Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

অপরাধের রামাল্লা

সাহিত্যের দুনিয়ায় গত কিছু দিন ধরেই প্রবল ঝড় প্যালেস্তাইনের রামাল্লা শহর নিয়ে। তরুণ লেখক ইয়াহিয়া আবাদ-এর নতুন উপন্যাস নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। ফেসবুকে চলছে অকথ্য গালি, হুমকি। এই বিশ্বে অসহিষ্ণুতায় কেউই কম নয়! সাহিত্যের দুনিয়ায় গত কিছু দিন ধরেই প্রবল ঝড় প্যালেস্তাইনের রামাল্লা শহর নিয়ে। তরুণ লেখক ইয়াহিয়া আবাদ-এর নতুন উপন্যাস নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। ফেসবুকে চলছে অকথ্য গালি, হুমকি। এই বিশ্বে অসহিষ্ণুতায় কেউই কম নয়!

দ্বন্দ্ব: জ্বলছে শহর, ইজরায়েলি সেনার দিকে পাথর ছুড়ছে রামাল্লার তরুণ। ছবি: গেটি ইমেজেস।

দ্বন্দ্ব: জ্বলছে শহর, ইজরায়েলি সেনার দিকে পাথর ছুড়ছে রামাল্লার তরুণ। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

খুব খেপেছে ভীতি-পুলিশ আর নীতি-পুলিশ, দুই-ই। নিজের শহরেই এখন প্রাণসংশয়। ফেসবুক-দেওয়ালে অকথ্য, অশ্রাব্য খিস্তিখেউড়। রাস্তায় পেলে সবাই মিলে পিটিয়ে মারব, হুমকি। যে হাত দিয়ে এই লেখা বেরোয়, কেটে নেব সেই হাত। শহরের যে বই-দোকান আর লাইব্রেরিই তোর বই রাখবে, জ্বালিয়ে দেব আগুনে। স্তম্ভিত লেখক দেখছেন, তাঁর চেনা শহর রামাল্লা বদলে যাচ্ছে।

ইয়াহিয়া আবাদ গিয়েছিলেন কাতারে। সেখানেই খবর পেলেন, জন্মভূমি প্যালেস্তাইন তাঁর নতুন উপন্যাস নিয়ে রাগে জ্বলছে। আবাদের চতুর্থ উপন্যাস ‘ক্রাইম ইন রামাল্লা।’ প্রশাসনের বক্তব্য, আরবি ভাষায় লেখা এই উপন্যাস অনৈতিক, অশ্লীল কথায় ভর্তি। অতএব, নিষিদ্ধ হল এই বই।

রামাল্লা শহর তো বটেই, পুরো ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়েই সব বুকস্টোর্স থেকে উপন্যাসের কপি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। সরকারি ঢ্যাঁড়া কানে যেতে পথে নেমেছে ঝামেলাবাজরাও। দোকান থেকে বই তুলে, ছিঁড়ে কুটিকুটি, জ্বালিয়ে বনফায়ার। ভাগ্য ভাল, লেখক দেশে ছিলেন না। নইলে কী যে হত, ভাবতে শিউরে উঠছেন ইয়াহিয়া নিজে।

অথচ শিক্ষা, সংস্কৃতিতে এই রামাল্লা শহরের অন্য এক ঐতিহ্য আছে। জেরুজালেম থেকে মাত্র দশ কিমি দূরের এই জায়গাটা প্যালেস্তাইনের অন্যতম বাণিজ্যনগরী। একুশ শতকে ক্রমশ সেখানে বাড়ছে ব্যবসায়িক পরিকাঠামো। ভারত, জাপান, জার্মানি, আর্জেন্টিনা— বহু দেশের দূতাবাস এই শহরেই। এক দিকে কনস্ট্রাকশন বুম, অন্য দিকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও তুমুল বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে রামাল্লা। কয়েক বছর আগে ডাকসাইটে মার্কিন সংবাদপত্রগুলি একে ‘প্যালেস্তাইনের প্রকৃত রাজধানী’ নামে অভিহিতও করেছিল।

ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র-হামলার ভয়ঙ্কর দিনগুলিতেও লেখক, শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করেনি এই শহর। প্যালেস্তাইনের গাজা স্ট্রিপ বা অন্যান্য জায়গা থেকে জেরুজালেম যেতে বিশেষ অনুমতিপত্র লাগে, রামাল্লায় লাগত না। ইজরায়েল মূল রাস্তাকে এড়িয়ে জেরুজালেমের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের একাধিক বাইপাস তৈরি করেছিল, জমি নেওয়া হয়েছিল রামাল্লার অধিবাসীদের দিকে। জমি চলে গেল, চাকরির সুযোগও প্যালেস্তাইনে তখন বিশেষ নেই। ২০০০ সাল থেকেই তাই রামাল্লার অধিবাসীরা ‘শুধুমাত্র ইজরায়েলিদের জন্য’ লেখা বাইপাসগুলিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায়। এক দুপুরে ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান ছেয়ে দিল রামাল্লার আকাশ। শহরে রোজ কারফিউ, সেখানকার টিভি স্টেশন ইজরায়েলি সেনার দখলে।

ইয়াহিয়া আবাদ

তবু রামাল্লা শহরকে হতমান করা গেল না। প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) একচ্ছত্র নেতা ইয়াসের আরাফাত তখন সপরিবারে গাজা স্ট্রিপে থাকেন, তিনি অফিস খুললেন এই রামাল্লা শহরে। আজও তাঁর সমাধিসৌধ এই শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য। ২০০৫ সালে রামাল্লা আর একটা ব্যাপারে রেকর্ড গড়েছিল। এখানকার মেয়ে-স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের জ্যানেট মিখাইল ভোটে জিতে শহরের মেয়র হয়েছিলেন। রামাল্লা মানে শুধু ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ নয়।

এই শহরের আপাত-অদৃশ্য ভারী পাথরটাকেই সাহিত্যে তুলে আনতে চেয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সি লেখক ইয়াহিয়া আবাদ। এরই মধ্যে বেরিয়ে গিয়েছে তাঁর চার-চারটি বই। নিষিদ্ধ উপন্যাস ‘ক্রাইম ইন রামাল্লা’ এই শহরের তিন তরুণ রউফ, নুর আর উইসাম-এর গল্প। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের রক্তঝরা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ওদের জীবন। ২০০০ সালে এরা তিন জনই নেহাত শিশু। বড় হয়ে উঠতে উঠতে দেখেছে, দুই দেশের যুদ্ধে না চাইতেই, অজান্তেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে তারা, আপাত-স্বাধীনতার মধ্যেই কাটাতে হচ্ছে নির্বাসিত জীবন। এখানে মুখে জাতীয়তাবাদ আর স্বাধীনতার বুলি কপচায় সবাই, কিন্তু বাঁচার পরিবেশটা দমবন্ধ। মানুষজন বাইরে দেখায় যেন কত না উদার প্রগতিপন্থী, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই রক্ষণশীলতার ঢিপি।

গ্রাম থেকে রামাল্লার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রউফের দেখা হয় একটি মেয়ের সঙ্গে। দেখা হয়, কথা হয় না। ভাল লাগে, বলা হয় না। রউফ তার নামটাও জানে না, মনে মনে মেয়েটির নাম দেয় ‘দুনিয়া’। ভালবাসাহীন এই শহরে ও-ই তার স্বপ্নের দুনিয়া! নুর নামের তরুণটি শহরে এসেছে জীবন বদলাতে। সে সমকামী, ভালবাসার পুরুষটির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে সদ্য, ভগ্নহৃদয় তাই। ‘অন্য রকম’ যৌনতাও এখানে বদ রগড় আর অত্যাচারের ইন্ধন। উইসাম নামের সদ্য-যুবাটির বরং ধোপদুরস্ত চাকরি, পয়সাওলা নিশ্চিন্ত জীবন ছিল। তারও মেয়েবন্ধুটি ঘটনাচক্রে খুন হয়ে যায়, জীবনটা হয়ে যায় তছনছ। প্রেমহীন এক শহরে পাথুরে বেঁচে-থাকার বোঝা টেনে চলে তিন তরুণ। তিন, নাকি তেত্রিশ? নাকি তিনশো তেত্রিশ? সংখ্যা তো নেহাত প্রতীকী। ইয়াহিয়ার উপন্যাস এঁকে চলে এই সময়কার তরুণ প্যালেস্তিনীয়দের হতাশাচিত্র।

তা হলে বই নিয়ে এত তোলপাড় কেন? সমস্যাটা অন্যত্র। ইয়াহিয়া আবাদ তাঁর উপন্যাসে করুণ বেহালা বাজাননি। দেখো আমার শহরটা এই রকম বাজে, আমার সরকার ওই করতে দিচ্ছে না, কাঁদুনি গাননি। বরং রোজকার দমবন্ধ ক্লস্ট্রোফোবিয়াটাকেই তুলে এনেছেন উপন্যাসের প্লটে। পাতায় পাতায় একটা গোটা প্রজন্মের চাপা রাগ। সেই রাগ ফুটে বেরিয়েছে ব্যঙ্গ-উপমায়, ইমেজে। রামাল্লার রাস্তায় নুর দেখে ইয়াসের আরাফাতের ছবি, পোস্টারে তাঁর হাতে বিরাট মেশিনগান। নুরের মনে হয়, মহান জননেতার হাতে ওটা উদ্ধত আগ্নেয়াস্ত্র নয়, উদ্যত পুরুষাঙ্গ! এক সমকামী তরুণের অন্তরদাহ এ ভাবেই প্রতিরোধ গড়ে গণ-আইকনের হিস্টিরিয়ার সামনে।

চরিত্রের অতীতচারণায় বেরিয়ে পড়ে রাজনীতির সঙ্গে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মানুষের বসতি আর বেসাতি, দুই-ই। নুরের পরিবার প্যালেস্তাইনের উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘হামাস’-এর সমর্থক। তাদের দোকান থেকে হামাস-এর লোকেরা কিনে নিয়ে যায় দরকারি জিনিস, মোটা লাভ থাকে নুরের বাবার। তিনি সেই লাভের মাছ ঢাকেন চ্যারিটির শাক দিয়ে। সব পক্ষকেই খুশি রাখেন, হাওয়া বুঝে মাথা তোলেন, বা নামান। তাই পরিবারের কেউ কখনও বিপদে পড়ে না, গ্রেফতার হয় না। বউদি রীতিমত অ্যাক্টিভিস্ট, হামাস-এর কোনও পুরুষ শহিদ হলে তার বিধবা বউটির ফের কোনও ‘হামাস ভাই’-এর সঙ্গে বিয়ে দেওয়াই তার জীবনব্রত। উঠতি দেওরটির জন্যও সে কনে খোঁজে, এক-একটি সম্ভাব্য কনেকে শাশুড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, ‘মেয়েটা একেবারে মাথার চুল থেকে পায়ের বুড়ো আঙুল অব্দি, কী বলে... কুমারী।’ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নূর টিভি চালায় আর যুদ্ধ-রক্ত-খুন-বোমাবাজির নিউজ চ্যানেলগুলো পেরিয়ে মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে সেই সব চ্যানেল, যেখানে সিনেমা আর মিউজিক ভিডিয়ো চলে, হোক না মিউট মোডে!

এই সব ‘অন্য রকম’ কিছুতেই বোধহয় বিষ খুঁজে পেয়েছে প্রশাসন। ইয়াহিয়াকে বলা হয়েছে, তোমার কলমে যৌনতা, স্বমেহন, অপ্রিয় রাজনৈতিক মতামত। তাই বই নিষিদ্ধ। প্যালেস্তিনীয় লেখক সঙ্ঘের প্রধানও তেড়ে সমালোচনা করেছেন, হামাস ধুয়ে দিয়েছে নিন্দায়। রামাল্লার বুক ক্লাবের সদস্যরা ইয়াহিয়ার বই নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করেছিলেন, খুনের হুমকি পেয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। বই হাতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে না। বইটা যেন ড্রাগ, লুকিয়ে রাখতে হবে ব্যাগের গভীরে, গোপন পকেটে।

অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এমনকী, স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্তাইন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে গঠিত যে প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, তার সংস্কৃতি বিভাগের প্রধানও জানিয়েছেন, এই বই নিষিদ্ধ করা মানে অনন্ত বাধানিষেধের দরজা খুলে দেওয়া। জার্মানির ‘পেন’ সেন্টার ইয়াহিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের ‘রাইটার্স ইন এক্সাইল’ প্রোগ্রামে।

তবু ইয়াহিয়ার মনখারাপ। বুঝতে পারছেন না, তাঁর অ্যাদ্দিনের চেনা শহরটা কেন এমন অচেনা হয়ে উঠল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE