাও। চলে এলাম হাওড়ার সালকে-তে। কিন্তু মনের মধ্যে দুটো শব্দ পাকাপাকি বাসা বাঁধল: ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’। ভর্তি হলাম সালকিয়া হিন্দু স্কুলে। আর একটা বৈশাখে, ইস্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তোড়জোড় হচ্ছে। বাংলা স্যর সজনীবাবু জানতে চাইলেন, কে কী করছে। বেশির ভাগই কবিতা আবৃত্তির কথা বলল। আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, নাটক করব? রক্তাক্ত রোডেশিয়া? সজনীবাবু চমকে উঠেছিলেন। জানতে চাইলেন, আমি কোথা থেকে জেনেছি ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’র কথা। বাড়ি ফিরে মা’কে বলতে, মা বলল, ‘ওই নাটক কি ইস্কুলে হয় নাকি! ও-সব বলতে গেছিস কেন!’

দিন গড়ায়, আমার উঁচু ক্লাসে ওঠা-ও। ইতিমধ্যে ইস্কুলে কয়েকটা অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে। আমি আর নাটক করার কথা বলিনি কাউকে। কিন্তু ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’ মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, ওই নাটকে কী আছে। কেন দুজন অচেনা ছেলে ওই নাটকের মতোই মেজদাকে ‘রক্তাক্ত’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল? মেজদারা ওই নাটক করছিল বলে মা কেন ভয় পেয়েছিল? আমার মুখে ওই নাটকের কথা শুনে সজনীবাবু কেন চমকে উঠেছিলেন? ক্রিকেট খেলা, ছবি আঁকা, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা, সবই চলছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যেই ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’ মনে উঁকি দিত। তত দিনে জেনেছি, রোডেশিয়া আফ্রিকার একটা দেশ। শেষমেশ দাদার শরণ নিলাম। দাদা মায়ের মতো ভয় পায়নি, সজনীবাবুর মতো চমকেও ওঠেনি। খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ‘প্রতিবাদের নাটক। সরকার প্রতিবাদ পছন্দ করে না। তাই কেউ কেউ ভয় পায়। বড় হয়ে বই পড়ে জানবে, ছেলেরা ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’ নাটক করলে সরকার কেন রেগে যায়!’

এখনও চলতে-ফিরতে কোথাও প্রতিবাদের কথা উঠলেই, ছেলেবেলার সেই না-দেখা নাটক আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেই ইস্কুল মাঠে। যেখানে কয়েক জন যুবক একটা নাটক করেছিল। প্রতিবাদের নাটক। ‘রক্তাক্ত রোডেশিয়া’।

sukanto2008@gmail.com

সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আজ প্রথম আন্তর্ব্রহ্মাণ্ড বিয়ের আসর বসছে কলকাতার এক চোদ্দো-তারা হোটেলে। পাত্র বিখ্যাত ব্যবসায়ী রবিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা বিয়েতে যোগ দিতে গত কালই কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন, এসেছেন ডি-এক্স২৩ গ্রহের ৩৮৫ জনের একটি গণ্যমান্য অতিথি দলও। মনে থাকতে পারে, তিন বছর আগে রবিচরণ তাঁর উড়োজাহাজে ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে বেরিয়ে হঠাৎই ডি-এক্স২৩-তে পৌঁছে যান। এর পরই সেখানে তপোবনের মতো এক জায়গায় এম২৩২৩১৩৩-র সঙ্গে দেখা। তিনি শকুন্তলার মতো পোশাকে, নিজেদের ভাষায় গান গাইতে গাইতে ঘুরছিলেন। প্রথম দেখাতেই প্রেম। রবিচরণ তাঁর সঙ্গে মঙ্গল গ্রহে এক বছর কাটিয়ে, তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে, পৃথিবীতে ফিরে আসেন ও বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু ভারতীয় সমাজ এই বিয়ে নাকচ করে দেয়। এক বছর তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডার পর মিছিলনগরী কলকাতা ভিনগ্রহী-বিয়ের পক্ষে আদালতের অনুমতি আদায় করে। বিয়ের প্রথম পর্ব ডি-এক্স২৩-তে হয়ে গেছে। আজ বাঙালি মতে বিয়ে, লগ্ন রাত্রি ন’টায়। শহরবাসী প্রবল উত্তেজিত, কারণ এম২৩২৩১৩৩-কে রবিচরণ ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ দেখেনি। পানপাতার আড়াল থেকে কখন তাঁর শ্রীমুখ দেখা যাবে, সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। গুজব, তাঁকে টু-ডি যুগের হিট সিনেমা ‘কোই মিল গয়া’র জাদুর মতো দেখতে। তবে, চিন-এর দাবি, এটি ভারতের আন্তর্ব্রহ্মাণ্ডনীতির চাল। এতে ভারত বহির্জগতের সামরিক সাহায্য পাওয়ার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল, যা অন্যান্য দেশের কাছে বিপজ্জনক। ভারতের বিদেশ সচিব উত্তরে কিছু বলতে চাননি। কূটনৈতিক মহল এর মধ্যে আকবরের রাজস্থান নীতির ছায়া দেখছে। প্রধানমন্ত্রী ডি-এক্স২৩’এর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করার কথা বলছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এ সব ভাবতে নারাজ। তিনি ভিনগ্রহী নববধূকে বরণ করার জন্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত।

ইমন চৌধুরী, মারাখালি, বেঙ্গালুরু

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sunday magazine africa school drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE