Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ঝিনুকের কী ঝামেলা

ঝিনুক, পিউয়ের রাঙামাসির একমাত্র মেয়ে। ওরা রাঙামেসোর চাকরির দৌলতে দিল্লিতে থাকত। এখন কলকাতায়। ঝিনুক কনভেন্টে পড়ে। এখন সেভেন। পিউকে রাঙামাসি বললেন, ঝিনুককে বাংলাটা একটু পড়াবি? খুবই দুর্বল। তমালিনীদি নামের এক জন টিচার বাংলা পড়াত। উতরে যাচ্ছিল। তমালিনীদির মাথাঘোরার ব্যামো। আর পড়াবেন না বলেছেন। খুব সহজ কাজ ভেবে পিউ তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল।

ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

মালবিকা রায়
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

ঝিনুক, পিউয়ের রাঙামাসির একমাত্র মেয়ে। ওরা রাঙামেসোর চাকরির দৌলতে দিল্লিতে থাকত। এখন কলকাতায়। ঝিনুক কনভেন্টে পড়ে। এখন সেভেন। পিউকে রাঙামাসি বললেন, ঝিনুককে বাংলাটা একটু পড়াবি? খুবই দুর্বল। তমালিনীদি নামের এক জন টিচার বাংলা পড়াত। উতরে যাচ্ছিল। তমালিনীদির মাথাঘোরার ব্যামো। আর পড়াবেন না বলেছেন। খুব সহজ কাজ ভেবে পিউ তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল। সে সবে কলেজে পড়ছে। বাংলা অনার্স। ফার্স্ট ইয়ার, ডোন্ট কেয়ার ভাব।
পর দিন ঝিনুক বইপত্র নিয়ে এসে গেল। খুব খুশি। সে বই খুলে একটা গল্প বের করে দিয়ে বলল, এটা ক্লাসে পড়াচ্ছে। একটু পড়ে শোনাও।
আমি পড়লে তোর কী লাভ?
তুমি পড়বে, আমি শুনব। লোকে কখনও বলে না তোমার পড়া কেমন চলছে? বলে, পড়াশোনা কেমন চলছে? শোনার দরকার আছে।
লোকে তো এটাও বলে, লেখাপড়া কেমন চলছে? লেখারও খুব দরকার।
ঝিনুক বলে, লিখব একেবারে পরীক্ষার সময়। এখন খালি শুনব। মানে না বুঝলেই জিজ্ঞেস করব।
পিউ পড়তে আরম্ভ করল। জিজ্ঞেস করার বহরটা খুবই বেশি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলল। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে পিউ, আর ভাবছে রাঙাপিসির চোখের মণি। কিছু বললে হয়তো সম্পর্কে ফাটল ধরবে। সে পড়ছে...
তখন সন্ধ্যাকাশে...
কে কাশে? সন্ধ্যা?
সন্ধ্যার আকাশে অজস্র জোনাকি উড়ছে...
আরে দাঁড়াও, অত তাড়াহুড়ো করলে হবে?
জোনাকি কি পাখি? সন্ধেতে ওড়ে?

পাখি না। পোকা। ফায়ার ফ্লাই।

ওহ লাভলি। খুব সুন্দর। দেখেছি।

পর দিন পড়াশোনার মাঝেই ঝিনুক বলল, পিউদি, বাকিটা একটু পরে বুঝে নেব। মনটা খুব ডিসটার্বড আছে।

কেন?

প্রবলেমটা হল, আমি আসলে কী, ছোট না বড়?

মানে?

কালকে সন্ধে বেলায় মা আমার ওপর রেগে গেল। বলল, এত বড় একটা মেয়ে ঘরটাকে কী করে রাখিস? বড় মেয়েরা বইপত্র, জামাটামা, ঘরদোর সব গুছিয়ে রাখে। আজ সকালে মা বাবা ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল। আমি গেলাম গুডমর্নিং বলতে। ঘরে ঢোকার সময় শুনলাম মা বলছে, ওদের বিয়েটা তা হলে... এইটুকু শুনেই বললাম, কার বিয়ে মা? মা জ্বলে উঠে বলল, এইটুকুনি মেয়ে বড়দের কথার মধ্যে কথা বলিস কোন সাহসে? ছোট, ছোটর মতো থাকবি। এ বার তুমি বলো, আমি ছোট না বড়?

খুব যে ছোট তাও না, খুব যে বড় তাও না।

সে আবার কী?

মানে নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখার মতো বড় হয়েছিস বটে, তবে যারা অনেক বড় তাদের কথাবার্তায় থাকার মতো বড় হোসনি।

পিউর পড়াবার মুড নষ্ট হয়ে গেছে।

ঝিনুক বলল, ‘সেদিন অতিথি এল’ এতটা পড়িয়েছিলে। অতিথি কী?

পিউ আচমকা একটা বেফাঁস কথা বলে বসল। বলল, ‘যে তিথি দেখে আসে না।’ বলেই ভাবল, খেয়েছে! এখন প্রশ্নের ঠ্যালায় অস্থির হয়ে যাব।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, তিথি কী?

আত্মরক্ষার তাগিদে পিউ তাড়াতাড়ি বলল, ও কিছু না। অতিথি মানে গেস্ট।

ও, তিথি মানে কিছু না, আর অতিথি মানে গেস্ট।

পিউ আবার একটা অবান্তর কথা ফস্ করে বলে ফেলল, অতিথিকে নারায়ণ বলা হয়... বলেই ভাবল, সেরেছে, কী বললাম?

আর যায় কোথায়? ঝিনুক খিকখিক করে হেসে বলল, হাউ ফানি! নারায়ণ তো ভগবান! গেস্ট হল ভগবান!

অনেক বাক্য ব্যয় করে পিউ কথাটাকে ধামাচাপা দিল। তিন মাস কেটে গেল। ঝিনুকের পরীক্ষা চলছে। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে কোশ্চেন পেপার নিয়ে নাচতে নাচতে এসে বলল, এই দেখো, রচনা কত সোজা সোজা ছিল। আমি এটা লিখেছি—অবাঞ্ছিত অতিথি। এটা কেউ লেখেনি। সবাই বলল, ভীষণ কঠিন। আমার কাছে তো খুবই সোজা, যা চমৎকার লিখেছি, নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। অনেকটা ক্রেডিটই তোমার। অতিথির ব্যাপারে তুমি ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলে। অবাঞ্ছিত মানে তো আন্দাজেই বুঝে নিয়েছি—আনএক্সপেকটেড। লিখলাম, আমার মামা শিকাগোয় থাকে। সারপ্রাইজ দেবার জন্য সে এক দিন হঠাৎ আমাদের বাড়িতে চলে এল। এই অবাঞ্ছিত অতিথিকে দেখে আমার বাবা-মা খুব খুশি। মামাকে বললাম, তুমি যে এত অবাঞ্ছিত ভাবে এসে যাবে, আমরা ভাবতেই পারিনি। মনে হচ্ছে যেন, নারায়ণ নিজেই এসে গেছে। মামাকে পুজো করব বলে ফুলের মালা কিনতে বেরোলাম...

ঝিনুক কী সব বলছে! পিউর বাক্শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। কোনও রকমে বলল, ওরে থাম। ওই মালাটা আমার শ্রাদ্ধের সময় দিস। অবাঞ্ছিত মানে আনওয়ান্টেড। হতে পারে চোর, ভূত বা বিরক্তিকর কেউ।

আঁতকে উঠে ঝিনুক বলল, অ্যাঁ, কী বলছ?

পিউর মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে— ‘অনেকটা ক্রেডিটই তোমার।’ তমালিনীদির মাথাঘোরার ব্যামোটা সে উপলব্ধি করছে।

চোখ চড়কগাছে তুলে ধরা ধরা গলায় ঝিনুক এক নাগাড়ে বলে চলেছে, কী ঝমেলা! বাংলা সাবজেক্টটা যে কে আবিষ্কার করেছিল কে জানে! তাকে এক বার হাতে পেলে হত। এই বলছে অতিথি নারায়ণ, আবার বলে আনওয়ান্টেড। সো সিলি! নারায়ণ কখনও আনওয়ান্টেড হতে পারে? সে স্তিমিত গলায় কত কিছু বকে চলেছে, হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল— ফায়ার ফ্লাই! অনেক! আমি ওদের দেখতে চাই না।

তার মানে সর্ষে ফুলের বদলে তার চোখের সামনে জ্বলছে আর নিভছে অসংখ্য জোনাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

malabika roy story delhi college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE