Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

৩৪ বছর ধরে তালাবন্ধ, কী আছে পুরীর জগন্নাথের রত্নভান্ডারে?

সদ্য চাবি হারানোর জেরে তোলপাড়,  অবশেষে আলো পড়ল রহস্যময় অন্ধকার কুঠুরিতে। কী আছে পুরীর জগন্নাথের রত্নভান্ডারে? সদ্য চাবি হারানোর জেরে তোলপাড়,  অবশেষে আলো পড়ল রহস্যময় অন্ধকার কুঠুরিতে।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

একদা জগন্নাথের দর্জি সেই অতিবৃদ্ধ অন্ধ সেবায়েত নাকি এখনও পুরীতে আছেন। মন্দিরের কাছেই থাকেন। বছর ৪০ আগে তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার কাহিনি কিংবদন্তির মতো পাক খায় মন্দিরের আনাচে-কানাচে!

‘‘তাঁর ভাল নাম শ্রীধর বা কিছু একটা হবে বোধহয়। ডাকনাম সিরিয়া,’’ বলছিলেন জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভান্ডার সাব-কমিটির সদস্য, জগন্নাথের অন্নভোগ-খাজা-গজার তরুণ শেফ অনন্ত তিয়াড়ি। ‘‘প্রভুর অলঙ্কারের রত্নের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ফেলেছিলেন। সেই জ্যোতি কি কেউ খালি চোখে সইতে পারে!’’ মাঝ-তিরিশের অনন্ত কলেজ পাশ স্নাতক। ইংরেজিতে সড়গড়।

মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, রথের সময়ে জগন্নাথের সহচর ভাই দয়িতাপতিদের মনিটর (বড়গ্রাহী) রামচন্দ্র দাস মহাপাত্রের চোখেমুখেও রত্নভান্ডারের নামে গভীর সম্ভ্রম। বললেন, ‘‘কাছে গিয়ে প্রভুর মাথার মণির দিকে খানিক তাকালে টের পাবে, কী তেজ!’’ গর্ভগৃহের বাইরে ছোট আলো, জগন্নাথের দিকে তাক করে লাগালে নাকি দিন পনেরোয় বাল্‌ব কেটে যায়। গর্ভগৃহে দর্শনের সময় সেবায়েত খুটিয়া, মেকাপেরা এখন হয়তো ভক্তকে দেখাচ্ছেন, ওই দেখো, প্রভুর মাথায় ব্রহ্মজ্যোতি হীরা! জগন্নাথের এত রত্ন-অলঙ্কার দেখানোর বিনিময়ে দক্ষিণাটা একটু চড়া হবে বইকী!

পুরীর মন্দিরের রত্নভান্ডারের চাবি-রহস্য নিমিত্ত মাত্র! আসল রহস্য রত্ন নিয়ে এই লোকগাথায়। এমনিতে তিরুপতি বা দক্ষিণ ভারতের আরও কিছু মন্দিরের সম্পদের মাপে বাঙালির জগন্নাথকে মধ্যবিত্ত মনে হতে পারে। ১০০০ কোটির কাছাকাছির মালিক তিরুপতির পাশে পুরীর ঠাকুরের ভাঁড়ারে সোনার পরিমাণ বড়জোর ২২১ কোটি টাকা হবে। কিন্তু জনমানসের অতলের রহস্য কবে আর টাকাকড়ির শুকনো হিসেবের পরোয়া করেছে! জগন্নাথের মিতভাষী শেফ অনন্ত নইলে ব্রহ্মজ্যোতি হিরের কথায় এতটা উদ্বেল হন! বেশির ভাগ সেবায়েতের তুলনায় ডিগ্রিধারী আলোকপ্রাপ্ত, একেবারেই কম বয়সে মন্দিরের সরকারি ম্যানেজিং কমিটিতে ঠাঁই করে নিয়েছেন এই সেবায়েত। মন্দির লাগোয়া সরকারি অফিসঘরে বসে এক বিকেলে টেবিলের পেপারওয়েটটা হাতে নিয়ে জগন্নাথের মাথার সেই অমূল্য হিরের মাপ বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। শেষটা বলে ওঠেন, ‘‘সাইজ এর অর্ধেকের একটু কম! তবে হাতে নিলে বডিতে যা কারেন্ট খেলে যায়, কী করে বোঝাব!’’ জগন্নাথের মাথার ভূষণ সোনার চিতার ফ্রেমে জ্বলজ্বল করে সেই হীরকখণ্ড। গুরুপূর্ণিমার ক’দিন বাদে চিতালাগি অমাবস্যায় এই আভরণ মাথায় ধারণ করেন প্রভু। আর আসন্ন স্নানযাত্রায়, রথের আগে যে দিন ঘড়া-ঘড়া জল ঢেলে চান করে মানবরূপী জগন্নাথ জ্বরে কাবু হবেন, সে দিনই সেই হীরকখচিত স্বর্ণচিতা তাঁর মাথা থেকে ফের রত্নভান্ডারের অন্দরে চালান হয়ে যাবে।

জগন্নাথের মাথার ব্রহ্মজ্যোতি হিরে, বলরামের মাথার নীলা বা সুভদ্রার মাথার মানিক, সবই রত্নভান্ডারের বাহির-ভান্ডারে রাখা থাকে। মন্দিরের সেবায়েত থেকে প্রশাসক— সবাই চোখ গোল গোল করে বলবেন, বাহির-ভান্ডারেই যদি এত মণি-মাণিক্য থাকে, তবে ভিতর-ভান্ডারের চেহারাটা এক বার কল্পনা করুন। কল্পনা করা ছাড়া গতি নেই! কারণ, বাঘা-বাঘা সরকারি কর্তা, হাইকোর্টের নির্দেশে যাঁরা রত্নভান্ডার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, কী দেখেছেন জানতে চাইলে করজোড়ে মাপ চাইবেন! শুদ্ধ গামছামাত্র ধারণ করে রত্নভান্ডারে ঢোকার আগে লাগোয়া অফিসঘরে দেব লোকনাথের রুপোর মূর্তি ছুঁয়ে তাঁরা শপথ নিয়েছেন। আর ভান্ডারের প্রহরী লোকনাথ জগন্নাথদেবের মতো করুণাপরবশ, নরম-সরম নন। তিনি চটলে বিপদ!

তবে রত্নভান্ডারের ভিতর-ভান্ডারের চাবি হারালেও তার চেহারাটা এ বার অনেক জোড়া চোখের সামনেই স্পষ্ট হয়েছে। শেষ বার ভান্ডারের সম্পদের খতিয়ান নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৮-এ! তার পরে ’৮৪ সালে জগন্নাথের স্বর্ণচিতার মেরামতির দরকারে কিছু সোনার খোঁজে ভিতর-ভান্ডার খোলা হয়। সেই শেষ! তার পরে দশকের পর দশক অন্ধকার কুঠুরিতে জমেছে রহস্য। মন্দিরের জরাজীর্ণ দশা খতিয়ে দেখতেই গত ৪ এপ্রিল রত্নভান্ডার পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই মতো সরকারি কর্তা, ইঞ্জিনিয়ার থেকে সেবায়েত— ১৭ জনের দল মন্দিরে হাজির হয়। গর্ভগৃহ আর ভক্তদের ওয়েটিং রুমের মাঝের অংশ ভিতর-কাঠের বাঁ দিকেই রত্নভান্ডারের প্রকাণ্ড তালাবন্ধ দরজা। তার চাবি তিন জোড়া। পুরীর গজপতি রাজা, মন্দিরের সরকারি প্রশাসকের অফিস আর ভান্ডারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জিম্মাদার ভান্ডার মেকাপের কাছে তা রাখা থাকে। তিন মাথা একত্র না হলে বাহির-ভান্ডারই খুলবে না। সেখানেই রাখা থাকে বিভিন্ন পালাপার্বণে প্রভুর বেশভূষা— উল্টোরথে মন্দির প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে রথারূঢ় জগন্নাথের সোনার বেশ বা মন্দিরের রাজরাজেশ্বর বেশের ধড়াচুড়ো। ভিতর-ভান্ডারের সম্পদ সচরাচর জগন্নাথের কাজে লাগে না।

অন্ধকার সেই কুঠুরিতে প্রয়োজনের বাইরে সন্ধান দস্তুর নয় সেবায়েতকুলে। প্রভুর দারুমূর্তির ভিতরে ব্রহ্মবস্তুর মতো রহস্যময় কুঠুরির পরিবেশও। অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি, ছোঁয়াছুঁয়ির স্পর্ধা কেউই রাখেন না। গত ৪ এপ্রিল, কাজের তাগিদেই কড়া সার্চলাইটের আলো পড়েছিল রত্নভান্ডারের ভিতরে। মন্দিরের সাবেক বিশ্বাস, অন্ধকার কুঠুরিতে সাপখোপের রাজত্ব। পরিদর্শন কমিটির সঙ্গে তাই সাপ-তাড়ানোর ওঝা ছিল। কোলাপসিবল গেটের মতো জাফরি-কাটা দরজার ও-পারে কড়া আলো তাক করতেই গুচ্ছের মিথ যেন খসে-খসে পড়ল।

না, রত্নভান্ডারের সাতটা না দশটা কুঠুরির গল্পও নিছকই আষাঢ়ে গপ্পো। বাহির-ভান্ডারের তুলনায় খানিকটা বড় ভিতর-ভান্ডার হল, ২০ বাই ২০ ফুটের একখানা ঘর। সার্চলাইটের আলোয় হিরে-জহরতের দ্যুতিতে কারও চোখ ঝলসে যায়নি। সেই ঘরে শুধু গোটা দুয়েক আলমারি আর তিন-চারটে ট্রাঙ্ক রাখা। আর হ্যাঁ, ঘরের দেওয়ালে চিড় ধরেছে নানা জায়গায়। সংস্কার দ্রুত প্রয়োজন।

শিবের প্রলয়ঙ্কর রূপ, পুরীর জগন্নাথের রত্নভান্ডারের ‘সিকিয়োরিটি’ লোকনাথকে ছুঁয়ে নেওয়া শপথের ফাঁকফোকরে রত্নভান্ডারের কুঠুরি বিষয়ে এটুকু খবর আদায় করা গিয়েছে। সম্পদের পরিমাণ নিয়ে ভরসা অবশ্য মন্দিরের ১৯৭৮-এর নথিই। শোনা যায়, একদা রামনবমীর পরে জগন্নাথের বিশেষ সাজ রঘুনাথ বেশের গয়নাগাঁটি ভিতর-ভান্ডারেই রাখা। কোনও গুপ্ত ভান্ডারের চিচিং-ফাঁক গুহা নয়, ট্রাঙ্ক-আলমারি ঠাসা সাবেক ভাঁড়ারঘরের মতোই বরং ছবিটা। তাতে কী? চাবি খুলে সেই অজানা রহস্য কে চাক্ষুষ করেছে? বন্ধ রত্নভান্ডার এখনও বুলিয়ে চলেছে গভীরতর রহস্যের প্রলেপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jagannath Temple Ratna Bhandar Keys Missing Puri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE