লোকসভা নির্বাচন আর ক’দিন বাদেই। পেশায় সাংবাদিক। যেখানেই যাচ্ছি, প্রশ্ন, কী বুঝছেন? এ বারের ভোটের ফল কী হবে? নরেন্দ্র মোদী? নাকি খিচুড়ি? জবাবে বলছি, সংবাদপত্রে প্রতি দিন খবর ছাপা হচ্ছে। পড়ছেন তো? জবাবে চিত্তরঞ্জন পার্কের চিত্তরঞ্জন ভবনের গ্রন্থাগারে দাঁড়িয়ে প্রবীণ মানুষটি বললেন, “কাগজ তো পড়ছি। কিন্তু ও সব তো ছাপার খবর। আসল খবরটি কী? বুঝলাম, প্রবীণ মানুষটির ধারণা সংবাদপত্রে আজকাল আসল খবর প্রকাশিত হয় না।
প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব টি এস আর সুব্রহ্মণ্যম সম্প্রতি লিখেছেন, যদি টিভি না দেখি তা হলে ‘আনইনফমর্র্ড’ হই, আর দেখলে ‘মিস ইনফর্মড’ হই! সংবাদপত্রের বিরুদ্ধেও মানুষের উষ্মার প্রকাশ দেখি সোশ্যাল মিডিয়াতেও। আসলে, আমরা যা জানি না তা যদি অকপটে স্বীকার করি যে, আমরা জানি না, তা হলে বোধহয় সমস্যাটা অনেক কম হয়।
ধরুন, লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল কী হবে সেটা আমি মতামত দিচ্ছি কীসের ভিত্তিতে? ভারত প্রায় দেড়শো কোটি মানুষের দেশ। ২৯টি রাজ্য। আমি থাকি রাজধানী দিল্লিতে। সারা দিন কাদের সঙ্গে কথা বলি? অর্থাৎ, আমার তথ্যের সূত্র কী? বিভিন্ন দলের নানা স্তরের নেতা, আমলা, কূটনীতিক, সতীর্থ সংবাদকর্মী তথা সম্পাদক। যদি এই শহরে আসা-যাওয়ার পথে কোনও চা বিক্রেতা অথবা গাড়িচালক অথবা চর্মকারদের সঙ্গে কথা হয় তা হলেই ভাবি বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন হয়ে গেল। কিন্তু সেই মানুষটিও কতটা প্রান্তিক, কতটা অন্ত্যজ, কতটা নিম্নবর্গ, এ সব প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের পাড়ার মাংসওয়ালা সম্ভবত, আমার চেয়ে ধনী। সেই লোকটি রবিবার মাংস কাটতে কাটতে যদি বলেন, অমুক দল এ বার গোটা দেশে ঝড় তুলবে, তা হলে কি আমি তাঁর মতামতকে শেষ কথা বলে মনে করব? দিল্লিতে থেকেও বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্রের ব্যাসার্ধ থেকে ছিটকে রবিবার দরিয়াগঞ্জের বইবাজারে যাওয়ার সময় পাই না। আমি নাকি সাধারণ মানুষের নাড়ি বুঝি!
অতীতে নাড়ি টেপা চিকিৎসক হত। বিধান রায় সম্পর্কে গল্প আছে, তিনি মুখ দেখে রোগ বুঝতেন। তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতনের ডাক্তারবাবু অথবা বনফুলের অগ্নিশ্বর জ্বরটা ম্যালেরিয়া না ফাইলেরিয়া থেকে হচ্ছে তা বোঝার জন্য সোনোগ্রাফি করতে বলতেন না। এখন তা না। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ওষুধের প্রেসক্রিপশন। নির্বাচনের প্রাক্কালে অতীতে সাংবাদিকেরা মুসাফিরের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। বুঝতে চাইতেন ভোটারদের মনস্তত্ত্ব। এখন বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে নির্বাচন-পূর্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে সাংবাদিক এবং বিশেষজ্ঞেরা টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে অনর্গল বকে যাচ্ছেন।
রাজনীতি বিজ্ঞানে সমীক্ষা একটা খুব কঠিন কাজ। বেসরকারি সংস্থাগুলি সবাই অপেশাদার, এমন কথা বলছি না। কিন্তু এত বিপুল জনসংখ্যার দেশে ঠিক ঠিক মতামত পেতে গেলে অনেক অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন। তা ছাড়া গ্রামের মানুষকেও সব সময় বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। সমীক্ষকদের কাছেও তাঁরা অনেক সময় সত্য গোপন করেন। এমনকী, উল্টো কথাও বলেন। অঙ্ক শাস্ত্রে দু’য়ে দু’য়ে চার হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে যেখানে বিচার্য বিষয় মানুষের আচরণ সেটা সবটাই বস্তুগত নয়। ২০০৪-এ তো গোটা দেশ জুড়ে অধিকাংশ সমীক্ষাই অটলবিহারী বাজপেয়ীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছিল। ফল হয়েছিল অন্য।
আগে আমরা জানতাম, হাঁস শাদাই হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কালো হাঁস পাওয়া গেল। একে বলা হয় ফ্যালাসি। ক, খ এবং গ, তিনটি গোলাপই লাল এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি বলি সব গোলাপই লাল, তার পরেও কিন্তু ঘ গোলাপটি শাদা হতে পারে। দর্শনে একে বলা হয় ফ্যালাসি অফ ইম্পিরিসিজম। বিজ্ঞান বলল, সব কিছু খতিয়ে দেখতে হবে। অ্যারিস্টটল-ও পর্যবেক্ষণে জোর দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে জাহাজে জাহাজে ঘুরতেন। জলের সামুদ্রিক প্রাণী দেখে রাষ্ট্রকে তুলনা করলেন একটা প্রাণীর সঙ্গে। রাষ্ট্রের জৈবিক তত্ত্ব। কিন্তু এহেন বিজ্ঞানের পিতা বললেন, মেয়েদের নাকি দাঁতের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশি। রাসেল তাঁর দ্য ইমপ্যাক্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি গ্রন্থে অ্যারিস্টটলকে ব্যঙ্গ করে বললেন, উনি দু’বার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বউদের দাঁত পরীক্ষা করে দেখেননি। আসলে ছেলে এবং মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা একই।
পরীক্ষা করে নমুনা দেখতে হবে। অনেক দিন পর দিল্লি থেকে বারাণসী গেলাম। গিয়ে দেখলাম বিজেপি-র পক্ষে জোর হাওয়া। কিন্তু মুরলিমনোহর যোশীর বিপক্ষেও তীব্র জনমত। অখিলেশ সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ মানুষের। কিন্তু সংখ্যালঘু সমাজ ঘোরতর মোদী-বিরোধী। কি জটিল পরিস্থিতি! আর আমি দু’দিন সেখানে থেকে আপনাদের জ্ঞান দেব, কী হতে চলেছে! তা ছাড়া বারাণসী মানে কিন্তু উত্তরপ্রদেশও নয়। সে রাজ্যে আশিটি আসন। তারও এক এক এলাকায় এক এক রকমের সমস্যা, ধর্ম, জাতপাত, আঞ্চলিক বাসনা-কামনা, আবার গোটা দেশের ২৯টি রাজ্যের এক একটি রাজ্যে এক এক ধরনের বৈশিষ্ট।
তাই স্বীকার করছি, জটিল এই দেশে নির্বাচনী ফলাফল জ্যোতিষীদের মতো ঘোষণা করতে আমি অপারগ। আমি যে জানি না, সেটা আমি জানি। দীর্ঘ ৩০ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটুকু বলতে পারি যে দশ বছর শাসনের পর মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে একটা তীব্র জনমত তৈরি হয়েছে। এই অসন্তোষ তৈরি হওয়াটা প্রকৃতির সূত্র। ’৬৭ সালে কংগ্রেস প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল নির্বাচনী ফলাফলে। ’৬২ সালের চিনা আক্রমণের পর ’৬৪ সালে নেহরু মারা যান। ’৬৭-তে ইন্দিরা কংগ্রেস গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এবং অবক্ষয়ের শিকার হয়। ঠিক ১০ বছর পর ’৭৭ সালে আবার কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়া। আবার ১০-১২ বছর পর ’৮৯-এ এসে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের হাত ধরে কংগ্রেস বিরোধী জিহাদ। কংগ্রেস বিরোধিতার এই পরিসরটাকে দখল করে বিজেপি বলেছিল তারা অন্য রকমের দল। কিন্তু দশ বছর ক্ষমতায় থেকে তারাও মানুষের অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। আজ মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নীতিপঙ্গুতার বিরুদ্ধে অসন্তোষের যে পরিসর সৃষ্টি হয়েছে তা দখল করতে মরিয়া বিজেপি। এটাও বোঝা যাচ্ছে নতুন কংগ্রেসের ডাক দিয়েও রাহুল গাঁধী মানুষের কাছে সেই আস্থা অর্জন করতে পারছেন না এখনও। আর এই পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয়েছে অরবিন্দ কেজরীবাল নামে এক নতুন রাজনৈতিক বৈশিষ্ট। কিন্তু তাঁদেরও সাংগঠনিক প্রতিপত্তি দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
কিছু মনে করবেন না। ভোটে এ বার কী হবে এই প্রশ্নের জবাব আমি তাই এক কথায় দিতে পারলাম না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy