Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
শাহি সমাচার

সাংবাদিকের সামাজিক দায়িত্ব ও কাঙাল হরিনাথ

উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা আবার বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালউনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা আবার বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

সাংবাদিকতা নিয়ে গোটা দেশ জুড়েই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সাংবাদিকের পেশাদারি কর্তব্য এবং জাতীয়তাবাদী দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় সাংবাদিকের ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ, কতটা কায়েমি স্বার্থ পরিচালিত এ সব নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার পেশাদারি সাংবাদিকতার চলও এখন গোটা দেশে বেড়েছে। সাংবাদিকরা রাজ্যে রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছেন। এমনকী, রাষ্ট্র শুধু প্রবীণ নয়, বয়সে নবীন সাংবাদিকদেরও পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ খেতাব দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে।
এই রকম একটা সময়ে আজ শাহি দরবারে আমি আপনাদের এমন এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় করাতে চাই যিনি ভারতের গ্রামীণ সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত প্রথম সফল কাণ্ডারী। মানুষটি প্রয়াত হয়েছিলেন ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৯ শতকী বাংলার পীত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সত্য এবং তথ্য-ঋদ্ধ সাহসী গ্রামীণ সাংবাদিকতার আদি ও প্রবাদ পুরুষটিকে আমরা এই প্রজন্ম অনেকেই জানি না। মানুষটির নাম কাঙাল হরিনাথ। আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল সে সময় ভারতের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের কণ্ঠস্বর। এহেন হরিনাথ তৎকালীন বাংলার জাগ্রত বিবেক বিস্মৃতির অন্ধকারে। হরিনাথ জন্মেছিলেন পাবনা জেলার কুমারখালি গ্রামে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অন্তভুর্ক্ত ছিল এই কুমারখালি। খুব গরিব মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া শিখেছিলেন খুব কষ্ট করে। বাবার কাছ থেকে কোনও সম্পত্তি পাননি। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার মশাই কিছু দিন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এতটাই দরিদ্র

ছিলেন যে পরনের বস্ত্র পর্যন্ত থাকত না। কোনও এক ধনী ব্যক্তির বই এক রাতে নকল করে দিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি একটি বস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। কুমারখালিতে অনেক নীলকুঠি ছিল। কিছু দিন নীলকর সাহেবের কাছে কাজ করেছিলেন। কিন্তু নীল চাষিদের উপর অত্যাচার দেখে সেটাও ছেড়ে দেন। চাকরি ছাড়ার পর মনোযোগ দিয়ে গ্রামীণ সাংবাদিকতা শুরু করেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই করে গিয়েছেন। তবে স্ত্রী-শিক্ষার জন্য তিনি একটি পৃথক সংগঠন তৈরি করেছিলেন।

তাঁর সংবাদপত্রে তিনি এক দিকে যেমন মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের দাবি দিনের পর দিন তুলেছেন, অন্য দিকে জমিদার, নীলকর, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচারের বাড়াবাড়ির কাহিনি সাহসের সঙ্গে তাঁর সংবাদপত্রে প্রচার করে গিয়েছেন। তাঁর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ গৃহে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্বয়ং হরিনাথ আবার শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার ও নিপীড়নের সাক্ষী ছিলেন। তাঁর সংবাদপত্রে তিনি দ্বিধাহীনতার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির প্রজাবিরোধী অত্যাচারী ভূমিকার তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকী, কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন, ‘‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষি হওয়ার পূর্বে প্রজাদের দুঃখ নিবেদনের সংবাদ তাঁর কিছুটা কর্ণগোচর হলেও মহর্ষি হওয়ার পর প্রজার হাহাকার তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায়নি।’’

হরিনাথের অভিযোগ বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। যাকে আমরা সাংবাদিকরা বলি ‘ক্রস-চেক’। লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহের বিরুদ্ধে মত দিয়ে সেটি নিষিদ্ধ করেছিলেন ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। রামমোহন ১৮৩০ সালের ১৬ জানুয়ারি অর্থাৎ ৪৩ দিন পর অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বেন্টিঙ্ককে। ঠিক তার এক দিন পরে, ১৭ জানুয়ারি ধর্মসভা গঠিত হয় এর প্রতিবাদে। এর পর রামমোহন বিলেত চলে যান। ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব দিয়ে যান ঠাকুরবাড়ির কাছে। ইংল্যান্ডেই রামমোহনের মৃত্যু হয়। মজার ব্যাপার, কাঙাল হরিনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন না বটে, কোনওদিন লন্ডন যাওয়াও তাঁর হয়নি। কিন্তু তাঁর গ্রামীণ সংবাদপত্রে সতীদাহর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। হরিনাথ গান লিখতেন। তাঁর একটি জনপ্রিয় গান হল, ‘ওহে, দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে’।

২০১৬ সালে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা বিজয়পতাকা ওড়াচ্ছে, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক থেকে ডিজিটাল মিডিয়া, তখনও কিন্তু এ দেশের গ্রামে গ্রামে বহু নাম না জানা সাংবাদিক আজও সাধ্যমতো গ্রামীণ সাংবাদিকতা করে চলেছেন। আজ এত বছর পরে উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা আবার বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেছিলেন, কাঙাল হরিনাথের নাম নব্য বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। দেশ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র সেন বলেছিলেন, কাঙালের গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা থেকে আমি আমার সাংবাদিক জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকি।

দুর্ভাগ্য আমাদের, এর পরেও হরিনাথকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনা তেমন কোনও চেষ্টা আজ দেখি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE