Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ঠিক যেন যৌথ পরিবারের বড়দা

পরের দিন স্টুডিয়োতে বেরনোর আগে উত্তমের বাড়িতে তাঁরই নির্দেশ মতো কালীকে নিয়ে হাজির পার্থপ্রতিমের সহকারী বিমল দে। তাঁদের দুজনকে নিয়ে স্টুডিয়ো যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে উত্তম কালীর হাতে হাজার পাঁচেক টাকার একটা খাম ধরিয়ে বললেন, ‘‘এটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখ।’’

মেজাজ: আড্ডাতেও যেন বড়দা। পাশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র

মেজাজ: আড্ডাতেও যেন বড়দা। পাশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০৭:৫০
Share: Save:

যদুবংশ’ ছবির শুটিং চলছে। সাতের দশকের গোড়ার দিক। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, পরিচালক, হেঁকে উঠেছেন, ‘‘অল লাইটস’’। পজিশন নিতে গিয়ে উত্তমকুমার খেয়াল করলেন, টপ থেকে কোনও একটা লাইট ঠিকমত তাঁর শরীরে এসে পড়েনি। তখন উপরে কাঠের পাটাতনে লাইটম্যানরা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন, নির্দেশ মতো সুইচ অফ-অন করতেন। সে দিন তেমনই এক জন, নাম তাঁর কালী, হাঁক শোনার পরও ভুলে গেলেন আলো জ্বালতে। শট অবশ্য হয়ে গেল, তবে হয়ে যাওয়ার পর কালীকে ডেকে পাঠালেন উত্তম। শুনে কালী কাঁপতে কাঁপতে উত্তমের মেক-আপ রুমে এলেন। এমনিতে তাঁর কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই বিড়ি চেয়ে খান উত্তম, কিন্তু কাজের ভুলের তো কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু উত্তম বকুনি না দিয়ে সস্নেহে তাঁকে বললেন, ‘‘কী হয়েছে রে কালী? অন্যমনস্ক ছিলিস মনে হল, এনি প্রবলেম?’’ হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন কালী, বলেন, ‘‘মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে দাদা, কিন্তু আমি কিছুতেই টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছি না। তাই... এমনটা আর হবে না।’’

পরের দিন স্টুডিয়োতে বেরনোর আগে উত্তমের বাড়িতে তাঁরই নির্দেশ মতো কালীকে নিয়ে হাজির পার্থপ্রতিমের সহকারী বিমল দে। তাঁদের দুজনকে নিয়ে স্টুডিয়ো যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে উত্তম কালীর হাতে হাজার পাঁচেক টাকার একটা খাম ধরিয়ে বললেন, ‘‘এটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখ।’’

এ ভাবে হরদম যাঁদের পাশে দাঁড়াতেন, তাঁরা কেউ আত্মীয় ছিলেন না উত্তমের। অথচ উত্তম প্রায়ই তাঁদের অভিভাবক হয়ে উঠতেন, প্রায় একান্নবর্তী পরিবারের স্নেহপরায়ণ দাদার মতো। কত মেয়ের যে বিয়ে দিয়েছেন, আজ আর সে কথা কে-ই বা মনে রাখে। মণি শ্রীমানির মতো অভিনেতার যাতে অসম্মান না হয়, সে জন্য তাঁর মেয়ের বিয়ের টাকা নিজে না দিয়ে ফাংশন করে তুলে দিয়েছিলেন উত্তম। রাসবিহারী সরকার বিনা ভাড়ায় ‘বিশ্বরূপা’ হলটি দিয়েছিলেন, গোটা অনুষ্ঠানটা আয়োজন করেছিলেন ভাই তরুণকুমার আর সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল আকর্ষণই ছিল উত্তমের গানের সঙ্গে অসিতবরনের তবলা। হইহই করে টিকিট বিক্রি হল আর মণি শ্রীমানির মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল।

বিপদে-আপদে সব সময় অন্যের পাশে দাঁড়াতেন, বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিতেন। কোনও শিল্পী অপমানিত হলে, কলাকুশলীদের কোনও অসুবিধে হলে, বিশেষত নীচের দিকে যাঁরা, তাঁদের হয়ে প্রতিবাদ করতেন।

আবার ভবানীপুরের বাড়িতে ধুমধাম করে লক্ষ্মীপুজোও করতেন সকলের সঙ্গে। সেখানেও তিনি বড়দাদা, প্রায় যেন অভিভাবক গোটা বাড়িটার। মায়ার বাঁধন প্রত্যেকের সঙ্গে। পরদার বাইরে তাঁর এই জীবনটা নিয়ে একটা বই লিখেছেন অশোক বসু, ‘পর্দার বাইরেও মহানায়ক’, তাতে উত্তমের জীবনের এ রকম অজস্র অনুষঙ্গ।

এগুলি ছাপ ফেলত তাঁর অভিনয়েও। অথচ আমরা সে সব খেয়ালও রাখি না। অভিনয় জীবনের শুরুতে ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২), যে ছবি করে উত্তমের প্রসিদ্ধি হল প্রথম, আর একেবারে শেষে ‘দুই পৃথিবী’ (১৯৮০)। এই দু’টি ছবিতেই তিনি পরিবারের বড় ভাই, একান্নবর্তী পরিবারের মাথা। উত্তমের বাবা ছিলেন একা রোজগেরে, সিনেমাহলের প্রজেকশন অপারেটর। ফলে যথেষ্ট স্ট্রাগল দেখেছেন উত্তম, উঠে এসেছেন একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত একটা বড় পরিবার থেকে। নিজের পারিবারিক জীবন আর অভিনয় জীবন যেখানে একাকার, সে সব ছবিতে অভিনেতা হিসেবে অসামান্য তিনি। স্টারডম, লার্জার দ্যান লাইফ বা রোম্যান্টিক ম্যানারিজম-এর খাঁচাটাঁচা সব ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। পরিবার থেকে সমাজ, সর্বত্রই যেন দায়িত্ববান এক অভিভাবক, জাগ্রত বিবেকের মতো। দুই ভাই, থানা থেকে আসছি, চৌরঙ্গী, নিশিপদ্ম, এখানে পিঞ্জর, যদি জানতেম, যদুবংশ, অগ্নীশ্বর, নগর দর্পণে... এ রকম আরও কত ছবি।

আড্ডায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই উত্তমকুমারকে নিয়ে স্মৃতিতে ফিরে যান... তখন শিল্পী সংসদ আর অভিনেতৃ সংঘের ঝগড়াঝাঁটি বাক্‌যুদ্ধ চলছে, প্রথমটিতে উত্তম আর পরেরটিতে সৌমিত্র। বসুশ্রী সিনেমায় পয়লা বৈশাখ, সৌমিত্র গিয়ে দেখেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে আছেন উত্তম। ওঁরা দু’জন তখন দুই যুযুধান শিবিরে। বাকিটা সৌমিত্রের মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘‘আমি গিয়ে ভানুদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আর যেহেতু দুই শিবিরে আমরা বিভক্ত, তাই উত্তমদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম না করে, হাতটা ধরে ‘শুভ নববর্ষ’ বললাম। বলামাত্র উত্তমদার মুখটা লাল হয়ে গেল। রাগে দুঃখে। এবং এই হচ্ছে লোকটার মহত্ত্ব। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড় ভাই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারিস না!’ আমার পরম সৌভাগ্য যে, এই মুহূর্তে আমি যে অন্যায় করেছি, সেই চেতনাটা হল।’’ সে দিন ক্ষমা চেয়ে নিয়ে যখন উত্তমকে প্রণাম করলেন সৌমিত্র, তখন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন উত্তম।

এই কথাগুলো হয়তো আজ অনেকেরই জানা, তবে মুশকিল হল এটা থেকে আমরা কখনও উত্তমের অভিনয় জীবনের বিচার করতে শিখিনি, যেটা ভারী চমৎকার শিখিয়েছেন সৌমিত্র। বলছেন, ‘‘একটা বিশেষ ধরনের চরিত্রে আমি ওঁর কোনও জুড়ি পাই না। সেটা হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারের বড় ভাই। যেটা ওঁর নিজের মধ্যেও ছিল এবং সে রকম একটা পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন। অসাধারণ অভিনয়, এই জিনিসগুলো বোধহয় ওঁর মতো ভাল আর কেউ করতে পারে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE