Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ইম্ফলে ওবামা

তিনি হোসেন ওনিয়াঙ্গো ওবামা। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঠাকুরদা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে মণিপুরে জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছিলেন তিনি। রাহুল রায়তিনি হোসেন ওনিয়াঙ্গো ওবামা। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঠাকুরদা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে মণিপুরে জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছিলেন তিনি। রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৭ ১২:৪০
Share: Save:

নিতান্তই সাদামাটা একটা লেফাফা। আর পাঁচটা আর্জি-আর্তি ভরা খাম, সাত সকালে পিএমও-র সচিবালয়ে যেমন লুটোপুটি খায়, তেমনই। পাহাড় থেকে উড়ে আসা ধূসর সেই খামে লুকিয়ে ছিল এক টুকরো অনুরোধ, ‘একটু সময় করে, ইম্ফলের ছায়াচ্ছন্ন কবরটা এক বার ঘুরে যেতে বলুন না ওঁকে!’

বছর দুই আগে, সাকুল্যে দেড় দিনের সফরে দিল্লি আসছেন বারাক হুসেন ওবামা। ঠাসা অনুষ্ঠানসূচি। তার মাঝে ফাঁক খুঁজে মণিপুরের পাহাড়ে যাওয়া যায়? হোয়াইট হাউসের এগজিকিউটিভ অফিস অব প্রেসিডেন্ট (ইওপি) মুচকি হেসে জানিয়েছিলেন, ‘সরি, এ বার হবে না, ব্রাদার।’ তিনি কি জানতেন, ওই পাহাড়ি খামের গভীর আর্তির আড়ালে কে লুকিয়ে আছেন!

লেফাফার সেই আর্তিটা ওবামার কানে গিয়েছিল ঠিকই, তবে সফরের শেষ প্রহরে। শোনা গিয়েছিল, একটি কথা বলেননি তিনি। রাইসিনা হিল্‌স-এর ছড়ানো লনে বসে, এক বার কি মনে হয়েছিল তাঁর, ‘গেলে হত না, কবরগুলোর পাশে দু’দণ্ড দাঁড়ানো যেত না এক বার!’ ‘ব্যাটল অব ইম্ফল’-এর বেয়নেট তো তাঁর দাদুর কাঁধেও ছিল এক সময়ে!

বর্মা সীমান্তের স্যাঁতসেঁতে বন-পাহাড় পেরিয়ে মণিপুরের সেই গহন চড়াই-উতরাই ভেঙে ওবামা এসেছিলেন কাঁধে বন্দুকের ভার নিয়েই। তিনি ওবামা, তবে বারাক হুসেন নন, হোসেন ওনিয়াঙ্গো ওবামা। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পিতামহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গনগনে সময়ে ব্রিটেনের ‘কিংস আফ্রিকান রাইফেলস’-এর হয়ে মণিপুরের ওই পাহাড়ি পথেই এ দেশে এসেছিলেন তিনি।

তথ্যটা খুঁড়ে তুলেছিলেন টিমোথি এইচ পার্সনস। পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আফ্রিকান ইতিহাস’ বিভাগের ওই গবেষক, ওবামা পরিবারের ভারত-যোগের তথ্য পেয়েই চিঠি পাঠিয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে। এক হপ্তার মধ্যেই শ্বেত প্রাসাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওবামা পরিবার সে তথ্যকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ওনিয়াঙ্গোর বাধ্যতামূলক যোগদানের কথা বারাক ওবামার অজানা ছিল না। কিন্তু সেই সুবাদে তাঁর দাদুকে যে ভারত-মায়ানমার সীমান্তের প্রান্তিক এক পাহাড়ি গ্রামেও পাড়ি দিতে হয়েছিল, এমন চমকে দেওয়ার মতো তথ্য তাঁরও জানা ছিল না এত দিন। সে বার দিল্লি ছেড়ে যাওয়ার আগে, সে জন্যই কি বারাক জানতে চেয়েছিলেন, ‘হাউ ফার ইজ ইম্ফল?’

সাত দশক আগে মণিপুরের প্রায় নিঝুম এক গণ্ডগ্রামে সেই ‘প্রথম ওবামা’র পা পড়েছিল ‘গড সেভ দ্য কিং’-এর তালে পা ঠুকে, পুরোদস্তুর সেনা অনুশাসনের মোড়কে। সে দিন মণিপুরের মোরে জেলার পটসাংবাম এলাকায়, রডোডেনড্রনের জঙ্গল সাফ করে তাঁবু পড়েছিল সার দিয়ে। কোনও রাজকীয় আতিথেয়তা নয়, টিমোথি জানিয়েছেন, জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও মেলেনি। লটবহর নামিয়েই ব্রিটিশ সেনাপতির জলপাই রঙের তাঁবুর পাশে তড়িঘড়ি চুল্লি ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড় করতে হয়েছিল ওনিয়াঙ্গো ওবামাকে। আর, রান্নাবান্না সেরে তাঁর ঠিকানা নির্দিষ্ট হয়েছিল পাহাড়ি পাকদণ্ডীতে। তার পর, ট্রেঞ্চের সংকীর্ণ আলো-ছায়াতেই এক-দুটো দিন নয়, প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস যুদ্ধ-অনুশাসনে কেটেছিল ওনিয়াঙ্গোর।

ওবামা পরিবারের আদি ভূমি কেনিয়া। প্রথম কৃষ্ণবর্ণ মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক শেকড়-বাকড়ের খোঁজে টিমোথি পাড়ি দিয়েছিলেন সেই আফ্রিকান মুলুকেও। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওবামা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে ওনিয়াঙ্গোর সেনা-জীবনের বিবিধ গল্প রয়ে গিয়েছে আজও। মুখে-মুখে চলে আসা পারিবারিক স্মৃতিচারণের সেই সব টুকরো গল্প কুড়িয়ে নেওয়ার ফাঁকে ইম্ফল আর কেনিয়া জুড়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুতোয়।

টিমোথি নিজেও বলছেন, ‘সেই সব স্মৃতি কুড়িয়ে বেড়ানোর ফাঁকে এমন এক চমকে দেওয়া তথ্য যে সামনে এসে পড়বে, ভাবতেও পারিনি।’ তাঁর ‘রেস, রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য বয়-স্কাউট মুভমেন্ট অব কলোনিয়াল আফ্রিকা’ বইয়ে ওনিয়াঙ্গোর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরের বর্ণনা রয়েছে। টিমোথি বলেন, ‘কেনিয়া, আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তিন মহাদেশের মধ্যে নিঃশব্দে একটা মেলবন্ধন গড়ে দিয়েছে যেন ওবামা পরিবার।’

তাঁর গবেষণার সূত্র ধরে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় পিটার বেকার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘ওবামা পরিবারের এশীয়-অভিজ্ঞতা নতুন নয়, কারণ, মনে রাখতে হবে, ওনিয়াঙ্গোর মতো তাঁর নাতির (বারাক ওবামা) বেড়ে-ওঠা বয়সটাও কেটেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায়।’ সে গল্প ভিন্ন, আমরা বরং ফিরে আসি ওনিয়াঙ্গোর ‘ব্যাটল অব ইম্ফল’-এ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলহলে কালো ধোঁয়াপ আড়ালে একের পর এক ব্রিটিশ কলোনিতে যখন জাপানি সেনার পা পড়ছে, ‘ব্যাটল অব ইম্ফল’-এর সময়কালটা সেই ১৯৪৪। ব্রিটিশ অধিকৃত বর্মা (এখনকার মায়ানমার) আক্রমণ করেছিল জাপান। হারানো জমি ফিরে পেতে মিত্রশক্তির বর্মা পুনর্দখলে তলব হয়েছিল ‘কিংস আফ্রিকান রাইফেলস’-এর। জুলাইয়ের এক দুপুরে ১১ ইস্ট-আফ্রিকান ডিভিশন ভারত-বর্মা সীমান্তে এসে পৌঁছয়। টিমোথি মনে করছেন, সেই বাহিনীর ক্যাপ্টেনের রাঁধুনি হয়ে ভারতে এসেছিলেন ওনিয়াঙ্গো। তবে, সাহেবদের রেঁধে-বেড়ে খাওয়ানোর সঙ্গে গুলি-বারুদের ব্যবহারটাও তাঁকে জানতে হয়েছিল।

১৯৪৪-এর মার্চে মায়ানমারের উপত্যকা থেকে পাহাড়ি পথ ধরে উঠে এসেছিল জাপানি সেনা। তবে, থেকে-থেকেই বৃষ্টি, ভিজে স্যাঁতসেঁতে বন-জঙ্গল আর অগুনতি জোঁকের অনর্গল দাপটে জাপানিরা তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। ধিকিধিকি যুদ্ধ অবশ্য চলছিল।

জন লাটিমার তাঁর ‘বার্মা: দ্য ফরগটেন ওয়ার’ বইয়ে লিখছেন, যুদ্ধটা ক্রমেই প্রলম্বিত হচ্ছে দেখে মিত্রশক্তি ব্যাটল অব ইম্ফলে ইতি টানতে চাইছিল দ্রুত। বর্ষা ঝাঁপিয়ে পড়ায় জাপানিরাও ক্রমেই পিছু হটছিল। রসদও ফুরিয়ে আসছিল তাদের। পিছু-হটা জাপানিদের বাগে পেতে ভরা-বর্ষায়, জুলাইয়ের গোড়ায় তলব হয়েছিল কিংস আফ্রিকান রাইফেলস-এর।

তবে অচেনা সেই পাহাড়ে আফ্রিকান রাইফেলস-ও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। হোক না কেনিয়া-নাইজেরিয়ার তরতাজা ছেলেপুলে, কিন্তু তাদের জারিজুরি তো আফ্রিকার সাভানায়!

এ দিকে বর্ষা প্রায় দুয়ারে। বর্মা সীমান্তের অনর্গল বৃষ্টি-ধোয়া পাহাড়ে হাঁচি-কাশি-হাঁপানিতে কাবু হয়ে পড়েছিল অনেকেই। মাসের পর মাস ট্রেঞ্চ-জীবনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ওনিয়াঙ্গোও। নড়বড়ে দু’পক্ষের পাহাড়ি লড়াইয়ে শুধুই দীর্ঘ হচ্ছিল মৃত্যু-মিছিল। শেষ তক, ১৯৪৫-এর গোড়ায়, জাপানি সেনা মণিপুর ছেড়ে যাওয়ার পরে, কিংস আফ্রিকান রাইফেলসও তাঁবু গুটিয়েছিল। টিমোথি মনে করছেন, মণিপুর থেকে ১১ ইস্ট-আফ্রিকান ডিভিশনের ঠিকানা বদলে গিয়েছিল সিংহলে (এখনকার শ্রীলঙ্কা)। ফুরিয়েছিল ওনিয়াঙ্গো ওবামার ভারত সফর।

যুদ্ধ-ফেরত ওনিয়াঙ্গোর জীবন অবশ্য বাঁক নিয়েছিল অন্য দিকে।

ব্রিটিশ পরাধীনতা থেকে মুক্তির খোঁজে সে সময়ে উত্তাল কেনিয়া। ‘কিকুয়ু সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতৃত্বে দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে মাউ মাউ বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সেনার খবর গোপনে বিদ্রোহীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগে যুদ্ধ-ফেরত ওনিয়াঙ্গো গ্রেফতার হলেন ১৯৪৯ সালে। সেই সময়ে, দু’বছর কারাবাসের ‘অসহনীয় অভিজ্ঞতা’র কথা টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক বেন ম্যাকিনটায়ার এবং পল ওরেঙ্গোকে এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি জানিয়েছেন ওনিয়াঙ্গোর তৃতীয় স্ত্রী সারা ওবামা। বলেছেন, ‘মাউ মাউ বিদ্রোহের গোপন খবর জানতে ওনিয়াঙ্গোর উপরে যে কী সাংঘাতিক অত্যাচার হয়েছিল, বলতে গিয়েও শিউরে উঠছি!’ টিমোথির সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সারা জানিয়েছিলেন, নখ উপড়ে, সারা গায়ে অনর্গল সূঁচ ফুটিয়ে সে এক অবিরাম অত্যাচার। অত্যাচার হয়েছিল গোপনাঙ্গেও। স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল ওনিয়াঙ্গোর। ১৯৭৯ সালে, মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ন্যুব্জ ওনিয়াঙ্গো আর সেরে ওঠেননি।

তাঁর নাতি, বারাক অবশ্য সে সব স্মৃতি উসকে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং তাঁর ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’ বইয়ে ছোট্ট মন্তব্যটা অনেক ডিপ্লোম্যাটিক, ‘দাদু নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় ছ’মাসের মধ্যেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।’

তবে, মারা যাওয়ার আগে, তাঁর যুদ্ধ-জীবনের আর পাঁচটা বারুদগন্ধী বিকেলের সঙ্গে ‘ব্যাটল অব ইম্ফল’-এর কথাও নাকি মাঝে মাঝেই বিড় বিড় করতেন ওনিয়াঙ্গো। বারাক ওবামার ‘সারা গ্র্যানি’ টিমোথিকে সে গল্পও শুনিয়েছিলেন।

সেই মেঘ, সেই পাহাড়, রডোডেনড্রনের বনে বারুদের গন্ধ, হয়তো এ সবও ফিরে ফিরে আসত বৃদ্ধ ওনিয়াঙ্গোর স্মৃতিতে। হয়ত ফিরে আসত সেই সব মুখ, জাপানি বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাঁরা রয়ে গিয়েছেন ইম্ফলের পাহাড়ি কবরে।

কিন্তু সেই সুদূর স্মৃতিতে কখনও কি স্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল, সেনাবাহিনীর রাঁধুনি হয়ে যে দেশে এক দিন পা পড়েছিল তাঁর, সেই দেশের রাজধানীতে এক দিন ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’-এর ছায়া ফেলে নেমে আসবেন তাঁর নাতি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE