মাঠকে মাঠের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণের এতটা ক্ষমতা হয়তো শ্রীনিও পাননি। রাহুল, মোদী আর কেজরীবাল— এই বাইশ গজের যুদ্ধে তিন জনের যে কোনও এক জনকে আপনার দলের ক্যাপ্টেন বেছে নিতে পারেন। আপনার আঙুলের টোকায় ব্যাট করাবেন, বল করাবেন এই সব দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেভিওয়েটদের। শুধু ‘স্পেস বার’, আর চারমুখো চারটে অ্যারো, এটুকুর মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে আপনার ম্যানিপুলেটিভ আঙুল। তবে খেলাটা সীমাবদ্ধ থাকবে এক, তিন কিংবা পাঁচ উইকেটের মধ্যে। ২০১৬-র মার্চ তক খেলাটা খেলেছেন দশ হাজারের বেশি নেটখেলুড়ে। ৪৪ কোটির কাছাকাছি রান করে এগিয়ে ছিলেন নমো, রাহুলের সংগ্রহ উনত্রিশ কোটির কিছু বেশি, সাড়ে আটাশ কোটি রান করে রাগা-র ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন কেজরীবাল। ‘কুর্সি ক্রিকেট’ নামে এই মায়ার খেলাটি ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে পোলিং হাওয়ায় হাওয়ায় নেটে ভেসে এসেছিল।
তবে টুর্নামেন্টের প্রথম সিজন শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, তখন এর নাম ছিল আইপিএল। ‘ইন্ডিয়ান পলিটিকাল লিগ’। নেট-জনশ্রুতি: ওই আইপিএল আটকে গেছিল পিআইএল অর্থাৎ জনস্বার্থ মামলায়, সেই কারণেই নতুন সিজনে নাম বদলে নতুন মোড়কে রাজনৈতিক ক্রিকেট। আইপিএল ২০০৯-এ আপনাকে বেছে নিতে হত হয় মনমোহনজিকে, নয় আডবাণীজিকে। খেলাটা সীমাবদ্ধ ছিল পাঁচ, দশ কিংবা কুড়ি ওভারে। আর শুধু ওই দুই ক্যাপ্টেনকেই নয়, সঙ্গে গ্যালারিতে আপনি ফাউ পেয়ে যাচ্ছিলেন জোট শরিকদেরও।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোট নিয়ে যে খেলাটি ইন্টারমায়াজালে প্রথম সাড়া ফেলে, সেটি অবশ্য ক্রিকেটের আদলে তৈরি হয়নি। তাকে ঢালা হয়েছিল সাপলুডোর ছাঁচে। নিজ নিজ দলের বা জোটের নেতাকে নিয়ে শুরু করতে হত ছক্কাবাজি। গেম উইন্ডো’র এক কোণে বনবন করে ঘুরছে ইর্যাটিক ছক্কা। এক এক ক্লিকে এক এক সংখ্যা, কখনও পুট কখনও ছয়। ঘুঁটি এগোবে ক্লিকে ক্লিকে। যদি দলের চিহ্নে, বা নিজস্ব পার্টি অফিসের আইকনে, বা ডোনেশনের থলিতে ঘুঁটি পড়ে, তা হলে তরতর করে অনেকটা উঠবে। আবার ডোনেশনের রং যদি কালো হয়, যদি বিরোধী দলের চিহ্নে, বা নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত কোনও কালা কানুনে ঘুঁটি পৌঁছে যায়, তা হলেই অ্যানাকোন্ডা কিংবা বাবুরামের সাপের ছোবলে হুহু করে তলিয়ে যাবে ঘুঁটি।
আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর মুখে এক জন বিরোধী সমর্থক জুতো ছুড়ে মারা মাত্র মন্ত্রীমশাই অনুপম রিফ্লেক্সে মাথা বাঁচালেও, জুতোটি লুফে নিলেন এক গেম ডিজাইনার। আপলোড হয়ে গেল ‘চপ্পল কি গুঞ্জ’ নামে একটি গেম। এক নেতা মঞ্চে হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা করছেন, আর সামনে বসে নানা রঙের সমর্থক। আনপ্রেডিক্টেবল আনাচকানাচ থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে দাঁড়াচ্ছে জুতো হাতে এক-এক জন। খেলুড়ের কাজ হল, নিজের ক্লিকের ঘায়ে তাকে নিরস্ত করা। ক্লিক ব্যর্থ হলেই জুতো নেতার মুখে। বাঁচালে নম্বর, ডোবালে মাইনাস।
নিন্দুকেরা যখন খেলাটির শোভনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তুখড় জবাব দিয়েছিলেন গেম-অধিকর্তারা। তাঁদের বক্তব্য ছিল— জুতো খাওয়ায় নয়, জুতো বাঁচানোয় নম্বরের ব্যবস্থা রেখে তাঁরা তো সুশীল মেজাজেরই পরিচয় দিয়েছেন।
আর একটি ভোটরঙ্গক্রীড়ায় নামানো হয়েছিল ঝুড়ি হাতে ভোট-ভিখারি এক নেতাকে। নিউট্রাল লুকের এই নেতা অনেকটা গোষ্ঠমামার মতো ধামা হাতে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন মাউসের মুভে। ওপর থেকে ভেসে ভেসে নামছে ব্যালট পেপার, ফুলের মালা, ডাস্টবিন আর পচা ডিম। ব্যালটে আর মালায় পয়েন্ট, ডাস্টবিন আর ডিমে গুনাগার। প্রোগ্রামের এমন লীলা— মালা বা ব্যালটের দিকে যেই না লাফ দিয়ে তাল ঠুকে নেতা এগিয়ে যাবেন, হঠাৎ মেঘনাদী প্রোগ্রাম হুস করে ডিম বা ডাস্টবিন টপকে দেবে ওপর থেকে, তুরন্ত পয়েন্টের মায়া ত্যাগ করে সরে না এলে, পাঁজর ঘেঁষে ঘ্যাঁচ— পয়েন্ট লোপাট।
তবে এই সব খেলার ফাঁদ নেটভুবনে পেতেছিলেন বেসরকারি ডিজাইনাররা। ২০১৪ সালে খোদ ভারতীয় নির্বাচন কমিশন রতনটি চিনে ফেললেন। বিশেষ করে নেটাসক্ত নব্য ভোটারদের বুথমুখী করে তুলতে কি এই কৌশল কাজে লাগানো যায় না? বেশ কিছু দিন ধরেই ভাবছিলেন তাঁরা। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পথের আমলে একটি জুতসই গেম-এর টেন্ডার বের করা হল।
নানা কিসিমের প্রস্তাব জমা পড়ল। সে সবের বেশির ভাগই সাপলুডোর মডেল ব্যবহার করেছিল। কিন্তু লুডোর আদলে ইতিমধ্যেই একটি বোর্ড গেম মনোনীত করে ফেলেছে এসভিইইপি SVEEP (Systematic Voter Education and Electoral Participation)। তখনকার ডিরেক্টর ধীরেন্দ্র ওঝার নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটি নতুনত্বের নিরিখে সিলমোহর দিলেন ‘গেট সেট ভোট’ নামে একটি গেমের নকশায়।
অনলাইন গেমের দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেলটি হল: ‘মেজ মডেল’ ()। বাংলায় বলা যেতে পারে, গোলকধাঁধা। বা, ভুলভুলাইয়া। মানে, স্ক্রিনে দেখা যাবে, অসংখ্য জটিল সরু সরু রাস্তা বা টানেল, এঁকেবেঁকে এ-ওর ওপর দিয়ে চলে গেছে, দেখলে গোড়ায় চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার জোগাড়, বোঝাই যাবে না এখানে খেলুড়েকে ছেড়ে দিলে, কোথা দিয়ে বেরোতে হবে, বা পৌঁছতে হবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়।
গেমটা জুতসই, কারণ, সত্যিই তো, ভারতীয় নির্বাচনের চেয়ে ভয়ানক ভুলভুলাইয়া খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গেম শুরু হবে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, যার ও-পারে শুরু হয়েছে ঘর থেকে নিজ নিজ বুথ পর্যন্ত যাওয়ার জটিল রাস্তা। খুকু এবং খোকারা উভয়েই যাতে স্বচ্ছন্দে খেলতে পারে, তাই খেলুড়ে হিসাবে বেছে নিতে হবে ফিমেল বা মেল আইকন: গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট পরিহিত একটি কিশোর, বা ফ্রক পরা ঝুঁটি বাঁধা এক কিশোরী।
দশটি পর্যায় বা লেভেলে খেলতে হবে। প্রতিটি পর্যায়েই জটিলতর হবে ভুলভুলাইয়ার ধাঁধাটে পথ। প্যাঁচালো রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে আবার রাখা
আছে তরমুজ জাতীয় রসালো ফল, খেলে এনার্জি বাড়বে! আশপাশেই ঘাপটি মেরে আছে নানা রকমের মাকড়সা জাতীয় জীব ও জীবাণু। তাদের এড়িয়ে না চলতে পারলে, হোম থেকে বেরিয়ে বুথ পর্যন্ত যাওয়াই যাবে না।
শুধু হাত চালিয়ে খেললেই হবে না, মাথাও কাজে লাগাতে হবে। মাঝে মাঝেই ভেসে উঠবে সংবিধান ও ভোটবিধান সংক্রান্ত নানা রকমের প্রশ্ন। সেগুলোরও ঠিক উত্তর দিতে হবে, পথের ধাঁধা এবং বাধা সামলাতে সামলাতেই। সমস্ত পেরিয়ে ইভিএমের ঠিক বোতামটা টিপে ভোট দিতে পারলে, একশোয় একশো।
আজ হলে ডিজাইনার নিশ্চয়ই একটা স্টিং ক্যামেরার ব্যবস্থা রাখতেন!
barun.chattopadhyay@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy