ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরের এক সুখী দম্পতির গল্প আজ শোনাব আপনাদের। মাইকেল বিগ্স জন্মসূত্রে জামাইকার কালো মানুষ। আর তাঁর স্ত্রী অ্যামান্ডা ওয়াঙ্কলিন ব্রিটিশ। প্রেমজ বিবাহ। তার পর তাঁদের দুই যমজ কন্যা। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, জন্ম থেকেই একটি মেয়ে ধবধবে ফর্সা। তার বাদামি চুল। অন্য মেয়েটি কৃষ্ণবর্ণা, মাথায় কোঁকড়ানো কালো চুল। অ্যামান্ডা যখনই প্র্যামে ওদের বসিয়ে পাড়ার বাজারে যেতেন, সব্বাই জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার মেয়ের সঙ্গে অন্যটি কে? পালিতা? মায়ের জবাব ছিল, এ সবই জিনের কারসাজি। বয়স যত বাড়ল, একটি মেয়ে একদম বাবার মতো দেখতে হল, অন্যটি হল মাতৃসমা। এ বার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের প্রথম ইহুদি মহিলা প্রধান সম্পাদক সুজান গোল্ডবার্গ এই সাদা-কালো যমজ সন্তানের কাহিনির পিছনে দৌড়ে গেলেন। তাঁর বিশেষ সংখ্যার বিষয় হল, এই ‘রেস’ বা জাতি এখন জীববিদ্যার বিষয় নয়, এটি সামাজিক বিষয়।
ওবামার পর ট্রাম্পের পাল্টা আখ্যান দেখে বোঝা যায়, এখনও বর্ণবিদ্বেষের মেরুকরণ জীবিত। এক বিচ্যুত দক্ষিণপন্থী আধুনিকতার ছদ্মবেশে তা গোটা বিশ্বেই দেখছি। আর আমাদের ভারতে লোকসভা ভোট যখন জাগ্রত দ্বারে, তখন প্রশ্ন উঠেছে, বাবা সাহেব অম্বেডকর তুমি কার? নীল কোট পরা অম্বেডকর ডান হাতের তর্জনী তুলে কী বলতে চান, সেটা বোঝার চেষ্টা না করেই দেশটা গৈরিক রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পর দিন বহুজন সমাজ বাহিনী আবার তাঁকে নীলিমায় নীল করে দিয়ে এসেছে। বল্গাহীন বর্ণহিন্দু ভৈরব বাহিনী অন্যতম সংবিধান প্রণেতার মূর্তি ভেঙে দিচ্ছে। বেচারা যোগী আদিত্যনাথ! লৌহ পিঞ্জরে অম্বেডকরকে বন্দি করে তাঁকে ভিভিআইপি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিচ্ছেন।
পাশ্চাত্যের সাদা-কালো জাতি-বর্ণবিবাদের চেয়ে এ দেশে দলিত পরিচয়ের রাজনীতি আরও জটিল কেন হয়ে গিয়েছে জানেন? কারণ, ভারতে তো শুধু বর্ণাশ্রম অথবা জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্য নয়, এর মধ্যে মিলেমিশে গিয়েছে ধর্ম। বরং বৌদ্ধ, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম বর্ণহিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকে কুঠারাঘাত করেছিল, হিন্দুসমাজের অবক্ষয় আটকাতে মধ্য যুগে ভক্তি আন্দোলন, চৈতন্যদেবের বৈষ্ণববাদ থেকে কবীর-রবিদাস-অস্পৃশ্য নানা ধরনের দলিত, পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গ বাত্য হিন্দুসমাজকেও আত্তীকরণ করে নিয়েছিল। কিন্ত তাতে দলিতের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটা অসমাপ্ত থেকে যায়।
ইংরেজি শাসনের সময়েই হিন্দুসমাজের পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গীয় বর্ণ তথা জাতিসমূহকে এগিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। গোলটেবল বৈঠক থেকে পুণে চুক্তি— সে সব দূরের ইতিহাস। গাঁধীর হরিজন তত্ত্বকেও হজম করতে অসুবিধে ছিল অম্বেডকরের। তবে হালে, ১৯৭৮ সালের ২০ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বিন্ধেশ্বরীপ্রসাদ মণ্ডলের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্যের দ্বিতীয় কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই কমিশনই মণ্ডল কমিশন বলে পরিচিত। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়ে দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত মণ্ডল কমিশন রিপোর্টকে আবার আলমারি থেকে বার করে ধুলো ঝেড়ে বাজারে ছাড়লেন। ঝড় উঠল দেশ জুড়ে। মণ্ডলের বিরুদ্ধে আডবাণী নামলেন কমণ্ডল নিয়ে। দেখা গেল, মণ্ডল অস্ত্র দিয়ে যত না নিম্নবর্গের অভ্যুত্থান হল, তার চেয়ে বেশি হল হিন্দু অভ্যুত্থান। আর এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আডবাণী বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের হিন্দুত্বকে উচ্চবর্ণের কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। ভুললে চলবে না, সিন্ধ্রি আডবাণী ব্রাহ্মণ ছিলেন না। আবার মোদীও অব্রাহ্মণ এবিসি। আডবাণীর বিরুদ্ধে বঙ্গারু লক্ষণকে সভাপতি করা থেকে মোদীর কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করা একই সুতোয় বাঁধা। ২০১৪ সালের ভোটে এই মেরুকরণের পূর্ণ ফায়দা পেয়েছেন মোদী। অমিত শাহ দলিত কর্মীর বাড়িতে গিয়ে ভোজন সারছেন। অম্বেডকরের নামে মোদী মূর্তি, বাড়ি, রাস্তা, মিউজিয়ম— একের পর এক নির্মাণ করে চলেছেন। তবু কেন শেষরক্ষা হচ্ছে না? তবু কেন গোটা দেশ জুড়ে এ হেন দলিত অভ্যুত্থান।
যত দিন যাচ্ছে ক্রমশ মনে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে নির্মিত এক অচ্ছে দিনের অবভাস শেষ সত্য হতে পারে না। এই মলমটি ব্যবহার করলে টাকে চুল গজাবে বলে ব্যান্ডেল লোকালে দশ দিন কোনও পণ্য চুটিয়ে বিক্রি করার পর যখন দেখা যাবে, টাকে একটি চুলও গজাল না, তখন আমার কী হবে? প্রহারেণ ধনঞ্জয় হওয়ার গণ-উন্মাদনার ভয়ে কেটে পড়ি, ভেগে পড়ি বলে রাজনীতিতে চলে আসতে হবে! ও সব পোস্ট-ট্রুথ, পোস্ট-ফ্যাক্টরেরও সীমিত আয়ুকাল আছে, সভ্যতার পিলসুজে মর্যাদাকে যাঁরা অবজ্ঞা করেছেন, ইতিহাস কিন্তু বার বার তাঁদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে।
মেনে নিলাম, কংগ্রেস জমানায় দলিতদের জন্য কিছুই হয়নি। কিন্তু গত চার বছরে মোদী সরকারের রিপোর্ট কার্ড কী বলছে?
এ দেশে এখন দলিতদের সংখ্যা ৩০০ মিলিয়নের উপর। প্রতি ১৮ মিনিট অন্তর এক জন দলিতের উপর অত্যাচার হয়। গড়ে প্রতি দিন তিন জন করে দলিত কন্যা ধর্ষিতা হন। শতকরা ৩৭ ভাগ দলিত দারিদ্র সীমারেখার নীচে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট। মোদী ক্ষমতায় আসার চার বছর পরও অপরিবর্তিত। তাই শুধু পুজোর ছলে ভুলে থাকা? বাস্তবের জমিতে কী হয়েছে?
প্রাক-আর্য সভ্যতার বনবাসী অনার্য-অস্পৃশ্য-আদিবাসী-দলিত জনসমাজকে পরবর্তী আর্য হিন্দুসমাজ আত্তীকরণ করলেও হতদরিদ্র দলিত, দলিতই থেকে গিয়েছে। মায়াবতী একদা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছিলেন, দলিত সমাজের আর্থিক উন্নয়ন হল কই? তাই সংস্কৃতায়ন হিন্দুধর্মের অবক্ষয় আটকালেও দলিত কণ্ঠস্বর আজও পূর্ণ প্রকাশিত হয়নি। অসবর্ণের সাবর্ণায়ন হয়নি। এমনই হয়। সর্বহারা শ্রেণির যাঁরা নেতৃত্ব দেন, সেই মধ্যবিত্ত গাইডই বুর্জোয়া হয়ে যায়। আর তাই দেখুন, রাজ্যে রাজ্যে চন্দ্রশেখর আজাদ, জিগ্নেশ মেবাণী, কানহাইয়া, হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলার মতো নবীন নেতাদের জন্ম হচ্ছে। গোটা দেশ জুড়ে দলিতের আত্মপরিচয় নির্মাণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠছে।
জানেন, মনমোহন তখন প্রবীণ মন্ত্রী, মনে আছে, রাহুল গাঁধী তখন থেকেই প্রত্যন্ত গ্রামে নির্যাতিত দলিতদের বাড়ি চলে যেতেন। মাওবাদী এলাকায় বনবাসীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে পরিবেশরক্ষার কথা বলতেন। সে সময়ে রাহুলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। কত দিন আগের কথা, তখনই রাহুল স্বীকার করেছিলেন যে দলিতেরা নিজেরাই কোনও বড় রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই জাগছে। আমি ওদের ওপর দাদাগিরি করার পদ্ধতির ঘোরতর বিরুদ্ধে। তবে সত্য সত্যই ওদের পাশে থাকতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন প্রাথমিক কাজ।
জানি না, ২০১৯ সালের ভোটের রাজনীতি কী হবে। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে, ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন দলিত ভাষ্যের নির্মাণ হচ্ছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফ্রিকের পাতায় কলকাতার মার্টিন লুথার কিং সরণির ছবি ছাপা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে রাস্তাটার এই নাম হয়। আগে ছিল উড স্ট্রিট। ফুটপাতে ছাতুর সরবত বিক্রি হচ্ছে। পথচারী কেউ চেনে না মার্টিন লুথারকে? মোদী সরকার অম্বেডকরের নামে রাস্তার আর নামকরণ না করে দলিতদের জন্য সত্যিই কিছু করতে পারলে ভাল করত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy