Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ সৈনিক তৈরির স্কুল?

জঙ্গি জাতীয়তাবাদ ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করতে শেখায় না, শুধু চায় শর্তহীন আনুগত্য। তাই কখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ট্যাঙ্ক বসানোর প্রস্তাব, কখনও বা দেওয়ালে শহিদ জওয়ানদের ছবি ঝোলানোর পরিকল্পনা।সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে এই গণতন্ত্র বনাম জাতীয়তাবাদ বারবার উঠে এসেছে। অনেকেই আর তাঁদের সহনাগরিকদের সমান নাগরিক মনে করছেন না।

সহমর্মী: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে রোমিলা থাপার ও হরবংশ মুখিয়া। ছবি: গেটি ইমেজেস

সহমর্মী: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে রোমিলা থাপার ও হরবংশ মুখিয়া। ছবি: গেটি ইমেজেস

বৈদিক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৯:২০
Share: Save:

বেশ জমে উঠেছে দীননাথ বনাম রবীন্দ্রনাথ লড়াইটা। পশ্চিমবঙ্গের ভোটের কথা ভেবে দীননাথ বাত্রা এবং তাঁর ন্যাসের (শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস) সঙ্গীরা আপাতত একটু পিছিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু মূল ঝগড়াটা থেকেই যাচ্ছে। আর আজ না হোক কাল রবিঠাকুরকে যে আবার কাঠগড়ায় তোলা হবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। এই বিরোধের কারণটিও খুব অস্পষ্ট নয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই লড়াই নিয়ে যে প্রতিবেদন বেরিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় ‘ন্যাশনালিজম’ আর ‘হিউম্যানিটি’র যে দ্বন্দ্ব বারবার উঠে এসেছে, তাতেই শ্রীযুক্ত বাত্রা চটেছেন সবচেয়ে বেশি। নেশন আর ন্যাশনালিজমের উপরে কীই বা থাকতে পারে? তার উপর যদি সেটা মানবিকতা জাতীয় একটা আদ্যন্ত ধোঁয়াটে জিনিস হয়।

এই ঝগড়াটা আর শুধু পাঠ্যপুস্তকে আটকে নেই। চারিদিকে যে ভাবে সবাই জঙ্গি জাতীয়তাবাদ নিয়ে খেপে উঠেছে, যে ভাবে একটার পর এক ‘লি়ঞ্চিং’ সংগঠিত হচ্ছে, বা যে ভাবে রোজকার সান্ধ্য আলোচনায় টেলিভিশনের সঞ্চালকরা দেশপ্রেমের জিগির তুলছেন, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাই এই জঙ্গি জাতীয়তাবাদ আর তার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা জরুরি।

জঙ্গি জাতীয়তাবাদ মানে কিন্তু আরও বেশি-বেশি করে জাতীয়তাবাদ নয়। জাতীয়তাবাদ তখনই জঙ্গি হয়ে ওঠে, যখন তা গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে যায় বা নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী করে তোলে, বিংশ শতাব্দীর তিরিশ ও চল্লিশের দশকে এই গণতন্ত্র-বিরোধী জঙ্গিপনা শেষ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধ দিয়ে। তার পর জাতীয়তাবাদ শব্দটাতেই অস্বস্তি ছিল দীর্ঘ দিন। জাতীয়তাবাদকে পুনরাবিষ্কার করার বা তাকে একটা সম্মানজনক জায়গা দেওয়ার কৃতিত্ব তৃতীয় বিশ্বের। ঔপনিবেশিক শাসনের শেষে, বিশেষত পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের মধ্যে, এশিয়া এবং আফ্রিকায় একাধিক স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্জন্ম ঘটে জাতীয়তাবাদের। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় এই, পুনর্জন্ম সম্ভব হয়েছিল গণতন্ত্রের মাধ্যমে, নাগরিকতার নতুন ধারণার আধারে। সর্বজনীন ভোটাধিকার বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মাধ্যমে এক নতুন নেশন কল্পনা করা হয়েছিল। যেখানে বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও, সব নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃতও হয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানীরা একে অনেক সময় ‘সাবজেক্ট’ থেকে ‘সিটিজেন’-এ উত্তরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের এই যোগাযোগটুকু বাদ দিলে হাতে সত্যি পেনসিলের বেশি কিছু পড়ে থাকবে না।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে এই গণতন্ত্র বনাম জাতীয়তাবাদ বারবার উঠে এসেছে। অনেকেই আর তাঁদের সহনাগরিকদের সমান নাগরিক মনে করছেন না। শুধু তাঁরা মুসলমান বা দলিত বলেই তাঁদের ঠেলে দিচ্ছেন অন্য পরিচয়ের আড়ালে, তৈরি করছেন এক অগণতান্ত্রিক নাগরিকতার অসহিষ্ণু ভাষ্য। এই নতুন জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্রকে শুধুই সংখ্যার খেলা আর ভোটে জেতার হাতিয়ার মনে করে। গণতন্ত্রের যে নৈতিক একটা দিক আছে, বা সংখ্যায় যাঁরা কম তাঁরাও যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই সমান নাগরিক অধিকারের দাবিদার, সেই কথা বেমালুম গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে, গোটা দেশকে দু’টো ভাগে ভাগ করা হচ্ছে— যারা সংখ্যাগুরু, তারা শুধু সংখ্যার জোরেই ভারী জাতীয়তাবাদী। আর যারা সংখ্যালঘু, তাদের লঘুত্বের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে পদে পদে। কখনও প্রাণের বিনিময়েও। এই ঘৃণা আর ভয়ের রাজ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জায়গা প্রায় নেই।

এরই আর একটি বহিঃপ্রকাশ দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে চত্বরে। এই জঙ্গি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভাবনার একটা আন্তরিক বিরোধ রয়েছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথমে গড়ে উঠেছিল কেরানি সরবরাহের কারখানা হিসেবে। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার একটা নিজস্ব পরিসর তৈরি হয়। ১৯৪৭-এর পরে এবং বিশেষত সাম্প্রতিক অতীতে, সেই পরিসরকে আরও গণতান্ত্রিক করে তোলার নানা প্রয়াস হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে, এখন অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বা পড়াতে আসছেন, যাঁরা এক প্রজন্ম আগেও এখানে আসার কথা ভাবতে পারতেন না। এই গণতান্ত্রিকতার মূল সুরটি আমাদের সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বতন্ত্র একটা পরিচয় দিয়েছে আর গোলমালটাও বাধছে সেখানে। জঙ্গি জাতীয়তাবাদ এই গণতন্ত্রকে বা তার মূল নৈতিক ভিত্তিটিকে নিয়ে কিছুতেই স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না। গণতন্ত্র যে বহু স্বর দাবি করে বা যে আলাপ-আলোচনায় বিশ্বাস রাখে, তার সঙ্গে একমাত্রিক দেশভক্তির যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিসর যে ভাবে সব মতামতকে আলোচনার সুযোগ দেয়, তার সঙ্গে জঙ্গি জাতীয়তাবোধের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী।

জঙ্গি জাতীয়তাবোধের পক্ষে তাই একটি নতুন ধারণার আমদানি করা হয়েছে। আগেকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ছিল সরকারি অফিসের চাকুরে। আর এখন সীমান্তে পাহারারত সৈনিক। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ট্যাঙ্ক বসানোর প্রস্তাব দিয়ে বিস্তর লোক হাসিয়েছেন। কিন্তু এর মূল ভাবনাটি মোটেও হাস্যকর নয়। এখানে জঙ্গি জাতীয়তাবাদ একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আর তার আর্দশের কথা বলছে। বারবার করে সেনাবাহিনীর অনুশাসনকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে খাড়া করতে চাইছে। ক্যাম্পাসের মধ্যে ট্যাঙ্ক বসিয়ে বা দেওয়ালে দেওয়ালে শহিদ জওয়ানদের ছবি ঝুলিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক নৈতিকতা বা বিতর্ক নেহাত অপ্রয়োজনীয় জটিলতা। আসলে আমাদের চাই, সেনাবাহিনীর মতো কঠোর অনুশাসন। এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় যা প্রশ্ন করতে শেখায় না, উলটে এক অরাজনৈতিক আনুগত্য তৈরি করে। এই নতুন মডেলে জ্ঞানচর্চার সীমারেখাটি খুব স্পষ্ট। প্রথম থেকেই বলে দেওয়া হচ্ছে, কী কী করা যাবে বা যাবে না, কোন আলোচনা বৈধ আর কোনটা দেশদ্রোহী। এই সীমারেখার বাইরে পা দিলে কী হবে, তা-ও এই সেনাবাহিনীর ছবিটির মধ্যে বেশ স্পষ্ট। সুসঙ্গত ভাবনাচিন্তা বা যুক্তি-বুদ্ধিচর্চার যে পরিসরটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যেত, সেটা এই নতুন মডেলে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে।

আর ভয়টাও সেখানে। এই সেনাবাহিনী মডেল যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে দেবে তা নয়, এর প্রভাব পড়বে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরেও। অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় আর তার বাইরের সমাজের যোগাযোগটা খুব প্রত্যক্ষ নয়। আমাদের দেশে ঐতিহাসিক ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় ও বৃহত্তর সমাজ আর তার রাজনীতি খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিশ শতক থেকে ছাত্র রাজনীতির ধারাটি দেখলে তা স্পষ্ট হবে। দেশের বেশির ভাগ নেতাই এই ছাত্র আন্দোলনগুলোর ফসল। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে শুধুই বাধ্য নাগরিক তৈরির কারখানা হিসেবে দেখা হয়, সেখানে যদি শুধুই সামরিক অনুশাসনের চর্চা হয়, তার একটা প্রভাব এই সমাজ ও রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। যেটুকু গণতান্ত্রিক কাঠামো এখনও বজায় আছে, তা-ও বেশি দিন থাকবে না। জঙ্গি জাতীয়তাবাদ শহরের সঙ্গে মন্দির পোড়াতে চায় না, উলটে মন্দির থেকেই শহরে আগুনটা ছড়াতে চায়।

এর থেকে বেরনোর রাস্তা? একটা উত্তর ক্ষীণ ভাবে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয় আর তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে। গত দু-তিন বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র রাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়েছে। তারা আর কিছুতেই এই একমাত্রিক জাতীয়তাবাদের ধারণাটি মেনে নিতে চাইছে না। তাদের রাজনীতির নতুন ভাষাটি তৈরি হয়েছে এই জঙ্গিপনার বিরুদ্ধে, এর যে ধারাবাহিক ভাষ্যটি আছে তার বাইরে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু তার চাইতেও বড় যে জিনিসটি রয়েছে তা হল গণতান্ত্রিক নৈতিকতায় আস্থা।

রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁকে দিয়েই শেষ করি। শ্রীযুক্ত বাত্রারা মনে রাখেননি হয়তো, কিন্তু কবির প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সুরটি হল, ‘যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম’, আর তার মানবিকতার আদর্শটি এক সজীব গণতান্ত্রিক কাঠামো ছাড়া অর্থহীন। এই গণতান্ত্রিক নৈতিকতাই জঙ্গি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে নতুন রাজনীতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

extremist nationalism university campus nationalism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE