আমরা কথায় কথায় বলি ভারত হল বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। বিশাল এ দেশ। কোটি কোটি মানুষ। ২৯টি রাজ্য। রাজ্যে রাজ্যে ভোট তো লেগেই রয়েছে। বিধানসভা নির্বাচন শেষ হবে তো আসবে পঞ্চায়েত নির্বাচন। পুর নির্বাচন থেকে লোকসভা নির্বাচন। ভোট মানেই তো মানুষের অধিকার প্রয়োগ। শাসক দল বা নেতা কে হবেন তা নির্ধারণ করবে আমজনতা। ভোটের সময় দেখা যায় নতুন জামা পরে এক হতদরিদ্র মানুষও সেজেগুজে ভোট দিতে যান। এ যেন আমজনতার এক বিশেষ উৎসব। বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচন যেন এক সামাজিক উৎসব।
সত্যি কি নির্বাচন এ দেশের গণতন্ত্রের উৎসব? অধিকার প্রয়োগের, অধিকার অর্জনের উৎসব? কিন্তু কত মানুষ ভোট দিচ্ছেন শুধু সেই সংখ্যার ব্যাপ্তি দিয়ে কি ভারতীয় গণতন্ত্রের গভীরতা মাপা যায়? এটা কি সত্যি নয়? প্রতি দিন, প্রতিনিয়ত যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গ আমরা, সেই ব্যবস্থাই যদি গণতান্ত্রিক না হয়, শ্রেণিবিভক্ত সে ব্যবস্থায় যদি রাজনৈতিক নেতা ও দলতন্ত্র গরিব মানুষের অধিকারকে পদানত করে, ম্যাক্সওয়েবারের সেই সাবেক এলিট-তন্ত্র যদি নব নব রূপে, নব নব রসায়নে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে, মাফিয়া-সমাজবিরোধীদের পেশীশক্তি, অর্থগৃধ্নু রাজনেতা ও বণিক সমাজ যদি তাদের স্বার্থে অচলায়তনের ভিতর আমআদমিকে কয়েদ করে রাখে, তবে সেই বন্দিদশায় গণতন্ত্রের উৎসবের অর্থ কী? রাজনেতাদের ভাবটা এমন, নির্বাচন কমিশনকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে, অতএব সংবিধান অনুসারে ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনই হুজুরের মা-বাপ। তিনিই সর্বশক্তিমান। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারে যেই থাকুক তাকে রক্তচক্ষু দেখানোর ক্ষমতা আছে কমিশনের। সেটাই তো ভারতীয় নির্বাচনী গণতন্ত্রের গর্ব!
সত্যি কি তাই? পাঁচ বছর ধরে কেন্দ্রই হোক আর রাজ্য, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষকে দলদাসে পরিণত করা হবে, চুরি এবং দুর্নীতিই হবে সমাজের স্বাভাবিক স্থিতাবস্থা, সারা বছর ধর্ষিত হবে গণতন্ত্র আর ভোটের সময় নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের সৌধ রচনা করবে, একি অসততা নয়? অবৈজ্ঞানিক নয়? স্ববিরোধ নয়?
’৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর জওহরলাল নেহরু আন্তরিক ভাবেই চেয়েছিলেন দেশে নির্বাচন কমিশন নামক একটি সুষ্ঠু সাংবিধানিক সংস্থা গড়ে উঠুক।
’৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক দু’বছর পরই ভারতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে সুকুমার সেন হন নির্বাচন কমিশনার। তার ঠিক পরের মাসে জন প্রতিনিধি আইন পাশ হয়। বিলটি পাশ হওয়ার সময় জওহরলাল নেহরু আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ১৯৫১ সালে দেশের প্রথম ভোট অনুষ্ঠিত হবে। সুকুমার সেন গণিতশাস্ত্রে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালে তাঁর জন্ম। প্রেসিডেন্সি কলেজ আর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং তার পর পশ্চিমবঙ্গেই মুখ্যসচিব হন। প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ভেবেছিলেন লোকটা যখন অঙ্ক জানে তখন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাজটাও এ দেশে করতে পারবেন। সুকুমার সেন যে কী ভয়ঙ্কর এক দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেটা আজ আমরা বুঝতে পারছি। ১৭৬ মিলিয়ন ভারতীয়র বয়স ২১। এর মধ্যে শতকরা ৮৫ জন লিখতে বা পড়তে পারে না। এদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে তাদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে। দলীয় প্রতীক ব্যালট পেপার ব্যালট বাক্স তৈরি করতে হবে সেই বিশাল অশিক্ষিত জন সমাজের জন্য। সুকুমার সেন এই বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রথম ঋত্বিক ছিলেন। ১৯৫২ সালে যখন ভোট হল তখন গোটা দেশে ৫০০টি লোকসভা আসনের জন্য ৪,৫০০টি আসন নির্ধারিত হয়। ২,২৪,০০০টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র ছিল। ২ মিলিয়ন ইস্পাত নির্মিত ব্যালট বাক্স, ৮২০০ টন ইস্পাত লেগেছিল এ কাজে। ১৬,৫০০ জন নির্বাচনী আধিকারিক সে বারের ভোটে কর্মরত ছিলেন।
বিশাল এই দেশে তখন প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল শোচনীয়। নদী-নালা, ব-দ্বীপ কতরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে ভোটপর্ব। আবার এর পাশাপাশি মেয়েরা, বিশেষত উত্তর ভারতে কেউ ‘ক’ বাবুর স্ত্রী বা ‘খ’ বাবুর মা, এ রকম পরিচয় দিয়ে ভোট দিতে চাইছেন। সুকুমার সেন তখন থেকেই ভোটার তালিকায় সুষ্ঠু নাম লেখার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২০৮ মিলিয়ন মহিলার নাম প্রথম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় শুধুমাত্র তাদের সঠিক নাম না থাকায়। সুকুমার সেন ভেবেছিলেন প্রথম ভোটপর্বে ওই সব নাম বাদ যাওয়াটাই ভাল হয়েছে, তাতে সচেতনতা বাড়বে মেয়েদের মধ্যে। স্বামী, বাবা বা পুত্রের নামের অনুষঙ্গ হিসাবে নয়। মেয়েদের তাদের নিজস্ব নামেই ভোট হতে হবে এই চেতনার বিকাশ পরবর্তী ভোটে তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় আসবে। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় দলের নাম প্রায় প্রত্যেক ভোটারই জানে, কিন্তু ভারতীয় ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দলীয় প্রতীকের ব্যাপারে সুকুমার সেন গুরুত্ব আরোপ করেন। তথ্যচিত্র ও রেডিওতে তিনি নির্বাচনের প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ভোট দেওয়ার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ৩০০টি সিনেমা দেখানো হয় প্রথম নির্বাচনে। সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত কত জন নির্বাচন কমিশনার এসেছেন। ধাপে ধাপে এগিয়েছে এ দেশের নির্বাচনী গণতন্ত্র। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে টি এন শেষণ এ দেশের নির্বাচনী সংস্কারে এক মস্ত বড় মাইলস্টোন। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কুরেশি পর্যন্ত বলেছেন যে হতে পারে একটা ‘হাইপ’ তিনি তৈরি করেন, হতে পারে এক বিশেষ ধরনের অতি সংবেদনশীলতা সে সময়ে তৈরি হয়, কিন্তু শেষণ একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেন। তার পর লিংডো-ও বিতর্কিত হন নানা ধরনের মন্তব্যে, কিন্তু প্রকাশ্যে ভোটের সময় নির্লজ্জ ভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কমেছে এ কথা ঠিক।
কিন্তু তাতেও পেশীশক্তি ও অর্থবলের নিয়ন্ত্রণ, ভোটে কারচুপি থেকেই যায়। আসলে শুধুমাত্র ভোটের সময় সব দায়িত্ব কমিশনের ঘাড়ে চাপালে চলবে না। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবস্থাতেও বদল চাই। সেটা হচ্ছে কোথায় ?
প্রণব বর্ধন সম্প্রতি অম্লান দত্ত শীর্ষক বক্তৃতায় বলেছেন, কত বার দেশে ভোট হয় আর শতকরা কত ভোট মানুষ দিচ্ছে তা দিয়ে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পরিমাপ হয় না। আসলে সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রকৃত ভোটারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু? কখনও কখনও ভোটারকে টিবি ও ক্যানসারের মধ্যে বাছাই করার অধিকার দেওয়া হয়। ভারতে এবং আজ পশ্চিমবঙ্গে যে পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে সেটা হল ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট সিস্টেম’। ব্রিটেনের রাজশক্তির এই গণতন্ত্রের অনেক ‘ফ্যালাসি’ আছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি কোনও দলকে না-ও চায় তবু আসনসংখ্যা বেশি থাকলে ক্ষমতায় তারাই আসে।
১৯৯৭ সালে ব্রিটেনের নির্বাচনে লেবার পার্টি পায় ৪৩.২ শতাংশ ভোট আর ৬৩.৬ শতাংশ আসন। টোরি পার্টি এবং লিবারাল ডেমোক্র্যাট-রা সব মিলিয়ে পান ৪৭.৫ শতাংশ ভোট, কিন্তু আসন পায় তারা ৩২.১ শতাংশ। এই ব্যবস্থা তা হলে কতটা গণতান্ত্রিক? এই ধাঁধা যত দিন থাকবে তত দিন এ দেশে নির্বাচনী পদ্ধতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা খুবই কঠিন। তা ছাড়া দুর্নীতির প্রশ্নে, সততার প্রশ্নে যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ও দায়বদ্ধতা না থাকে, যদি শাসক দল গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত করতে না পারে তা হলে ভোট ব্যবস্থাতেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কী ভাবে?
তাই শুধু নির্বাচন কমিশনের স্লোগানে কী লাভ? চাই শিকড় ধরে টান। রাজনৈতিক সামগ্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ হল নির্বাচন।
সামগ্রিক ব্যবস্থাকে অবিকৃত রেখে ভোটকে বিশুদ্ধ করা— অসম্ভব। সোনার পাথর বাটি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy