এই কালি আসলে কার মুখে পড়ল? ছবি: পিটিআই।
দার্শনিক সক্রেটিস হেমলক বিষ পান করার আগে বলেছিলেন, আমি চললাম মৃত্যুর দিকে। আপনারা চলুন জীবনের পথে।
প্রশ্ন থেকে গিয়েছে, সক্রেটিস কি মৃত্যুর পথেই হেঁটেছিলেন? না কি যাঁরা তাঁর মৃত্যুদণ্ড দিতে তৎপর ছিলেন, তাঁরাই আসলে জীবন থেকে বিচ্যুত ছিলেন?
সক্রেটিসকে যখন জেরা করা হচ্ছিল, তখন মিলেটাস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন, সক্রেটিস যুবকদের বিপথগামী করছেন। প্লেটো তাঁর ‘অ্যাপোলজি’ গ্রন্থে মিলেটাসের সঙ্গে সক্রেটিসের কথোপকথনের যে নমুনা দিয়েছেন, তাতে আছে, মিলেটাস বলছেন যুবকদের সঠিক পথ চালাতে পারে আইন। সক্রেটিস জিজ্ঞাসা করছেন, আইন ব্যবহারকারী মানুষটি কে? মিলেটাস বলছেন, উপস্থিত শ্রদ্ধেয় জুরিরা। যুবকদের পথনির্দেশক সিনেটের সভ্যরা। বিধান পরিষদের সকল সভ্য।
তখন সক্রেটিস বলেন, মিলেটাস, তোমার কথা অনুসারে আমিই যুবকদের অকল্যাণ করি। আর এথেন্সের সকলে উন্নতির পক্ষে। মিলেটাস: এই কথাটিই তো আমি বলিষ্ঠ ভাবে উচ্চারণ করতে চাই। তখন সক্রেটিস বলেন, তা হলে যুবকদের মহাভাগ্য যে তাঁদের অপকার করার লোক আমি একা। আর সমাজের সকলেই তাঁদের উপকার করতে চাইছেন। তা হলে আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কীসের?
আজ থেকে কত কত বছর আগে সক্রেটিস এসেছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের ৪৭০ বছর আগে। আর আজও প্রতিটি সমাজের কোণে কোণে পরমত সহিষ্ণুতার অভাব এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। ভারতের রাজনীতিতে, তা সে গরু-জাতীয়তবাদ হোক বা খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি-র বইয়ের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপনই হোক। টেলিভিশন চ্যানেল খুললেই চার দিকে এই অসহিষ্ণুতার ছবি দেখা যায়।
শুধু এ বার এই মেরুকরণের রাজনীতিতে একটা নতুন মাত্রা দেখতে পাচ্ছি। সেটা হল, এই চলতি ঘটনাবলী, যেগুলি নিয়ে ভারতের তামাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিদ্বদসমাজ মুখর, সেগুলি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অথবা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তথা বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু কোনও ভাবেই ক্ষমাপ্রার্থী নন। অরুণ জেটলি বিদেশে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের দাদরি-কাণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, এই ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু তিনি এক বারও বলেননি, এই ঘটনার জন্য শাসক দল ক্ষমাপ্রার্থী। অথবা, সরকার এ ব্যাপারে বিরোধ মেটাতে তৎপর।
অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিজেপি ছ’বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছিল। তখনও কিন্তু বিজেপি একক ভাবে ক্ষমতায় আসেনি। তখনও বাজপেয়ীকে আপস করতে হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস অথবা ডিএমকে-র মতো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলের সঙ্গে। ’৭৭ সালে যখন মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখনও জনসঙ্ঘ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাদের মতাদর্শকে ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়নি। কারণ, তখন বামের সমর্থনে জনতা দলের সেই সরকার তৈরি হয়েছিল। এ বার নরেন্দ্র মোদী ভারতের রাজনীতিতে প্রথম ২৮২ আসন নিয়ে বিজেপি-কে একক ভাবে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন।
আর সেই কারণে বিজেপি মনে করছে, এত দিন ধরে বহুত্ববাদের যে নেহরুবাদ মডেলকে আদর্শ বলে চালানো হয়েছে, এমনকী, বাজপেয়ীর চিন্তাভাবনাকেও নেহরুর ভাবনার অনুসারী বলা হয়েছে, এই মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্বকে এ বারে অচল করার সুযোগ এসেছে। মোদীর পিছনে আছেন মোহন ভাগবত তথা সঙ্ঘ পরিবার। তাঁরা বলছেন, মুসলিম তোষণ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। খ্রিস্টান তোষণ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। বহুত্ববাদ মানে হিন্দু জনসমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ সত্ত্বাকেও প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া। শুধুমাত্র কাটাসরাজ মন্দির কতিপয় হিন্দু তীর্থযাত্রীর জন্য খুলে দিয়ে সাঙ্কেতিক ভাবে উদারতা দেখানো যেমন আসলে পাকিস্তানের অনুভব নয়, সে ভাবে ভারতেও প্রকৃত অর্থে হিন্দু মনোভাবকে বলিষ্ঠ স্বীকৃতি দিতে হবে।
সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে প্রায় ২১ জন লেখক ইস্তফা দিয়েছেন কালবার্গির মৃত্যুর প্রতিবাদে। কিন্তু দিল্লিতে এত বছর থেকে এটাও আমার কাছে জলের মতো স্পষ্ট, এই লেখক গোষ্ঠী বরাবরই কট্টর বিজেপি বিরোধী বলেই পরিচিত। এক জন-দু’জন ব্যতিক্রম থাকতে পারেন। কিন্তু মূলত এই লেখকরাই একদা কংগ্রেস যুগে রাজসভার কুশীলব ছিলেন। অর্জুন সিংহ যখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তিনি বিজেপি-র মোকাবিলায় সহমত নামক নাট্যগোষ্ঠী এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়েছিলেন। সহমত তো অযোধ্যায় গিয়ে রীতিমতো বিজেপি বিরোধী প্রচার শুরু করেছিল। এবং সীতা রামের বোন ছিলেন, এই পোস্টার লাগিয়ে রীতিমতো বিবাদ তৈরি করেছিল। নেহরু গবেষণা কেন্দ্রের প্রধানের পদ থেকে মহেশ রঙ্গরাজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মনমোহন সিংহের জমানায় এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কংগ্রেসের প্রিয়পাত্র ও বিজেপি বিরোধী বলে পরিচিত। তা হলে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় কিছু সাহিত্যিককে নানা পদে অভিষিক্ত করে। বিজেপি তাঁদেরকে সরিয়ে নিজেদের লোককে বসাতে সচেষ্ট। ক্ষমতাচ্যুত সাহিত্যিকরা চেয়ার ছাড়তে নারাজ। কিন্তু ছাড়ার যখন নির্দেশ আসছে, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তোপ দেগে নিজেদের বিদায়টিকে মহিমামণ্ডিত করতে আগ্রহী।
আমি এই দুই পক্ষেরই রাজনৈতিক আনুগত্য প্রার্থী বিদ্বৎসমাজের আচরণের বিপক্ষে। আর যাই হোক, এঁদের আমি সক্রেটিস অথবা দস্তেভস্কি অথবা ডোরিয়ার গ্রে-র অস্কার ওয়াইল্ডের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নই। বিজেপি-র সমস্যা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বৎসমাজে রোমিলা থাপার থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন পর্যন্ত অনেকেই আছেন, কিন্তু বিজেপি-র মতাদর্শকে সমর্থনকারী বিদ্বৎসমাজে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের যথেষ্ঠ অভাব। উল্টে মুসলিম দুনিয়ায় পরিত্যক্ত সলমন রুশদির মতো লেখকও সাহিত্য অ্যাকাডেমির মতো বিষয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন। ফলে ভারতীয় ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’দের সমাজ এখন দ্বিধাবিভক্ত। এক দিকে সঙ্ঘ পরিবারের তাত্ত্বিকেরা, অন্য দিকে বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিদ্বৎসমাজ। সদ্য প্রকাশিত সঙ্কলন গ্রন্থে রোমিলা থাপার বলেছেন, হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও কেন দেশের নানা প্রান্তে হিংসার পথে যাচ্ছেন, সেটি তিনি বুঝতে পারছেন না। আসলে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নয়, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই এই সমস্যা। হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের প্রধান কাঞ্চা ইলাইয়া একটি দলিত রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধ নিয়ে অনেক বই লিখেছেন। এ বার তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘বাফেলো ন্যাশনাল- আ ক্রিটিক অফ স্পিরিচুয়াল ফ্যাসিজম’।
টিম মোদী কিন্তু এই বিতর্ক নিয়ে বিচলিত নন। বরং এ বারে বিজেপি চাইছে বিতর্কটা হোক। নেহরুর সময় থেকে তৈরি হওয়া এই যে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে সংখ্যালঘু তোষণের বদলে এক বিকল্প হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ এসেছে, তাকে এক দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে বিজেপি এগোতে চাইছে।
এই মতাদর্শগত সংঘাত এ বার ভারতকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর কি না, তা আমরা জানি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy