Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
Atal Bihari Vajpayee

বাজপেয়ী ‘নম্বর টু’ হয় না

মানুষটার মধ্যে এক বহুত্ববাদী উদার ভারতীয় সত্তা ছিল। তিনি তো বলেছিলেন, হিন্দুত্ব শব্দটির চেয়ে ভারতীয়ত্ব শব্দটাই আমার বিশেষ পছন্দের। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালমানুষটার মধ্যে এক বহুত্ববাদী উদার ভারতীয় সত্তা ছিল। তিনি তো বলেছিলেন, হিন্দুত্ব শব্দটির চেয়ে ভারতীয়ত্ব শব্দটাই আমার বিশেষ পছন্দের। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

অটলবিহারী বাজপেয়ী

অটলবিহারী বাজপেয়ী

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিন ছিল গত ২৫ ডিসেম্বর। তিনি ৯৩ বছরে পা দিলেন। বর্ষ শেষে বার বার বাজপেয়ীজির কথা মনে পড়ছে। ২০১৪ সালে বিপুল ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২৮২টা আসনে জিতে বিজেপি-র একক ভাবে ক্ষমতায় আসা এ-ও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ভূমিকা দলীয় সাফল্যের পিছনে ছিল অনেকখানি।

তারও পর আছে। তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মোদী সরকারের কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে যখন বসছি, তখন বাজপেয়ী আর মোদী এই দুই ব্যক্তিত্বের তুলনামূলক পর্যালোচনা করতেই হচ্ছে। বাজপেয়ী বাজপেয়ী-ই। বাজপেয়ী ‘নম্বর টু’ হয় না। মোদী আর বাজপেয়ী— সাংস্কৃতিক ভাবেই দু’জন দু’রকমের। গোধরা দাঙ্গা, তার পর বাজপেয়ী কী মনোভাব মোদী সম্পর্কে নিয়েছিলেন, সে সব কথা আজ আমি তুলতে চাই না। কেশুভাই পটেলকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী করতে বাজপেয়ী রাজি ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে লালকৃষ্ণ আডবাণী নবীন প্রজন্মকে প্রবীণ প্রজন্মের পরিবর্তে আনতে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন, এ সব কথাও তো অনেক বার লেখা হয়েছে। কিন্তু, বাজপেয়ী কেমন মানুষ ছিলেন? সেটা আজ আমরা নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বোজার চেষ্টা করতে চাইছি। ’৭৭ সালে বাজপেয়ী যখন প্রথম মোরারজি সরকারের বিদেশমন্ত্রী হন, সে দিন সাউথ ব্লকে গিয়েই তিনি প্রথম প্রশ্ন করেন, এখানে নেহরুর একটি তৈলচিত্র ছিল, সেটি কোথায় গেল? বাজপেয়ী নতুন মন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু সাংসদ হিসাবে তো নতুন নন। বার বার তিনি এসেছেন এই সাউথ ব্লকে। জানা গেল, জনসঙ্ঘের সরকার এসেছে বলে কোনও অতি উৎসাহী আমলা নেহরুর ছবিটাই সরিয়ে দেন। তিনি সম্ভবত ভেবেছিলেন, বাজপেয়ী খুশি হবেন। ফল হল উল্টো। বাজপেয়ী বিদেশমন্ত্রী হয়ে প্রথম নির্দেশ জারি করেন, ওই ছবিটা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাজপেয়ীর বক্তব্য ছিল, ইতিহাসকে কখনও আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করবেন না। এটা করা যায় না। বাজেপেয়ী বরং বলেছিলেন, নেহরুর জোট নিরপেক্ষ জোট নীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই তো আমার কাজ।

মানুষটার মধ্যে এক বহুত্ববাদী উদার ভারতীয় সত্তা ছিল। তিনি তো বলেছিলেন, হিন্দুত্ব শব্দটির চেয়ে ভারতীয়ত্ব শব্দটাই আমার বিশেষ পছন্দের। বাজপেয়ী মনে করতেন, হিন্দুত্ব শব্দটি নিয়ে যখন এত সংশয় তখন অযথা সংশয় বাড়িয়ে লাভ কী? আডবাণী বললেন, রামমন্দির মানে আমি মনে করি ভারতমাতার মন্দির। বাজপেয়ী বলেছিলেন, তা হলে রামমন্দির না বলে ভারতমাতার মন্দির বলাই ভাল। একটা শব্দের জন্য এত হানাহানিতে লাভ কী?

বাজপেয়ীর মধ্যে ছিল দারুণ হাস্যরস। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার পর যখন তাঁকে ব্যাঙ্গালোর জেলে রাখা হয়, তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আপ্পা ঘাটাটে জেলে গিয়ে দেখেন বাজপেয়ী ডোরা কাটা জামা আর হাফ প্যান্ট পরে বসে আছেন নিজের সেলে। আপ্পা, সেই মরাঠি বন্ধুটি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ধুতি পরলেই তো পারেন, এ রকম জামা-প্যান্ট পরার দরকার কী? জবাবে তিনি বলেন, আমি এখন ইন্দিরা গাঁধীর অতিথি। তিনি খাওয়াদাওয়ার ভার নিয়েছেন, বসনেরও। তা নিজের পয়সা খরচ করি কেন? এমনটাই বাজপেয়ী।

বাজপেয়ী আর মোদী— সাংস্কৃতিক ভাবেই দু’জন দু’রকমের। ফাইল চিত্র।

বাজপেয়ীকে নকল করে অনেকেই বক্তৃতা দেন বিজেপিতে। অনেকে তাঁকে অনুকরণ করে কবিতাও লেখেন। আডবাণী অবশ্য তা করেননি। তিনি কোনও দিন কবিতা লেখেননি। কিন্তু, বাজপেয়ী বিরাট বড় কবি হন, বা না হন, তাঁর ভাবনায় গভীরতা ছিল। একটি কবিতায় তিনি লেখেন, বরফ ঢাকা হিমালয়ের পর্বত কোলে সবুজ উদ্ভিদ একা। নীচে বৃক্ষ সমাজ। ঈশ্বর আমাকে এতখানি উচ্চতা দিও না যেখানে আমি একা হয়ে যাই।

বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়ে জোট সরকার গঠন করেন। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া দলের শাসক আচরণেও একনায়কতন্ত্র আসতে পারে। এর চেয়ে জোট ধর্মই ভাল।

রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাই, প্রচার তো তাঁরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, প্রচারের অশ্লীল ঢক্কানিনাদ ছিল না। বাজপেয়ী যখন ’৭৭ সালে প্রথম মন্ত্রী হন, তখন আরএসএসের ইংরেজি মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ তাঁর কবিতার বইয়ের এক বিশাল পর্য়ালোচনা প্রকাশ করেন তৎকালীন সম্পাদক ভিপি ভাটিয়া। তিনি যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এটা প্রকাশ করেন, তা নয়। কিন্তু বাজপেয়ী তাঁকে ফোন করে বলেন, এত বড় প্রচার তাঁকে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এটা আউট অব প্রোপরশন। বাজপেয়ীর মনে হয়েছিল, তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন বলেই সম্ভবত ‘অর্গানাইজার’ এ হেন প্রচার দিয়েছে। অন্তত লোকে তাই ভাববে। তাই খুশি হওয়া তো দূরের কথা, তিনি লজ্জিত হন। এ কথা পরে ভিপি ভাটিয়া নিজেই লিখে গিয়েছেন। বইটির নাম ছিল, ‘কয়েদি কভিবাই কি কুন্ডলিয়া’।

খাজা আদমেদ আব্বাস মুম্বই ফিল্ম জগতে সে সময়ে এক বিখ্যাত বামপন্থী ছিলেন। ’৭৯ সালে মুম্বইতে এক নৈশপার্টিতে বামপন্থী ফিল্ম নির্দেশকদের আড্ডায় বাজপেয়ী ছিলেন আলোচনার বিষয়। সেখানে এক পরিচালক বলেন, আব্বাসকে কত বোঝালাম, বাজপেয়ী এক জন আমেরিকান এজেন্ট। ওকে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তিনি কিছুতেই আমার কথা শুনলেন না। ওই মুসলিম বুদ্ধিজীবী বলেন, আমি তো বাজপেয়ী ভক্ত, কারণ তিনি তো আমাদের নিয়েও চলতে চান।

তুলনা করব না। শুধু বলব, আর একটা বাজপেয়ীকে পাব কোথায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE