Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

এই কলম থামতে দেওয়া চলবে না

সাঁওতাল লেখক হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখরের বই নিষিদ্ধ করল ঝাড়খণ্ড সরকার। লেখকের উপরে নেমেছে শাস্তির কোপ। কী সেই গল্প, যার বিরুদ্ধে মিছিল বেরোল রাস্তায়, পুড়ল কুশপুতুল? হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখরের গল্প নাকি সাঁওতাল মেয়েদের অপমান করেছে। তাঁর রুচি বিকৃত, মনোভাব অশ্লীল। ‘‘গল্প পড়ে মনে হয় তিনি নিজেই তাঁর গল্পের চরিত্র,’’ সাংবাদিকদের বলেছেন এক সাঁওতাল মহিলা কবি।

নিষিদ্ধ: হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর ও তাঁর বই ‘দি আদিবাসী উইল নট ডান্স’-এর প্রচ্ছদ

নিষিদ্ধ: হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর ও তাঁর বই ‘দি আদিবাসী উইল নট ডান্স’-এর প্রচ্ছদ

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৯:১০
Share: Save:

প্রথম বইয়ের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমির যুবা পুরস্কার। আর দ্বিতীয় বইয়ের জন্য হেঁটে কাঁটা-উপরে কাঁটা। বই তো নিষিদ্ধ হয়েইছে, চাকরি খুইয়ে জেলে যেতে পারেন তরুণ লেখক।

হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখরের গল্প নাকি সাঁওতাল মেয়েদের অপমান করেছে। তাঁর রুচি বিকৃত, মনোভাব অশ্লীল। ‘‘গল্প পড়ে মনে হয় তিনি নিজেই তাঁর গল্পের চরিত্র,’’ সাংবাদিকদের বলেছেন এক সাঁওতাল মহিলা কবি। গল্পে একটিই পুরুষ চরিত্র রয়েছে, তা ধর্ষকের। হাঁসদার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের একটা অংশ মিছিল করেছে, হাঁসদার কুশপুতুল পুড়িয়েছে, বইয়ের সব কপি পোড়াবে বলেও হুমকি দিয়েছিল। শেষতক গল্পের সংকলনটাই নিষিদ্ধ করেছে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার। কাজ থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন হাঁসদা। তিনি সরকারি ডাক্তার, পোস্টিং পাকুড়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সরকারি অনুমতি না নিয়ে কেন বই ছাপিয়েছেন, সেই দায়ে সাসপেন্ড হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকানোর জন্য এবং আদিবাসীদের অবমাননার জন্য শক্ত আইনি ধারায় মামলা করা হতে পারে তাঁর বিরুদ্ধে। যদি ঝাড়খণ্ডের সরকার শেষ অবধি সে পথে হাঁটে, তা হলে আদালতের লড়াই সহজ হবে না।

কী এমন লিখলেন হাঁসদা? কী সেই গল্প, যার জন্য চাকরি খুইয়ে জেলে যাওয়ার জোগাড় পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের এক লেখকের?

গল্পটা সাড়ে তিন পাতার, মিনিট দশেকের একটা ঘটনা নিয়ে। বাবা-মা, এক বোন আর গ্রামের প্রতিবেশী মিলিয়ে জনা তেতাল্লিশের একটি দলের সঙ্গে চলেছে তালামাই। ‘তালা’ মানে মেজ, ‘মাই’ অর্থাৎ মেয়ে। বর্ধমানে নাবাল খাটতে যাচ্ছে তারা। মানে পরের জমিতে ধান কাটতে যাচ্ছে। কয়লার ট্রাক থেকে কয়লা চুরি করা, নইলে ভিন রাজ্যে ধান কাটা, এ ছাড়া কাজ জোটে না তাদের। যেতে যেতে দল থেকে একটু সরে আসে তালামাই, রেল পুলিশের এক জওয়ান তাকে ইঙ্গিতে ডাকছে। খাবার চাই? টাকা চাই? একটা কাজ করলে মিলবে। এ কাজ আগেও করেছে তালামাই। কয়লাচোর সাঁওতাল মেয়েরা এ কাজ করে ট্রাকচালকদের সঙ্গে। তালামাই জানে, যা করার ওই লোকটাই করবে। নিজেকে মেলে দিয়ে সে চিন্তাহীন, নিষ্পলক শুয়ে থাকে। গামছার নীচে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের যেমন ঠান্ডা, তেমনই শীতল বছর কুড়ির মেয়েটি। ‘জল ভরার মাটির গামলার মতো’ নিশ্চুপ, নিস্পন্দ। ‘কাজ’ শেষ হলে লোকটা দু’টো ঠান্ডা ব্রেড পকোড়া আর পঞ্চাশটা টাকা দেয় তালামাইকে। পকোড়া দু’টো খেয়ে টাকাটা ব্লাউজে গুঁজে ফের দলের সবার সঙ্গে যোগ দেয় তালামাই।

সাঁওতাল তরুণী আর ‘দিকু’ পুলিশের সঙ্গম, কার্যত ধর্ষণের দৃশ্যের বিবরণে লেখক একেবারে চাঁছাছোলা, শিষ্টতার সামান্য আবরণ সেখানে নেই। যেমন ঘটছে, তেমনি লিখছেন। তার চাইতেও বেশি অস্বস্তি হয় লেখকের গল্পের এই ইঙ্গিতে যে এ ঘটনা নিত্যদিনের, এতে হঠাৎ করে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। মোচড় মেরে সেন্টিমেন্ট চাগিয়ে তোলা লেখকের কাজ নয়।

খবরে জানা যাচ্ছে, প্রধানত খ্রিস্টান মিশনারি প্রভাবিত আদিবাসীরা হাঁসদার বিরুদ্ধে আপত্তি করেছেন। তার কারণ আন্দাজ করা কঠিন নয়। ‘নভেম্বর ইজ দ্য মান্থ অব মাইগ্রেশন’ (নভেম্বর ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়ার মাস) নামে যে গল্পটা নিয়ে এত হইচই, তার চরিত্র তালামাই আর তার পরিবার খ্রিস্টান, কিন্তু কোনও দিন মিশনারি স্কুলের ভিতরে পা রাখেনি, পড়াশোনা শেখেনি, ভাল কাজও পায়নি। প্রতিশ্রুতি পেয়েছে শুধু। যে সংকলনে রয়েছে এই গল্পটি, তার নাম ‘দি আদিবাসী উইল নট ডান্স।’ সংকলনের শেষ গল্প, ‘এই আদিবাসী নাচবে না।’ সেখানে আক্রমণ আরও সোজাসুজি। এক প্রবীণ আদিবাসী পুরুষ বলছেন, খ্রিস্টান মিশনারিরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বলে বোঙ্গা-বুরুকে পুজো না করতে। হোপনা, সোম, সিংরাই নাম বদলে করে দেয় ডেভিড, মিখাইল, ক্রিস্টোফার। কেন? কেন আদিবাসী নাচবে সেই জমিতে দাঁড়িয়ে, যা সরে যাচ্ছে তাদের পায়ের তলা থেকে? হাঁসদার গল্পে ওই প্রবীণ সাঁওতালকে হাজতে পোরে পুলিশ, নাচতে রাজি না হওয়ার জন্য। সাঁওতালদের এমন অপমান যিনি ধরেছেন কলমে, তিনিই সাঁওতালদের অপমান করছেন? সত্যি?

হয়তো অনেকে মনে করছেন, পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের মেয়েরা অল্প কিছু টাকা বা খাবারের জন্য যৌনসঙ্গমে আপত্তি করে না, এমন একটা কথা ‘নভেম্বর…’ গল্পটিতে বলা হয়েছে। ধর্ষণরত পুলিশটি যে বলে, ‘‘তোরা সাঁওতাল মেয়েরা এর জন্যই তৈরি হয়েছিস, দিব্যি মেয়েছেলে তুই,’’ এতেও কেউ কেউ চটতে পারেন। আন্দাজ হয়, হাঁসদা যে এ কথাগুলো লিখতে পেরেছেন, সম্ভবত তার কারণ এই যে তিনি নিজে আদিবাসী। অবমাননার কালি নিজের মুখেও। সেই যন্ত্রণা তাঁকে লেখার অধিকার দিয়েছে, এমনই কি ভেবেছিলেন তিনি?

তবে হাঁসদা আদিবাসী মেয়েদের সম্পর্কে কী ভাবেন, বুঝতে সংকলনটা একটু উলটে-পালটে নিতে হত। এই লেখকই লিখেছেন বাসন্তী বা বাসো-ঝির গল্প, যার নিজের ছেলেরা তাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে। যেখানে আশ্রয় পায় সে, সেখানেও দু-একটি মৃত্যুর পর ফিসফাস শুরু হয়। গৃহকর্ত্রী রোজ রাতে জেদ করতে থাকে, চলে যেতে হবে বাসন্তীকে। গৃহস্বামী রাজি হতে পারে না, বিষধর সাপের মতো নীরবতা সরসরিয়ে ঘুরে বেড়ায় গোটা সংসারে। এক দিন সত্যিই চলে যায় বাসো-ঝি। কোথায়, কেউ জানে না।

কেউ জানে না সেই ছেলেটা কে ছিল, যে রাস্তায় বারবার জিলিপি চাইছিল সুভাষিণীর কাছে। সুভাষিণী তখন চালকলে কাজ করে নিজের অসুস্থ ছেলে কুনারামের জন্য জিলিপি নিয়ে ফিরছে, অন্যের ছেলেকে দেবে কী করে। একটু ভয় ভয়ও করে তার, ডাইনরা নাকি মরে গেলে শিশুর চেহারা নেয়। এমনই কপাল, সে দিনই মেলেনি ট্রেকার, বাস। পড়িমরি করে যখন ঘরে পৌঁছল সুভাষিণী, কুনারাম চোখ বুজেছে। মেয়ে বলল, ও বারবার জিলিপি চাইছিল মা, খুঁজছিল তোমাকে।

এই যে বাস্তবের সঙ্গে অতিপ্রাকৃতিক জগতের স্বচ্ছন্দ সহবাস, হাঁসদার গল্পে আদিবাসী জীবনের তা এক বৈশিষ্ট্য। হাঁসদা তাঁর প্রথম বই, ‘দ্য মিস্টিরিয়াস এইলমেন্ট অব রুপি বাস্কে’ উপন্যাসে এক অদ্ভুত জগত এঁকেছেন। সেখানে রাতে ভূত দেখে কপালে চোখ ওঠে মানুষের, আবার ভূতও মার খেয়ে যায় মানুষের হাতে। ডেলা নামের এক সাহসিনী, কুহকিনী তরুণীর কথা লিখেছেন হাঁসদা, রাতে ঝোপের আড়ালে বসতে গিয়ে যে দেখে গাছের ডাল থেকে উল্টো বাগে ঝুলছে এক ভূত, দু’টো বড় বড় চোখ ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। দু’বার তাকে ওয়ার্নিং দেবার পর এমন চাঁটি কষাল ডেলা, ভূত চেঁচাতে চেঁচাতে পালাল। ভূতের চেঁচানি অবশ্য মানুষে শুনতে পায় না, কেবল পাখিরা পায়। তাই সেই রাতের বেলা গাছ ছেড়ে ঝটপটিয়ে বেরিয়ে সব পাখি পাক খেয়ে খেয়ে ডাকতে লাগল। তাতে ডেলার ভারী বয়ে গেল। সে ধীরেসুস্থে কাজ সেরে ফিরে এল বাড়িতে।

সাঁওতাল মেয়েদের অবমাননার অভিযোগ যাঁরা তুলছেন, তাঁরা কি এই নভেলটা পড়েছেন? এর নারী চরিত্রেরা দেহ-মনের শক্তিতে, যৌনতৃষ্ণার তীব্রতায় শুধু পুরুষের সমকক্ষ নয়, পুরুষদের ছাড়িয়ে যায়। তাদের বিচিত্র অন্তরলোক, অপূর্ণ আকাঙ্খার তাগিদ, সম্মোহন করার আর সম্মোহিত হওয়ার ক্ষমতা জাগতিক সংসারের মধ্যে এক অলৌকিক, আশ্চর্য দুনিয়াকে মিশিয়ে দিয়েছে। ভাবুন এই দৃশ্যটাই, চাঁদের আলো গায়ে মেখে চার উলঙ্গ রমণী নাচছে নদীর ধারে, তাদের মাথা কোনও অদৃশ্য, অশ্রুত বাজনার তালে তালে ঘুরছে ডাইনে বাঁয়ে, কখনও কখনও হেঁট হয়ে কী যেন কুড়িয়ে খাচ্ছে ঘাসের মধ্যে থেকে। তাদের এক জন গায়ের মোড়লের বউ। সে দৃশ্য দেখে দুই কামারের পো স্থাণুবৎ, শেষে দে দৌড়। বিজ্ঞানের সঙ্গে এই জাদু-জগতের যে চেনা সংঘাত, হাঁসদা নিজে ডাক্তার হয়েও সেই ‘কুসংস্কারমুক্তি’-র পরিচিত পথে হাঁটেননি। তিনি রুপি বাস্কের মতো আদিবাসী মেয়ের মনের ভিতর থেকে তার সুখ-অসুখের বোধকে ধরতে চেয়েছেন। আদিবাসী মেয়েদের প্রতি অশ্রদ্ধা থাকলে এমনটা কি কেউ করতে চায়? করতে পারে?

সাহিত্যগুণ যে রয়েছে হাঁসদার গল্পে, আর সাহিত্যিকদের যে খানিকটা স্বাধীনতা প্রাপ্য, তা ঝাড়খণ্ডের সরকারি কর্তারাও বোঝেন। তবু যে বইটা নিষিদ্ধ হয়ে গেল প্রকাশের পাক্কা দু’বছর পরে, তা অনেকটাই রাজনীতির ফের। আদিবাসীরা মূলত ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সমর্থক। বইটির বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ শুরু করতে স্বভাবতই বিজেপি সরকার বিষয়টিকে বিরোধীদের অস্ত্র করে তুলতে চায়নি। বিশেষত ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে আইন পাশ করেছে ঝাড়খণ্ড, তাতে খ্রিস্টান সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়েই আছে। একখানা বই নিষিদ্ধ করে তাদের যদি খানিক শান্ত করা যায়, ক্ষতি কী?

আবার হিন্দুত্ববাদীদেরও যে হাঁসদা চটিয়ে দিয়েছেন, তা-ও মালুম হয় তাঁর ‘দে ইট মিট!’ গল্পটা পড়লে। ওড়িশার দম্পতি বরোদায় গিয়ে দুঃখে আছে। গুজরাতিরা শুধু নিরামিষ খায় না তা-ই নয়, আমিষভোজীদের হীন মনে করে। যে অসহিষ্ণুতা থেকে গোধরার দাঙ্গা ঘটে, পানমণি সরেন তা বহু আগেই অনুভব করেছে নিজের জীবনে, যখন ডিমের খোলা তাকে গোপনে পুঁতে ফেলতে হয়েছে বাগানে। বাইরের ভ্যাটে ফেললে কেউ যদি দেখে ফেলে? নিরামিষের অনুজ্ঞাও যে এক রকম সন্ত্রাস, এ গল্পে তা বড় সুন্দর ফুটেছে। হাঁসদার বই নিষিদ্ধ হলে বিজেপি নেতারও লাভ বই ক্ষতি নেই।

এমনই হয়। আর কেউ ঝুঁকি নিতে চান না, তাই সত্যি কথা বলার পুরো ঝুঁকিটা চেপে যায় লেখক-শিল্পীর ঘাড়ে। তাঁদের গায়ে ‘নিষিদ্ধ’ ছাপ পড়ে, পালিয়ে বেড়াতে হয়, খোয়াতে হয় মূল্যবান সময়, হারিয়ে যায় জীবনের সম্পদ, সম্পর্ক। তাঁদের সে ক্ষতি তবু চোখে দেখা যায়। যা সহসা বোঝা যায় না তা হল, আমাদের মূর্খামি, কাপুরুষতা, সুযোগসন্ধানী মনোবৃত্তির কোন মূল্য চোকাতে হবে অনাগত সন্তানদের? সরকারের চিঠি পেয়েছেন হাঁসদা, সাসপেন্ড হয়েছে গোটা দেশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE