Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ক্যালিফোর্নিয়ায় কেলেঙ্কারি

আড়াই বছরের শিশু স্কুল থেকে ফিরে মাকে জানাল তার যৌন হেনস্তার কথা। ৩০০-রও বেশি শিশু পরে বলল একই কথা। বিক্ষোভ, স্কুলে তালা, মামলা। আড়াই বছর বাদে টনক নড়ল মনোবিদদের। ক্যালিফোর্নিয়া, আশির দশক।আড়াই বছরের শিশু স্কুল থেকে ফিরে মাকে জানাল তার যৌন হেনস্তার কথা। ৩০০-রও বেশি শিশু পরে বলল একই কথা। বিক্ষোভ, স্কুলে তালা, মামলা। আড়াই বছর বাদে টনক নড়ল মনোবিদদের। ক্যালিফোর্নিয়া, আশির দশক।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

অগস্ট, ১৯৮৩। সকালবেলাতেই ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানহাটন বিচ পুলিশ স্টেশনে একটা ফোন এল। ও পারে এক মহিলা। নাম জুডি জনসন। শহরের খানদানি এলাকার বাসিন্দা। তাঁর আড়াই বছরের ছেলেটি সদ্য ঢুকেছে ম্যাকমার্টিন প্রি-স্কুলে। জুডি পুলিশের কাছে ওই স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চান। ভয়ংকর অভিযোগ। স্কুলে তাঁর ছেলের ওপর নাকি যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। প্রি-স্কুলটির মালকিন ভার্জিনিয়া ম্যাকমার্টিনের নাতি, পঁচিশ বছরের রেমন্ড বাকে-ই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। ছোট্ট ছেলেটির ডায়াপারে রক্তের দাগ আর পটির সময় যন্ত্রণা দেখে জুডির সন্দেহ হয়, পায়ুসঙ্গম করা হয়েছে তাঁর ছেলে ম্যাথুর সঙ্গে।

হুলুস্থুল পড়ে গেল পুলিশের মধ্যে। ডেকে পাঠানো হল নির্যাতিত শিশুটিকে। তার পর কী হল, সেই নিয়ে অবশ্য নানা মত। কেউ বলেন, শিশুটি পুলিশকে জানায়, রে বাকে সত্যিই তাকে নিগ্রহ করেছিল। আবার কেউ বলেন, শিশুটি নিগ্রহকারী হিসেবে শনাক্তই নাকি করতে পারেনি অভিযুক্তকে। সে যা-ই হোক, তার কিছু দিনের মধ্যেই পুলিশ রে বাকে-র বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ‘প্রমাণ’ হিসেবে বেশ কিছু জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে। যেমন, রবারের তৈরি খেলনা হাঁস, গ্র্যাজুয়েশন রোব, টেডি বিয়ার আর কিছু প্লেবয় ম্যাগাজিন। এবং ৭ সেপ্টেম্বর শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বাকে-কে।

এতেই শেষ নয়। পর দিনই পুলিশ চিফ চিঠি পাঠালেন ম্যাকমার্টিন স্কুলের প্রায় ২০০ অভিভাবকের কাছে। বক্তব্য: রে বাকে-র বিরুদ্ধে ওঠা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত করছেন তাঁরা। এখন অভিভাবকরাও যেন এই ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করেন। তাঁরা যেন সন্তানকে প্রশ্ন করে দেখেন, সে কোনও অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখেছে কি না বা নিজেই তার শিকার হয়েছে কি না। যেমন— ওরাল সেক্স, শরীরের গোপন স্থানে হাত দেওয়া, নগ্ন করে ছবি তোলা, ইত্যাদি। রে বাকে কোনও বাচ্চাকে নিয়ে ক্লাস থেকে একলা বেরিয়ে যাচ্ছেন বা কোনও বাচ্চাকে বেঁধে রাখছেন— এমন কোনও তথ্য যদি বাবা-মা জানতে পারেন, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশকে খবর দেন। আর এই পুরো ব্যাপারটা যেন ভীষণ গোপন রাখা হয়, ইত্যাদি...

দিন কয়েকের মধ্যেই অবশ্য চিঠির কল্যাণে গোটা এলাকার প্রায় প্রত্যেকেই জেনে গেল, কী সাংঘাতিক কাণ্ডটাই না চলছে ওই স্কুল চত্বরে! জু়ডি তত দিনে একটার পর একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিযোগ তুলছেন। পড়াশোনা নয়, শয়তানি কাজকর্ম হয় স্কুলের মধ্যে। রে বাকে সান্টা ক্লজের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ান। রে-র মা পেগি নাকি জুডির ছেলে ম্যাথুকে এক দিন চার্চে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে এক শিশুর মাথা কেটে ফেলা হয়, আর ম্যাথুকে জোর করে তার রক্ত খাওয়ানো হয়। প্রি-স্কুলের অন্য শিক্ষকরা নিয়মিত খরগোশ কাটে। আর তারার মতো কিছু জিনিস নাকি ম্যাথুর শরীরের নিম্ন ভাগে আটকে দেওয়া হয়েছিল।

এই সময় ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস থেকে কি ম্যাকফারলিন-কে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কুলের অন্য শিশুদের সঙ্গে কথা বলার। ম্যাকফারলিন চিলড্রেন্স ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি থেরাপি ক্লিনিক চালাতেন। ওই স্কুলের কয়েকশো বাচ্চার সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, হ্যাঁ, নির্যাতন হয়েছে বিলক্ষণ। সংখ্যাটা বড় কম নয়, সাড়ে তিনশোরও বেশি শিশু সেই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার। শিশুরাই নাকি সে কথা জানিয়েছে। তারা কি কখনও মিথ্যে বলতে পারে? সত্যিই তারা জানিয়েছে, স্কুলের মধ্যে ডাইনিরা ঘুরে বেড়ায়, বেলুনে চড়ে ওড়ে। বাড়ির ভিতরে নাকি একখানা সুড়ঙ্গও আছে। বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। সেখানেই চলে নির্যাতন।

ফল, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত যে স্কুলটি এত কাল চলেছে রমরম করে, ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসেই তাতে পাকাপাকি ভাবে তালা পড়ল। আর মার্চ মাসে রে বাকে-র সঙ্গে জেলে ঢুকলেন তাঁর দিদিমা ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ভার্জিনিয়া ম্যাকমার্টিন, মা পেগি, বোন অ্যান এবং স্কুলের আরও তিন শিক্ষিকা। প্রথম শুনানির পর জানা গেল, সাত অভিযুক্ত যে সমস্ত যৌন অপরাধমূলক কাজ করেছেন, তার সংখ্যা প্রায় চারশোর কাছাকাছি। এবং এই স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরও তিরিশ জনের বিরুদ্ধেও চলছে তদন্ত।

তত দিনে চিলড্রেন্স ইনস্টিটিউটও রাস্তায় নেমে পড়েছে। এই স্কুল এবং আরও যে সমস্ত ডে কেয়ার সেন্টার এত দিন ধরে বিরাট কারবার ফেঁদে বসেছে মার্কিন মুলুকে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে। সাড়াও মিলল বিস্তর। সরকারি সাহায্যই এল প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলারের। বেসরকারি সাহায্যও এল প্রচুর। স্বাভাবিক। নিজের একরত্তিটাকে স্কুল আর ডে-কেয়ারের হাতে দিয়েই তো নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের সারা দিনের কাজে ডুব দিতে পারেন বাবা-মায়েরা। সেই ভরসার জায়গাতেই এক বিরাট কোপ দিয়েছে ম্যাকমার্টিন স্কুল। তাই চলুক তদন্ত। দেখা যাক, ভরসার সুযোগে কত দূর জঘন্য কাজের জাল বিছিয়েছে তারা।

অভিযোগ তো এল। কিন্তু প্রমাণ? দেখা গেল, সেই জায়গাতেই এক বিশাল ফাঁক। অভিযুক্তদের বাড়ি তন্নতন্ন খুঁজেও কিছুই প্রায় মিলল না, যা দিয়ে আরও চেপে ধরা যাবে তাঁদের। বাচ্চাদের হামেশাই নাকি নগ্ন করে ছবি তোলা হত ওই স্কুলে। কিন্তু কই সে সব ছবি? আর সেই সুড়ঙ্গ, যেখানে নাকি বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতেন রে বাকে আর অন্য অভিযুক্তরা? নিশ্চয়ই আছে ওই স্কুলের মধ্যেই কোথাও! অ্যাত্তগুলো বাচ্চা কি আর গপ্পো বানাবে? সুতরাং, জনাপঞ্চাশেক অভিভাবক চললেন সুড়ঙ্গ অভিযানে। চলল খোঁড়াখুঁড়ি। দিন কয়েক পর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিস অভিভাবকদের সাহায্য করার জন্য ভাড়া করে আনল এক আর্কিয়োলজিক্যাল ফার্ম। আরও পেশাদারি দক্ষতায় চলল খোঁড়ার কাজ। কিন্তু কোত্থাও সন্ধান মিলল না সুড়ঙ্গের।

নির্যাতিত বাচ্চারা যে নগ্ন করে ছবি তোলার অভিযোগ করেছিল, পরে জানা গেল সেটা আসলে একটা খেলা। অন্য বাচ্চাকে দুষ্টুমি করে খোঁচানোর সময় ছড়া কেটে বলা হত, ‘হোয়াট ইউ সে ইজ হোয়াট ইউ আর, ইউ আর আ নেকেড মুভি স্টার’। এর সঙ্গে নগ্ন করে ছবি তোলার কোনও সম্পর্কই নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁর একটা ফোনে এমন ভয়ংকর ডামাডোলের শুরু, জানা গেল, সেই জু়ডি জনসন প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ার শিকার। জুডি নিজেই স্বীকার করেন, ঘটনার আকস্মিক অভিঘাতে নয়, বরং আগে থেকেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। পরে ওই মামলা চলাকালীনই তাঁর মৃত্যুও হবে অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে।

তা ছাড়া প্রায় দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা প্রাথমিক শুনানির শেষ ভাগে পৌঁছে সরকার পক্ষের অনেকেরই টনক নড়ে, মামলাটা কেমন যেন অযৌক্তিক ঠেকছে। বাচ্চারা যা বলছে, কোনওটাই বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। হাতে প্রমাণও নেই। ফলে সরকার পক্ষের অনেকেই ধীরে ধীরে মামলা থেকে সরেও আসেন। পরে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাবে যে, ‘নির্যাতিত’ শিশুদের সামনে এমন ভাবে প্রশ্নগুলি রাখা হয়, যাতে তাদের মধ্যে সম্ভবত এক ধরনের ‘ফলস মেমরি সিনড্রোম’ দেখা দিয়েছিল। অর্থাৎ, বাইরের চাপে সেই সব দিনের আসল স্মৃতি মুছে শিশুরা এমন এক স্মৃতি খুঁড়ে বের এনেছিল, যা আসলে ঘটেইনি। ম্যাকফারলিন যখন প্রথম দিকে তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তখন আসলে তিনি যা শুনতে চেয়েছিলেন এক তুমুল হুল্লোড় তোলার জন্য, বাচ্চারাও অবিকল সেটাই উগরে দিয়েছিল।

মাইকেল ম্যালোনি, এক ব্রিটিশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং সাইকায়াট্রি বিভাগের প্রফেসর, বাচ্চাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিয়ো টেপগুলি দেখে প্রচণ্ড সমালোচনা করে বলেন, সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতিতে চলেছে ইন্টারভিউ, জবরদস্তি তাদের মুখে কথাগুলো যেন বসিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক বাচ্চার বয়ান আসলে প্রশ্নকর্তারই তৈরি করে দেওয়া। কারণ রেকর্ডিং-এ তারা যেটুকু কথা বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বকেছে বড়রা। বিচারপতিরা অভিযুক্তদের ‘দোষী’ মানতে না-চাওয়ার যুক্তি হিসেবে এই রেকর্ডিংগুলি ব্যবহার করে দেখান, কী ভাবে কোনও সত্যিকারের নির্যাতনের ঘটনা ছাড়াই শিশুদের বাধ্য করা যায় নানা রং-চড়ানো বিবৃতি দিতে।

কিন্তু তত দিনে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। আমেরিকার ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল মামলাগুলোর মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে ‘ম্যাকমার্টিন ট্রায়াল’। কয়েক বছর পর অভিযুক্তরা বেকসুর ছাড়া পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মিশে গিয়েছে তাঁদের সামাজিক সম্মান, শেষ হয়ে গিয়েছে কেরিয়ার। আইনের মারপ্যাঁচে রগড়াতে রগড়াতে বিধ্বস্ত বাচ্চাগুলোও।

এ তো না-হয় ম্যাকমার্টিন স্কুলের ঘটনা। আমাদের ছেলেবেলাতেও কি গপ্পো বানানোর প্রবণতা ছিল না? তখনও কি দুই-তিন-চার বছুরেগুলো বিশ্বাস করত না লালকমল-নীলকমল, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির অস্তিত্ব? দাদু-ঠাকুমারাই তো গড়ে দিত সেই দুনিয়া, যাতে দৈত্য এসে রাজকন্যাকে চুরি করে আর রাজপুত্তুর এসে দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে তাকে উদ্ধার করে। আমরা তো তখন সেই গপ্পই নিয্যস বিশ্বাস করতাম। কিন্তু কোথাও যেন বাস্তবের সঙ্গে তার ফারাকটাও বুঝতে পারতাম। এই ফারাকটাই হারিয়ে ফেলেছে ই-যুগের শিশুরা। রূপকথার রাক্ষসখোক্কসরা এখন দিনদুপুরেই হানা দেয়! কল্পনা আর রোজকার জীবন যেন মিলেমিশে একাকার। ফলে, কোনও একটা ঘটনা, যা হয়তো আসলে ঘটেইনি, ছোটটার সামনে বড়রা যখন আলোচনা করছে এবং বাচ্চাটিকে ঘিরেই করছে, তখন অনেকেই বেমালুম নিজেকে ওই ঘটনারই অংশ ভাবতে শুরু করছে। তার পর তাতে খানিক নিজের মতো মিলিয়ে নিচ্ছে জল, রং। এমনটাই হয়তো হয়েছিল ওই স্কুলে, ওই সময়ে। এমনকী দেখা যায়, ওই একই সময় শহরের অন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের বাচ্চারাও একই অভিযোগ জানাতে শুরু করেছে। তাই দরকার আসলে শিশুদের ‘শিশুসুলভ’ বয়ান থেকে সত্যের নির্যাসটুকু ছেঁকে নেওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE