Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

গরিবের জন্য সরকারি কান্না অথবা ডিজিটাল ইন্ডিয়া

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালনরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আবার আর একটা বাজেট অধিবেশন। আবার সরগরম সংসদ। জানুয়ারি মাসের শেষ দিন, ৩১শে জানুয়ারি। সকাল দশটা থেকে সংসদে জনসমাগম। সেন্ট্রাল হল পরিপূর্ণ সাংসদদের ভিড়ে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রওনা দিয়েছেন তাঁর জুড়িগাড়িতে। বলিষ্ঠ দু’টি ঘোড়া তাঁকে নিয়ে আসছে ধীর গতিতে। লাল পোশাক পরিহিত ঘোড়সওয়ার সামনে পিছনে। স্পিকার সুমিত্রা মহাজন, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান, উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, সংসদীয় মন্ত্রী অনন্ত কুমার, সর্বোপরি দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদ ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রতীক্ষারত।

সেন্ট্রাল হলে শুরু হল রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা। আনুষ্ঠানিক ভাবে এটাই রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর শেষ বক্তৃতা। জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে। অনেক পাঠক আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, রাষ্ট্রপতির এই বক্তৃতা কি রাষ্ট্রপতিরই অভিমত? ভারতীয় সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির এই ভাষণটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। ক্যাবিনেট সচিবের কাছে বিভিন্ন মন্ত্রী তাঁর দফতরের এক বছরের কাজকর্ম সম্পর্কে লিখিত নোট পাঠান। তার ভিত্তিতে ক্যাবিনেট সচিব রাষ্ট্রপতির বক্তৃতাটি তৈরি করেন। সেই খসড়া বক্তৃতা এর পর প্রধানমন্ত্রী পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় এটি চূড়ান্ত করে। এর পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি পেশ হয়। রাজ্যস্তরেও বাজেট অধিবেশনের প্রাক্কালে রাজ্যপালের বক্তৃতা একই পদ্ধতিতে পেশ হয়। রাজ্যস্তরে অবশ্য অনেক সময় রাজ্যপাল তাঁর নিজস্ব আপত্তি থাকলে মন্ত্রিসভার কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য তা ফেরত পাঠান। মন্ত্রিসভা সদয় হলে সেই বক্তৃতা পুনর্বিবেচনার জন্য অনুমোদন করতে পারে অথবা ফেরত পাঠাতে পারে। এক বার ফেরত পাঠানোর পর রাজ্যপালকে সেই বক্তৃতাই মেনে নিতে হয়।

দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে বাজেট অধিবেশনে ফেরত পাঠানোর নজির অনেক কম। শেষ রাষ্ট্রপতি যিনি সরকারকে এ ব্যাপারে বেগ দিয়েছিলেন তাঁর নাম জ্ঞানী জৈল সিংহ। কিন্তু প্রণববাবুর রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বই হল সংবিধান মেনে চলা। দেশে বা বিদেশে ভ্রমণের সময়েও প্রণববাবুর অ্যাটাচিতে একটি পকেট সংবিধান থাকে। গত সাড়ে চার বছর ধরে বিভিন্ন ঘরোয়া আলোচনায় তিনি বহু নেতাকে বলেছেন, ‘‘ফেরত পাঠিয়ে করব কী? শেষ পর্যন্ত তো আমি মানতে বাধ্য ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত।’’ ব্রিটেনের রানির মতোই তিনি হলেন আমাদের সংবিধানের ‘জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল (titular head)।’ প্রণববাবু তাই কোনও দিনই এ সব নিয়ে নাটুকেপনা করেননি সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে। সংবিধান মেনে তিনি তাঁর বক্তৃতায় আজও বার বার বলেন, ‘আমার সরকার’। নরেন্দ্র মোদীর সরকার কি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সরকার? যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভা ‘ফোর্সড অ্যামং ইকুয়ালস’। তাঁর পাঠানো সরকারের বক্তব্য পড়ছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি ক, খ, গ। আজ প্রণব মুখোপাধ্যায়।

লোকসভায় বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

এই বক্তৃতাটা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, প্রতিটা অনুচ্ছেদে সরকার গরিব মানুষের জন্য তার প্রাণ কত কাঁদছে, সেটাই জানিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আবাসন সবই যেন এ দেশের গরিব মানুষের স্বার্থে। ইন্দিরা গাঁধী অতীতে গরিবি হঠাও-এর ডাক দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেছিলেন। সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে বাদ দিয়েছিলেন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতন্ত্র শব্দটিকে যোগ দিয়েছিলেন। আজ আবার রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সেই সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি। ইন্দিরা গাঁধীর সেই স্লোগানের পরে বহু বছর অতিবাহিত। প্রণববাবু সে দিন ছিলেন ইন্দিরার অর্থমন্ত্রী। আজ তিনি রাষ্ট্রপতি। কিন্তু মোদী আর অরুণ জেটলির বাজেটেও ফিরে আসছে সেই সমাজতন্ত্রের প্রতিধ্বনি। আরও একধাপ এগিয়ে তাঁরা বলছেন, ‘গরিবি হঠাও নয়, কার্যত বড়লোক খেদাও’ কর্মসূচি যেন নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত সমাজের শ্রেণিবৈষম্য ঘুচিয়ে দেবে। বড়লোক আর এই সমাজে থাকবে না। ভারত রাষ্ট্রেও তৈরি হবে প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র। সমস্যা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী যদি গরিব মানুষেরই স্বার্থরক্ষার জন্য বলিপ্রদত্ত হন তা হলে ভাইব্রান্ট গুজরাতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুকেশ অম্বানি থেকে আদানি সবাই নোটবাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ধন্যি ধন্যি করছেন কেন? তবে কি ভারতের শিল্পপতিরাও সকলে সমাজতন্ত্রী হয়ে গিয়েছেন? শ্রেণি বৈষম্য বলে তা হলে কি কিছুই নেই? নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়! শ্রেণি সংগ্রাম নয় আসলে মোদী কি শ্রেণি সমন্বয়ের দিশারী? গাঁধীজি ধনী-দরিদ্রকে মেলাতে চেয়েছিলেন। ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ এই গাঁধীবাদী শ্রেণি সমন্বয়ের তত্ত্বকে খারিজ করেছিলেন। আজ এই আধুনিক যুগে অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদ যিনি মনে করেন দারিদ্র, অসাম্য দূর না হলে ভর্তুকি দিয়েও সমস্যার সমাধান হয় না।

টেলিভিশনের পর্দায় সবাই দেখছেন রাষ্ট্রপতি একনাগাড়ে ভারত সরকারের স্তুতি করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব হল, ইন্দিরা গাঁধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, প্রণববাবু অর্থমন্ত্রী হয়ে এক বার নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা তাঁকে বারণ করেন। ইন্দিরা বলেছিলেন, ভারতের মতো বৃহৎ বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে এটা করা যায় না। সংবিধানের এ এক অদ্ভুত পরিহাস। সেই প্রণববাবুকে আজ নোটবাতিলের সিদ্ধান্তের জয়ধ্বনি করে বলতে হল, ‘আমার সরকার এ এক মহান কাজ করেছে।’

লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ভারতে তিনি আর্থিক সংস্কারের রথ চালাবেন। আর্থিক বৃদ্ধি, আর্থিক সংস্কার, শিল্পায়ন ও বিকাশ হলে দেশের উন্নতি হবে, সেই পথেই কর্মসংস্থান হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে। আর আড়াই বছর ধরে কী দেখছি? মুখে দারিদ্র দূরীকরণের স্লোগান, আমজনতার জন্য কান্না আর অন্য দিকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া গঠনের স্লোগান। যেখানে কর্মী ছাঁটাই অনিবার্য। যন্ত্র এবং রোবট প্রযুক্তি এক বড় পরিসর দখল করেছে। তবে কি ভারত গরিবের জন্য চোখের জল ফেললে আসলে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র তকমা মুছে ফেলবে? এ এক বিচিত্র স্ববিরোধ। আর যিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মিশ্র অর্থনীতির ‘মঝজিম পথ’ মেনে চলেছেন সেই প্রণব মুখোপাধ্যায় সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হিসেবে সরকারের দ্বিচারিতাকে ‘আমার সরকারের কৃতিত্ব’ বলে বক্তৃতা দিতে বাধ্য হলেন।

শেষ পাতে, চুপিচুপি একটা কথা বলি। সেন্ট্রাল হলের দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে প্রণববাবুকে আমি একবারও হাসতে দেখিনি।

(এখন থেকে ‘শাহি সমাচার’ বুধবারের পরিবর্তে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE