Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
National news

কাশ্মীরিদের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব যত বাড়ছে, সরকারি ব্যর্থতাও তত বাড়ছে

উন্নয়নের জোয়ার আসবে, কাশ্মীরিদের এমন বিশ্বাস কি নরেন্দ্র মোদীর প্রতি রয়েছে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালউন্নয়নের জোয়ার আসবে, কাশ্মীরিদের এমন বিশ্বাস কি নরেন্দ্র মোদীর প্রতি রয়েছে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, আধুনিক প্রজন্মের কাশ্মীরি মেয়েরা পাথর ছুড়ছে ভারতীয় সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে। শ্রীনগরের এই ফুটেজ দেখে ভারতের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো বলবেন, এই বালিকাদের পিছনে রয়েছে পাকিস্তানি প্ররোচনা। গভীর ষড়যন্ত্র। জেহাদি-জঙ্গি সংগঠন এই সব বিক্ষোভের জন্য দিচ্ছে নগদ, এ হল বিশ্ব সন্ত্রাসের বাজার অর্থনীতি। অতএব ঘটনার মিছিল। সেনা ছাউনিতে পাক-হানা, কুপওয়াড়া-উরি। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কাশ্মীরে সন্ত্রাস হলেই সরকারের নৈতিক ইস্তফা দাবি করত সনিয়া গাঁধীর কংগ্রেস। ইউপিএ যুগে মনমোহনেরও ইস্তফা দাবি করা হত। এখন ক্ষমতাসীন ২৮২টি আসনে বিজয়ী শাসক দল এবং তার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। প্রেক্ষাপট তাই বদলে গিয়েছে। আপাতত আমরা সার্জিকাল স্ট্রাইক-এর স্বপ্নমদির নেশার উন্মত্ততায়। দায়ী পাকিস্তান। দায়ী ইসলামিক জেহাদির মৌলবাদ। দায়ী জাতীয়তাবাদ ও সেনা বিরোধী শক্তি।

সত্তর বছরের এই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান মোদী তিন বছরেই করে দেবেন, এমনটা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু সমাধানের অভিমুখটা কি সঠিক? কাশ্মীরকে ঘিরে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংঘাত রয়েছে। সীমান্ত বিতর্ক আছে। তাই মাওবাদী সমস্যার সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যার তুলনা করি। কিন্তু বীরত্ব প্রদর্শনের এই প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু রণকৌশল কি এখনও বদলানোর সময় আসেনি? এই ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করে দেওয়ার তথাকথিত পৌরুষ জগমোহন থেকে গ্যারি সাক্সেনা, অনেকের সময়ে দেখেছি। জগমোহনের সঙ্গে এখনও প্রায়ই দেখা হয় ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। এখন কিন্তু তিনি স্বীকার করেন, শুধু সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন নীতি দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না।

অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু আলোচনা ও সন্ত্রাস দমন, দু’টিকেই একসঙ্গে চালাতেন। এক দিকে হুরিয়তদের সঙ্গে আলোচনা। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলা। স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটা গণতন্ত্রের আবহ তৈরি করা। এবং কাশ্মীরের মানুষের কাছে একটা ‘ইনসানিয়ত’, যাকে বলে মানবিক মুখ তুলে ধরার প্রচেষ্টা ছিল। বাজপেয়ীর মনে হয়েছিল, কাশ্মীরিয়তের সত্তা ভারতীয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন যাতে না হয়, তার জন্য এই মানবিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ।

কাশ্মীরের ইতিহাসে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল অনেক কম। সাতচল্লিশের দেশভাগকে কেন্দ্র করে যখন গোটা দেশে দাঙ্গা হয়েছে, তখন কিন্তু কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়নি। এই সেই কাশ্মীর, যা দেখে এক দিন জাহাঙ্গির বলেছিলেন, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে সেটা এখানেই। জাহাঙ্গির তাঁর আত্মজীবনীতে এই কাশ্মীরের কথা লিখতে গিয়ে সেখানকার স্থানীয় মানুষের সম্প্রীতির ছবি তুলে ধরেছিলেন। কলহণের রাজতরঙ্গিনী-তে রাজতন্ত্রের অনেক কু-দিকের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব ছিল না। আকবরের কাশ্মীর দখলের পর কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বাড়তে পারে, কিন্তু ধর্মীয় সংঘাত বাড়েনি। ১৮৪৬ সালে ডোগরা রাজত্ব আসার পর শ্রেণি-সংঘাত বাড়ে। ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা বাড়ে। ১৯২৫ সালে হরি সিংহের রাজত্ব শুরু হয়। কিন্তু তার পর সাতচল্লিশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, কাশ্মীর কোনও না কোনও ভাবে ভারতীয় মূলস্রোতের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। শেখ আবদুল্লা তাঁর দলের নাম মুসলিম কনফারেন্স থেকে জাতীয় কনফারেন্স করায় উপত্যকায় বিতর্ক হয়েছে। তাঁর নেহরু প্রীতি পাকিস্তানের রোষের কারণ হয়েছে। তবু মনে হয়েছে, কাশ্মীর হাতের বাইরে চলে যায়নি।

আর আজ সেই কাশ্মীর যেন মনে হচ্ছে, ভারত রাষ্ট্রের দমন নীতির বিরোধিতায় একটা আত্মঘাতী হতাশাব্যঞ্জক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি শক্তি ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবেই। কিন্তু উপত্যকার কাশ্মীরিদের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব যত বাড়ছে, সরকারি ব্যর্থতাও তত বাড়ছে। বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসমানদের প্রদেশ জম্মু-কাশ্মীর। সেখানে অমিত শাহ-রাম মাধব, হিন্দুত্বের বিজয়পতাকা ওড়াতে যত বেশি ব্যস্ত, তত বেশি চিন্তিত নয় আহত গণতন্ত্রকে নিয়ে।

কিছু দিন আগে কাশ্মীরে হুরিয়ত নেতা গিলানির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। গৃহবন্দি গিলানি তাঁর বই ঠাসা ঘরে বসে বার বার বলেছিলেন, আমরা কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই না। আমরা আমাদের সত্তার স্বাধীনতা চাই। মেহবুবা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আমাকে বুঝিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম বহু দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে বামপন্থার বিপদ হয়েছে, সেই বিপদ হুরিয়ত সংগঠনের হয়েছে মেহবুবা ক্ষমতায় থাকায়। মেহবুবার বিজেপির মতো শক্তির সঙ্গে ঘর বাঁধা দেখে ফারুখ আবদুল্লার জাতীয় কনফারেন্স বেশি বেশি করে কাশ্মীরি মুসলিম সত্তার কথা বলতে শুরু করেছে। বিচিত্র এই স্থানীয় ক্ষমতার রাজনীতি সমস্যা সমাধানের প্রকৃত চেষ্টার থেকে পরিস্থিতি জটিল করছে বেশি।

আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া স্থাপন করার চেষ্টা সবসময়ই কাশ্মীর পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। মনমোহন-পারভেজ মুশারফ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ভারত-পাক শান্তিপ্রক্রিয়াকে পিছনো যাবে না, সব সময়েই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মোদী সরকার সেই অবস্থান বদলেছেন। কিন্তু তাতে শুধু কাশ্মীর নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্র এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

এক সুদীর্ঘ গ্রীষ্মকাল আসছে। এই সময়েই পাক জঙ্গি অনুপ্রবেশ বাড়ে। এই রকমই এক গ্রীষ্মে কারগিলের আগ্রাসন হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিটাও ভারতের পক্ষে খুব অনুকূল নয়। চিন আরও আক্রমণাত্মক। আমেরিকার সামরিক সহায়তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারত কতটা পাবে জানি না। কিন্তু গত তিন বছরে বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের কৌশলগত পরিসর বেড়েছে বই কমেনি। সেনা বা আধাসামরিক বাহিনী পাঠিয়ে দমননীতি ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অরাজি মোদী সরকার। প্রয়োজন ছিল কাশ্মীরের উন্নয়ন। গত সত্তর বছরে কাশ্মীরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের যুবকদের শিক্ষা ও চাকরির ব্যবস্থা কতখানি হয়েছে? অতীতেও সব প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের কথা বলেছেন। আর্থিক প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে সেই একই বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া হবে না, কাশ্মীরে উন্নয়নের জোয়ার আসবে, কাশ্মীরিদের এমন বিশ্বাস কি নরেন্দ্র মোদীর প্রতি রয়েছে? মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ ঘোচানোর একটাই উপায়। অন্য মানুষটিকে জানা। তার জন্য চাই কথোপকথন, সংযোগ স্থাপন। সে আলোচনার প্রক্রিয়াই যদি স্তব্ধ রাখা হয়, তবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের চিত্রনাট্যটি রচনা করবে কে এবং কী ভাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE