Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পাল্টে যাওয়া সময়ে নব্য প্রজন্মের মধ্যেও ভাবনা-বদল

হাওয়াই চটি, কাঁধে ঝোলা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ করতে উৎসাহী নয় তারা। বরং পড়াশোনা করে আমেরিকায় যেতে চায় এই প্রজন্ম। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালনাট্যকার ব্রেখট বলেছিলেন, বর্তমান বলে সত্যি কি কিছু হয়? মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই অতীত। যে মুহূর্তে একটি মুহূর্তকে ধরতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়ে যায় অতীত। পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকের শেষ থেকে জঙ্গি বামপন্থী আন্দোলনে অভ্যস্ত ছিল নব্য প্রজন্ম। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও— এই সব স্লোগান দিয়েছি। তার পর বললাম, সোভিয়েত ইউনিয়নও এক নয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ।

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

নাট্যকার ব্রেখট বলেছিলেন, বর্তমান বলে সত্যি কি কিছু হয়? মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই অতীত। যে মুহূর্তে একটি মুহূর্তকে ধরতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়ে যায় অতীত।

পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকের শেষ থেকে জঙ্গি বামপন্থী আন্দোলনে অভ্যস্ত ছিল নব্য প্রজন্ম। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও— এই সব স্লোগান দিয়েছি। তার পর বললাম, সোভিয়েত ইউনিয়নও এক নয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। আফগানিস্তানে রুশ সেনা ঢোকার পর আমাদের মোহভঙ্গ হয়। তখন কথায় কথায় টাটা, বিড়লা, পরবর্তী কালে অম্বানীর বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলতাম আমরা। বুর্জোয়া পুঁজিপতির সঙ্গে শোষিত শ্রেণির লড়াইয়ে আমরা মধ্যবিত্ত পাতি বুর্জোয়া কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, তা নিয়ে চলত বিস্তর গবেষণা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হত, আমাদের শ্রেণিচ্যুত হয়ে সর্বহারার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

সময় কত বদলে গিয়েছে। এখন গুরুদাস দাশগুপ্ত অথবা নীলোৎপল বসু রিলায়েন্সের বিরুদ্ধে যতই বিবৃতি দিন না কেন, নবীন প্রজন্মের ‘মাইন্ডসেট’ কিন্তু রিলায়েন্স বিরোধী অথবা শিল্পপতি বিরোধী নয়। আজকের প্রজন্ম আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকাকে হয়তো অস্বীকার করে না, কিন্তু তারা পায়ে হাওয়াই চটি, কাঁধে ঝোলা আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ করতে উৎসাহী নয়। বরং পড়াশোনা করে আমেরিকায় যেতে চায়। ভাল জীবনযাত্রা চায়। টাকা রোজগার করাটা অন্যায় বলে মনে করে না। এমনকী, চাকরি করার জন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে তারা কিঞ্চিৎ আপস করতেও প্রস্তুত।

মে দিবস, ১৯৭১। ময়দানে বামফ্রন্টের সমাবেশ।—ফাইল চিত্র।

এ ব্যাপারে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল আমার।

সম্প্রতি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গণ সংযোগ (মাস কমিউনিকেশন) বিভাগ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। বিভাগীয় প্রধান রাজেশ দাস আমাকে সম্পাদকের ভূমিকার অবনয়ন নিয়ে বলার জন্য অনুরোধ করেন। এটি ছিল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটি কর্মশালা। আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রস্তাব দিলাম, প্রথমেই চারটি জ্ঞান দেওয়ার চেয়ে আমরা একটা খবর তৈরির খেলা খেলি। একটি কল্পিত সংবাদের কিছু পয়েন্ট তাঁদের কাছে তুলে ধরলাম। ছাত্রছাত্রীদের বলা হল, ধরে নেওয়া যাক, তাঁরা সকলেই সংবাদপত্রের সম্পাদক। এ বারে সংবাদ পরিবেশন করবেন কী ভাবে? সংবাদটি পরিবেশন করার জন্য তাঁরা কি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন, না কি মালিকের কাছে অনুমতি নিতে যাবেন? মালিক বলার পরেও তাঁরা কি সেটি শুনবেন, না কি তা উপেক্ষা করেই সংবাদটি পরিবেশন করবেন? তাঁদের বলা হল কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে মতামত জানাতে।

ছাত্রছাত্রীদের সামনে একেবারেই কল্পিত যে গল্পটি তুলে ধরা হল, তা কতকটা এ রকম। ধরা যাক, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার আগে থেকেই রিলায়েন্স গোষ্ঠী থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন পেট্রোলিয়াম দফতরের মন্ত্রী থেকে আমলারা। এমনকী, কিছু পেটোয়া সাংবাদিকও এই সুবিধাভোগীর তালিকায় রয়েছেন। অনেক বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক আমলা রিলায়েন্স থেকে মাসোহারা পাচ্ছেন। তাঁদের কাছে প্রতি মাসে খাম পৌঁছে যায়। মন্ত্রীদের সাত-আট দিনের ট্যুর করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এই ঘটনায় তিন জন সাংবাদিকের নামও উঠে এসেছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে কী করে সংবাদটি পরিবেশন করা হবে, সেটি জানতে চাই ছাত্রছাত্রীদের কাছে।

প্রশ্ন শুনে এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, তিন জন সাংবাদিক কি ‘ইন-হাউস’? অর্থাৎ যে ছাত্র এখন সম্পাদকের ভূমিকায়, তাঁর সংস্থাতেই কি কাজ করেন অভিযুক্ত সাংবাদিকেরা? বললাম, ধরে নেওয়া যাক, এঁদের মধ্যে এক জন ইন-হাউস ও বাকি দু’জন অন্য সংস্থায় কাজ করেন। এর পর ছাত্রছাত্রীদের থেকে জবাব আসার পালা। তাঁরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে উত্তর লিখলেন। উত্তরপত্রগুলি যখন জমা পড়ল আমার কাছে, তখন তো প্রায় চমকে যাওয়ার জোগাড়। সিংহ ভাগ ছাত্রছাত্রীর মত, এই কল্পিত সংবাদটিতে মন্ত্রীর নাম লিখে দেওয়া উচিত। কিন্তু রিলায়েন্সের নাম ছাপা যাবে না।

কেন? তার যুক্তিও অনায়াসে লিখে ফেলেছেন এই প্রজন্মের মুখেরা। প্রজ্জ্বল, মধুমিতা, সুষমা, প্রীতম, রিয়ারা যেমন লিখলেন, রিলায়েন্সের মতো বড় শিল্পগোষ্ঠী থেকে বিজ্ঞাপনের একটি বড় অংশ আসে, তাই তাদের নাম বাদ দিয়ে পুরো সংবাদটি ছাপবেন সম্পাদক হিসেবে। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী-সহ ঘটনায় জড়িত সাংবাদিকদের নামও প্রকাশিত হবে। প্রিয়াঙ্কা, শাহবাজ, কৌস্তভ, পাপ্পু, বিপ্রায়নরা তো এখন এই খবর ছাপার পক্ষেই নয়। কারণ, শিল্পগোষ্ঠীর নাম লিখলে খবরের কাগজের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়তে পারে বলে তাঁদের ধারণা। ভবিষ্যতে এই খবর নিয়ে হইচই হলে বরং একটি প্রতিবেদন ছাপা যেতে পারে বলে তাঁদের অভিমত। অর্পিতা চক্রবর্তী, জিনিয়া রায়, কৌশালী শীল, উদ্দীপ্তা সরকার, সুপর্ণা সাহা-রাও শিল্পগোষ্ঠীর নাম বাদ দিয়ে খবরটি ভেতরের পাতায় ছোট করে ছাপার পক্ষপাতী। মন্ত্রী যে হেতু জনপ্রতিনিধি, তাই তাঁর নাম প্রকাশ করতে চান তাঁরা। একই সমীকরণ মেনে খবরটি পরিবেশন করতে চান সুকল্পা ঘোষ, সুচন্দ্রা দে, স্নেহা সিংহ, পায়েল চক্রবর্তী, সুস্মিতা দে, টুইংকল ও কমল রায়, অদিতি, বিপাশা, ইন্দ্রনীল, পৌলমী দে, প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী, ঋতুপর্ণা এবং মৈত্রীরা।

তবে, কেউ কেউ খবরটি প্রকাশের আগে মালিকের কাছে সম্মতির জন্য যেতে আগ্রহী। যেমন কার্তিক, দেবায়ন, অরিন্দমরা মনে করেন, সম্ভব হলে সংবাদপত্রের মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে চান তাঁরা। সৌরভ ভট্টাচার্য, সুস্মিতা সরকাররা মনে করেন, মালিক না চাইলে শিল্পগোষ্ঠীর নাম দেওয়া হবে না। মালিকের উপরেই নির্ভর করবে সাংবাদিকের নাম দেওয়া হবে কি হবে না। তবে, খবরটিকে আকর্ষণীয় করার জন্য মন্ত্রীদের নাম এবং ছবিও দেওয়া হবে। এ সবের উল্টো মতও রয়েছে। কিন্তু সেটি নিছকই সংখ্যালঘু। সায়ন নস্কর, অঙ্কত সরকার ও অঙ্কিতা মিশ্ররা চান, খবরের সত্যতা যাচাই করে সেটি ছাপা উচিত। কিন্তু, শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে চান তাঁরা। তবে সেখানেই থেমে না থেকে এই খবর ছাপার জন্য মালিককে বোঝানোরও চেষ্টা করবেন। কিন্তু সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীরই মত, শিল্পগোষ্ঠীর নাম ছাপা হবে না। মালিকের কাছে না গিয়েই সম্পাদক হিসাবে এই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়ে ফেলবেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এ সব দেখে ছাত্রছাত্রীদের বললেন, আমাদের সময় আমরা চে গুয়েভারাকে সামনে রেখে লড়াই করেছি। তোমরা চে গুয়েভারাকে টি-শার্টে পরিণত করেছ।

বাস্তবের উপলব্ধিটা এই প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই করে ফেলেছে। এটি অবশ্য খারাপ কিছু নয়। কিন্তু, সময় অনেক বদলে গিয়েছে। তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ভাবনাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE