Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সব আঙুলে কালি, বাছা ভোট দিলি?

১৯৭৭ সাল। ভোটের আগের দিন বিকেলে পোলিং বুথে পৌঁছে গেল সব ভোটকর্মীরা। এ দিকে, প্রাইমারি স্কুলের বুথে তখনও লাইট নেই। আমরা সব তরুণ রাজনৈতিক কর্মী। বুথে দেখা করতে যেতেই, একটা আলোর ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের কাছে পোলিং অফিসার অনুরোধ জানালেন। আমরা তাই শুনেই সোজা চলে গেলাম জ্যাঠামশায়ের কাছে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

মুসৌমা সরকার
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৭৭ সাল। ভোটের আগের দিন বিকেলে পোলিং বুথে পৌঁছে গেল সব ভোটকর্মীরা। এ দিকে, প্রাইমারি স্কুলের বুথে তখনও লাইট নেই। আমরা সব তরুণ রাজনৈতিক কর্মী। বুথে দেখা করতে যেতেই, একটা আলোর ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের কাছে পোলিং অফিসার অনুরোধ জানালেন। আমরা তাই শুনেই সোজা চলে গেলাম জ্যাঠামশায়ের কাছে।

জ্যাঠামশাইয়ের নামটা আর লিখলাম না। উনি তখন কংগ্রেসের হোমরাচোমরা নেতা। এক সময় স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। যথেষ্ট প্রভাবশালী। কী অর্থে, কী প্রতিপত্তিতে! জ্যাঠামশাই আলোর কথা শুনেই, হাঁকডাক করে, হম্বিতম্বি লাগিয়ে, অনেকটা তার, হোল্ডার আর বাল্‌বের ব্যবস্থা করে দিলেন, আর আমরাও তক্ষুনি হুক করে আলো জ্বালিয়ে দিলাম।

একটু পরেই, জ্যাঠামশাই নিজেই সব তদারকি করতে চলে এলেন প্রাইমারি স্কুলের বুথে। দরাজ গলায় বললেন, ‘আরে, আপনারা সরকারি কাজে এখানে এসেছেন, আমাদের অতিথি। রাতে সবাই আমাদের বাড়িতেই খাবেন।’ দু-এক জন তাই শুনে কিন্তু-কিন্তু করতে লাগলেন। জ্যাঠামশাই সেটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘আসলে, আশেপাশে তো কোনও হোটেল নেই, তাই নিমন্ত্রণ জানালাম। রাতে এই ছেলেরা এসে আপনাদের নিয়ে যাবে আমার বাড়িতে— একদম পাশেই।’

এর পর আমাদের ডেকে জ্যাঠামশাই সব তোড়জোড় করার নির্দেশ দিলেন। বললেন, পুকুরে দু’খেপ জাল ফেলতে পারলে মাছ পাওয়া যাবে। তা হলে মাছের ঝোল-ভাত করতে কোনও অসুবিধাই হবে না।

আমাদের মধ্যে চিন্ত ছিল এ সব
ব্যাপারে খুব করিৎকর্মা। ও একটা গামছা পরে, মাছ ধরতে চলে এল। জাল ফেলে সত্যিই মাঝারি সাইজের কাতলা মাছ তুলল। রাত আটটা নাগাদ বুথে ওঁদের ডাকতে গিয়ে দেখলাম, ওঁরা সকলেই কাগজে লেখালেখির কাজে ব্যস্ত।

সাড়ে আটটার পর ওঁরা ছ’জন আমার সঙ্গে জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে এলেন। আসার পথে আমার সঙ্গে আলাপ করে জানলেন যে, আমি এ বারেই প্রথম ভোটার হয়েছি। সায়েন্স নিয়ে কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। এখানেই বাড়ি। কয়েকটা রসিকতাও করলেন। তখনও জানতেন না, কত বড় রসিকতার সামনে ওঁদের পড়তে হবে কালকেই!

এক তলার হল ঘরে, ডাইনিং টেবিলে ভোটকর্মীদের খেতে দেওয়া হল। আমি, চিন্ত, মণিদা, মোহন, চোয়ে— আমরা সবাই মিলে বিভিন্ন পদ পরিবেশন করছি। আর জ্যাঠামশাই একটা বিরাট বড় চেয়ার নিয়ে এক পাশে বসে সমস্ত কিছু তদারকি করছেন। ‘অ্যাই, ওঁকে আর এক পিস মাছ দে। ভাতও তো লাগবে! সত্যি, তোরা পরিবেশনটাও ঠিকমত শিখলি না।’ অযাচিত ভাবে এমন আতিথেয়তা পাওয়া বোধ করি ভোটবাবুদের কল্পনাতেও ছিল না, তাই বেশ গদগদ হয়ে তাঁরা ডিনার শেষ করলেন। কে কোথায় থাকেন, তার খোঁজখবরও নেওয়া হল।

ভারতে জরুরি অবস্থা জারির জন্য সমস্ত বিরোধী দল তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়েছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা ও আদি কংগ্রেসের সদস্যরা যুক্ত হয়ে গঠন করলেন জনতা দল। সারা দেশে কংগ্রেস (আই) ও জনতা দলের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে।

আমাদের দক্ষিণ কলকাতা সংসদীয় কেন্দ্রে জনতা দলের প্রার্থী ছিলেন অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী। আর ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রার্থী যুবনেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। প্রধান শিক্ষক হওয়ার বাসনায় আমাদের চেনা এক জন শিক্ষক সে বার প্রিয়রঞ্জনের এজেন্ট হয়ে বুথে বসেছেন। আদতে এই টিচার-টি বামপন্থী ছিলেন, বামপন্থা নিয়ে বড় বড় বক্তৃতাও দিব্যি আওড়াতেন, কিন্তু হেডমাস্টার হওয়ার লোভ তো আর যে-সে লোভ নয়! তার ওপর কিছুটা ভয়ের ব্যাপারও হয়তো ছিল!

সকাল থেকেই বুথে বিরাট লম্বা লাইন। আমি কিন্তু অবাধে বুথে যাতায়াত করছি। ন’টা নাগাদ প্রথম নিজের ভোটটা ব্যালটে ছাপ মেরে বাক্সে ভরে দিলাম। বুথকর্মীরা বাঁ হাতের তর্জনীতে কালির দাগ দিলেন। সাড়ে ন’টায় পরের ভোট, একটা স্লিপ নিয়ে ঢুকে পড়লাম। মধ্যমায় কালির দাগ দেওয়া হল। এর পর অনামিকা, কনিষ্ঠা ও বুড়ো আঙুলে সব ক’টায় একটা করে ভোট দেওয়া হল। ভোটকর্মীরা মুখের দিকে চেয়ে হাসছেন। কী করবেন, কাল পেট ভরে মাছের ঝোল-ভাত খেয়েছেন তো, ‘বেইমানি’ করবেন কী করে?

পরের বার ভোটার স্লিপ নিয়ে ঢুকতে ভোটকর্মী বললেন, ‘আর কোথায় কালি দেব? এ বার কপালে দিই?’ আমি আর কী করি, হাসি চাপতে চাপতে, ফোঁটা নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথাটা ঝোঁকালাম।

বুথের সামনেই ঘোরাফেরা করছিলেন জ্যাঠামশাই। ছেলেদের মধ্যে যাকেই সামনে পাচ্ছেন, ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ভোট দিতে। অনেকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে ‘আসছি’ বলে সামনে থেকে সরে পড়ছে।

আসল মুশকিল হল, যখন লাইনে দাঁড়ানো এক জন বামপন্থী সমর্থকের ভোটটা দেবার জন্য জ্যাঠামশাই আমাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন। ও দিকে লাইন থেকে সেই লোকটি ক্রমাগত চিৎকার করছেন, ‘আমি কিন্তু ছাড়ব না, আমার ভোট আমি দেবই।’ ভেতরে ঢুকে শিক্ষক-এজেন্টটিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘কী করি বলুন তো?’ সত্যি, খুব খারাপ লাগছিল।

ব্যালট পেপার নিয়ে, বিবেকের তাড়নায় সেই ভোটটা দিলাম বামপন্থীদের সমর্থিত জনতা দল প্রার্থী দিলীপ চক্রবর্তীর ‘লাঙল কাঁধে চাষি’ প্রতীকে। মনের ওপর চাপ পড়ায় বুথ ছেড়ে বাড়ি চলে এলাম। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। আমিই বা বুঝব কী করে, এতগুলো ছাপ্পা ভোট দেওয়ার পর, হঠাৎ একটা দিতে গিয়ে আমার নিজেকে এতটা অপরাধী লাগবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE