Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
শাহি সমাচার

হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের রাজনীতি দূরে যাক

এই সপ্তাহেও তিন তালাক নিয়ে প্লেটো এবং কৌটিল্য! তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জয়ন্ত ঘোষালএই সপ্তাহেও তিন তালাক নিয়ে প্লেটো এবং কৌটিল্য! তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:২২
Share: Save:

প্লেটো: একটা কথা মর্ত্যে এসে টের পেলাম। সেটা হল, আমি নিজেকে সবজান্তা ভাবতাম। কিন্তু সময় কত এগিয়ে গেছে। দর্শন বদলেছে। সমাজ বদলেছে। জ্ঞানও কত বদলেছে। জ্ঞান আরও প্রসারিত। আমার চেয়ে তো এখন দিল্লি বা কলকাতার কিশোরও অনেক ব্যাপারে অনেক বেশি জানে।

জয়ন্ত: কিন্তু আপনাকে টেনে এনে কি কোনও অন্যায় করলাম? তিন তালাক আর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তো একটা ছুতো। আসলে আমরাও জানতে চাই, আজকের সত্য যদি খণ্ড সত্য হয় তবে অখণ্ড সত্য চিরায়ত চিরন্তন। আজও তা আছে তো? নাকি প্লেটোবাবু, আপনার মনে হচ্ছে তিন তালাক ইস্যুতে ব্যবহারিক সামাজিক বিষয়টিই চরম সত্য।

প্লেটোবাবু: দেখো বাপু, এই এক সপ্তাহে খুব ভাল করে কোরানটা আর এক বার আমি পড়ে ফেললাম। Polygamy (বহুগামিতা) দুই প্রকার— Poly gyny যেখানে এক স্বামীর অনেক বৌ আর Polyandry, যেখানে এক মহিলার অনেক পতি। কোরানে দ্বিতীয় বিষয়টি খুঁজে পেলাম না কিন্তু প্রথম বিষয়টির একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা আছে। কোরান Polyandry-তে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তাই তোমাদের সুপ্রিম কোর্ট বহু পত্নীর বিষয়টি নিয়েই কথা বলছে বা রায় দিতে পারে। কোরানে (৪.৩) এক বারই এই বহুগামিতার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু মনে হয় ইসলামিক আইনও একটি খুবই misunderstood একটা ধারণা। কোরানে উল্লেখ আছে, এক জন পুরুষ কখন অনেকগুলি স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। সেটা হল, যুদ্ধের সময় যখন অনেক বিধবা সুরক্ষিত থাকেন না তখন তাঁদের জীবনধারনের নিরাপত্তার জন্য অনেক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজন হয়।

প্লেটো যখন তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন ঠিক তখনই শাহি সমাচারের মঞ্চে প্রবেশ করলেন কৌটিল্য।

কৌটিল্য: আমার মনে হয় ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যদি শক্তিশালী রাখতে হয় তবে এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট Polygyny, অর্থাৎ অনেকগুলি বিবাহ করাকেই বেআইনি ঘোষণা করুন। এটা যে আসলে ইসলামিক আইনেরও বিচ্যুতি সেটাই বড় কথা। শামিন আরা মামলায় যে তিনটি তালাক দেওয়ার কথাকে ঠিক যে ভাবে অবৈধ অকার্যকর ( Invalidated) ঘোষণা করা হয়েছিল ঠিক সে ভাবেই এ কাজটা করা প্রয়োজন। তাতেই রাষ্ট্রধর্ম সুরক্ষিত হবে। লিঙ্গ নামক বিষয়টি অনেক বেশি সুষম হবে।

জয়ন্ত: আমরা তো চাই ভারতীয় রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হোক, কিন্তু হিন্দু সমাজে বহু বিবাহ তো আইনগত ভাবেই অবৈধ। অতীতে কুলীন ব্রাহ্মণেরা একাধিক বিবাহ করতেন। এখনও কিন্তু বহু পুরুষ একাধিক স্ত্রী রক্ষা করেন, অন্য জীবিত স্ত্রীর অনুমতিসাপেক্ষে। ১৯৫৫ সালের বিবাহ আইন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, আইপিসি সেকশন-৪৯৪ একাধিক বিবাহকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বললেও সামাজিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে এ দেশে হিন্দু পরিবারেও বহুবিবাহ আছে। Flavia Agnes-এর গবেষণা থেকেও এ তথ্য উঠে এসেছে। সুপ্রিম কোর্ট তো এ ব্যাপারেও ধীরে চলো নীতি নিয়েছে।

কৌটিল্য: আসলে হিন্দু সমাজেও অতীতে পরকিয়া প্রেম ছিল, কিন্তু বহুবিবাহ কখনইও সমাজে অনুমোদিত রীতি ছিল না। সমাজ যত বিকশিত হয়েছে ততই দেখা গেছে বহুবিবাহ মানে আসলে ক্ষমতার প্রয়োগ। আদিম সাম্যবাদী সমাজে Community System ছিল বিবাহপ্রথা। এল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশের হাত ধরে তাই দু’জন বউ মানে সম্পত্তির ভাগভাগি!

জয়ন্ত: রমেশচন্দ্র বাম প্রতাপজি দাগা বনাম রামেশ্বরী রমেশচন্দ্র দাগা মামলায় ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছিল? বলেছিল, বহু বিবাহ বেআইনি, কিন্তু এটা অনৈতিক বলা যাবে না। কারণ স্ত্রীদের সে ক্ষেত্রে কোনও আপত্তি নেই ! এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি।

প্লেটো: জাজমেন্টটা কী ছিল?

কৌটিল্য: সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে দেখো, গুগল সার্চ করো। আদালত বলছে, ‘a bigamons marriage may be declaimed legal being in Contravention of the provisions of the hindu marriage act but it cannot be said immoral so as to deny even in the sgah of alimony or mainten a to a spouse financially weak and economically dependent.’ বাদশা বনাম মৌ উমিলা গোডসে মামলাতেও সেই একই বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এক জন স্ত্রীর ভরণপোষণ বা তার আর্থিক দায়িত্বের প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে থেকে গেছে।

জয়ন্ত: আসলে সমস্যাটা কী হচ্ছে জানেন স্যার! আসলে মূল সমস্যা হল রাজনীতি। সমাজ নয়, রাজনীতি। ভোট আমাদের কাছে আজ মস্ত বড় হচ্ছে। আর ভোটে জেতার জন্য হয় তুমি মুসলিম দরদী, না হলে তুমি মুসলিম বিরোধী। এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি। তাই তো প্লেটোবাবুকে জিজ্ঞাসা, আজ তা হলে সবই ক্ষণকালের ভোটের স্রোতে...?

প্লেটো: গণতন্ত্র মানে কিন্তু যেন তেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা আর নিজের কৃতকর্মকেই সঠিক বলে নার্সিসাসের মতো ‘ইকোর’ প্রেম তার মতামতকে অগ্রাহ্য করা নয়। আমি তো Republic-এ বলেছিলাম রাজা যদি তার নিজের শাসনেরই প্রেমে পড়ে যান তবে সে এক বড় বিপদ! না, সন্ধ্যা হয়ে গেল, এ বার তো তোমরা বিদায় দাও। ওকে স্যার গুড ইভনিং। গুট নাইট।

তবে শাহি সমাচারে আমরা মনে করছি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ভারতে হওয়া উচিত, তাতে ভারতের রাষ্ট্রধর্ম আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু হিন্দু–মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি পরিত্যাজ্য। ধীরে ধীরে সমাজের চলতি ধ্যানধারণা বদলাতে হবে। এ জন্য শুধু রাজনীতিকরাই নন, চাই সমাজ সংস্কারকদের সক্রিয় সহযোগিতা। আগামী বুধবার প্লেটো-কৌটিল্যকে আবার আমন্ত্রণ জানাব, চেষ্টা করব যাতে আবার নিয়ে আসতে পারি ওঁদের আপনাদের সামনে। তবে এ বার বিষয় হবে আলাদা। হয়তো কাশ্মীর এবং পাকিস্তান। আপনাদের জানাব।

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE