Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

উচ্চবিত্তের বৃত্তে প্রবেশ করে অভিজাত দলিতও কি বিচ্ছিন্ন হন না?

দলিত প্রার্থী করা হলে যদি এই সমাজের অগ্রসরতা নিশ্চিত হত তবে নারায়ণনকে রাষ্ট্রপতি করার পর দলিত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।দলিত প্রার্থী করা হলে যদি এই সমাজের অগ্রসরতা নিশ্চিত হত তবে নারায়ণনকে রাষ্ট্রপতি করার পর দলিত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।

মীরা কুমার এবং‌ রামনাথ কোবিন্দ। ছবি: এএফপি।

মীরা কুমার এবং‌ রামনাথ কোবিন্দ। ছবি: এএফপি।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বিজেপি রাষ্ট্রপতি পদে এ বার দলিত প্রার্থী মনোনয়ন করেছে। তাই কংগ্রেসও বাবু জগজীবন রামের কন্যা মীরা কুমারকে প্রার্থী করেছে। অতএব, রামনাথ কোবিন্দ আমার দলিত, মীরা কুমার তোমার দলিত। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা কর্নাটকের আসন্ন বিধানসভা ভোটের জন্য সক্রিয়। তিনি এখন দলিত পরিবারে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করছেন। আর ওবিসি, মানে নিম্নবর্গের কারও বাড়িতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারছেন। এটাই এখন ইয়েদুরাপ্পার ভোট রেসিপি। বেশ। কিছু দিন আগে অভিযোগ উঠেছিল, দলিত পরিবারে গেলেও তিনি নিজের খাবার বাড়ি থেকে লাঞ্চ বক্সে করে নিয়ে এসেছিলেন। এখন সেই বদনাম ঘোচাতেও মরিয়া তিনি। ইয়েদুরাপ্পা বলেছেন, দলিত (কোবিন্দ) রাষ্ট্রপতি প্রার্থী আর ওবিসি (নরেন্দ্র মোদী) প্রধানমন্ত্রী— এ একমাত্র বিজেপির নেতৃত্বেই সম্ভব।

একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। লখনউ শহরে মায়াবতীর জন্মদিন পালন হচ্ছে। জন্মদিনে কালো মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িতে বসছেন তিনি। দলিত সমাজ চাঁদা তুলে দলিতকন্যাকে এই গাড়িটি উপহার দিয়েছেন। বহুজন সমাজ পার্টি জন্মদিন উপলক্ষে দলিতদের কাছ থেকে অর্থ সঞ্চয় করে। এ ঘোষণা করা হয়েছিল প্রকাশ্যে। মায়াবতীর সে জন্মদিনের উৎসব ছিল এক রাজসূয় যজ্ঞ। বিশাল এক কেক কাটা হল। কোটি কোটি টাকা খরচ হল। দলিত সমাজ যারপরনাই আহ্লাদিত। মায়াবতীর মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়ি প্রাপ্তিকে তারা দলিত সমাজের ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখেছিল। এ এক অসাধারণ সামাজিক মনস্তত্ত্ব। মনে আছে, জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে আশিস নন্দীর এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঝড় ওঠে। তিনি বলেন, দুর্নীতিকে বহু ক্ষেত্রে ভারতীয় দলিত সমাজ মনে করে, সেটি তাদের ক্ষমতায়নের এক মোক্ষম অস্ত্র।

আমার মনে হয়, এ হল মৃতের শরীরে আতর ছেটানো। দেওয়ালে ঘুণ ধরা। আর্থ-সামাজিক কাঠামো বদলাচ্ছে না। দলিত সমাজের দারিদ্র ঘুচছে না। তবু, ঘুণ ধরা সেই দেওয়ালে চুনকাম করছি। দলিত প্রার্থী করা হলে যদি দলিত সমাজের অগ্রসরতা নিশ্চিত হত তবে অতীতে নারায়ণনকে রাষ্ট্রপতি করার পর ভারতের দলিত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এই রাজনীতিকে আমরা সাঙ্কেতিক বা টোকেনিজম বলে থাকি। কিন্তু অনেক সময়েই মনে হয়, শূন্য কলসিতে শব্দ বেশি হয়। প্রভুরা যখন আন্তরিক, তখন এত ঘটা করে দলিতদের জন্য অশ্রুপাত করতে হত না। রোদনভরা এই রাজনীতির দাওয়াই ভোটে বেশ কিছু মানুষকে প্রভাবিত করতেই পারে, কিন্তু এই রাজনীতি মূল সমস্যার সমাধান নয়।

জনসভায় উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী।ফাইল চিত্র।

আমার সঙ্গে চলুন একটু অতীত দিনে যাই। দলিত রাজনীতির জন্মলগ্নে। ১৯৫৬ সালে বাবাসাহেব অম্বেডকর মারা যান। তার ঠিক পরের বছর রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়া-য় (আরপিআই) প্রথম ভাঙন হয়। বি সি কাম্বলে বলেন, তাঁদের ভাগটাই আসল আরপিআই। দুবুস্ত (সঠিক) আরপিআই। অন্য ভাগটি না দুবুস্ত (বেঠিক)। পার্টিটা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বিভাজন, কারণ আরপিআইয়ের জন্ম হয় ১৯৫৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।

বি সি কাম্বলে গোষ্ঠী বলে, দলকে লড়াই লড়তে হবে সাংবিধানিক পথে। কারণ অম্বেডকর নিজে সংবিধানের জন্ম দিয়েছেন। আর এই দল কমিউনিস্ট প্রভাবে বৈপ্লবিক রাস্তায় এগোবে, তা হতে পারে না। আবার দাদাসাহেব গায়কোয়াড় অন্য গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, দলিতদের জীবনের বস্তুগত সমস্যা, দারিদ্র, বেকারি, শ্রেণিশোষণ— এ সবের প্রতিবাদে লড়তে হবে। তা না হলে দলিতদের জন্য রোদন সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বাধা দূর করে মূল সমস্যার সমাধান করবে না। অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য আন্দোলন ভাল, কিন্তু শুধু এই সামাজিক বাধা, এই ‘মাইন্ডসেট’ ভাঙলে হবে না। দীর্ঘ দিনের নিপীড়িত দলিতদের জন্য আর্থিক বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে বইকি। সেই বিতর্ক আজও চলছে, বহুজন সমাজ পার্টি গঠনের ৩৩ বছর পরেও। অম্বেডকর তাঁর নানা রচনার মধ্য দিয়ে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন যে তিনি মার্কসবাদ বিরোধী। ১৯৮৪ সালে কাঁসিরাম বহুজন সমাজ পার্টি গঠন করেন। অম্বেডকর বৌদ্ধ হয়ে যান। সম্ভবত, হিন্দুধর্মের তৎকালীন প্রবল ব্রাহ্মণতন্ত্রের প্রতিবাদে। দলিত সত্ত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দলিত, হিন্দু নয়, এমন একটা দর্শন জনপ্রিয় হয়ে যায়। বহু দলিত সে সময়ে নানা রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হয়ে যান। কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক রাহুল সাংকৃত্যায়ন এমনই এক কমিউনিস্ট-বৌদ্ধ চরিত্র ছিলেন। আসলে অম্বেডকরের মনে হত, ভারতে কমিউনিস্ট নেতৃত্বও মনুবাদী।

১৯২৭ সালে ভারতের কমিউনিস্টদের সঙ্গে অম্বেডকরের বিবাদ শুরু হয়। কারণ, এই সময়ে ‘মাহাড সংগ্রাম’ শুরু হয়। মাহাড মহারাষ্ট্রে এক দলিত সম্প্রদায়। মুম্বই শহরে ও তার আশেপাশে নাগরিক অধিকারের লড়াই। দলিতরা এই আন্দোলনে সংগঠিত হয়। ১৯২৮ সালে কমিউনিস্টদের টেক্সটাইলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ধর্মঘট শুরু করে। তখন তারা অম্বেডকরের কাছ থেকে সমর্থন চায়। অম্বেডকর বলেন, মিলগুলিতে দলিতদের অন্যত্র আলাদা জল খাওয়ার ব্যবস্থা। অস্পৃশ্যতার জন্য মিলের বেশ কিছু এলাকায় তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কমিউনিস্টরা আন্দোলনে আর্থিক দাবিদাওয়ার পাশাপাশি এই অস্পৃশ্যতার বিষয়টিকে যুক্ত করতে রাজি হননি। তখন অম্বেডকর বলেন, তা হলে দলিত শ্রমিকরা ধর্মঘট ভাঙবে। তখন কমিউনিস্ট নেতারা নড়েচড়ে বসেন। সাইমন কমিশনের সামনেও অম্বেডকর এই ঘটনাটির উল্লেখ করেন। আসলে কমিউনিস্ট এস এ ডাঙ্গের সঙ্গে অম্বেডকরের বিরোধ হয়। এক মার্কিন সাংবাদিক সেলিগ এস হ্যারিসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অম্বেডকর বলেন, ‘‘১৯৫৩ সালে (২১/২৮ ফেব্রুয়ারি) ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, এটি ব্রাহ্মণ নেতাদের হাতে। ডাঙ্গে ও অন্যান্য।’’ সোভিয়েত বিপ্লব নিয়ে তাঁর সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল স্থানীয় নেতাদের নিয়ে।

আসলে আজও এই দলিত সমস্যার প্রশ্নটি রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি আনন্দ তেলতুম্বড়ে-র লেখা ‘বি আর অম্বেডকর/ইন্ডিয়া অ্যান্ড কমিউনিজম’ গ্রন্থে লেখক বলেছেন, বাবাসাহেব ছিলেন এক ‘Unmarxist Marxist’।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে দলিত তাস খেলাটা আজ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, এখন বিজেপিও দলিত সমাজকে হিন্দুত্বর ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছে। বিজেপি মনে করছে, দলিত সমাজ অনগ্রসর হলে তো এই ভোটব্যাঙ্ক অন্য দলের কাছে যাবে। মায়াবতী দলিত নেত্রী হয়েও একদা উচ্চবর্ণের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বহুজন সমাজের ভোটব্যাঙ্ককে প্রসারিত করেন। সে ছিল এক দারুণ নির্বাচনী জাতপাতের ইঞ্জিনিয়ারিং। আসলে মার্কসবাদী হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে এক জন দলিত নেতারও উর্ধ্বমুখী সামাজিক সচলতা হতে পারে এবং তিনি যখন উচ্চবিত্তের বৃত্তে প্রবেশ করেন, অভিজাত দলিতে পরিণত হন তখন কি তিনি দলিত গ্রামীণ মানুষের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান না? ভারতে নিম্নবর্গেরও রাজতন্ত্রের ইতিহাস আছে। সেই রাজা সর্দার হয়ে প্রজাদরদী না হয়ে প্রজাদের শোষণ করেছেন, এমন বহু দৃষ্টান্ত উপজাতি সমাজের রাজতন্ত্রের ইতিহাসেও আছে।

প্রকাশ অম্বেডকর, বি আর অম্বেডকরের নাতি হলেও অনেকে বলেছিলেন তিনি নিজেই অম্বেডকর বিরোধী। কারণ তিনি মাওবাদীদের মতো বিপ্লবের কথা বলছেন। একদা এমন অভিযোগ মায়াবতীও করেন। আসলে এ হল দলিত ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। প্রকাশ অম্বেডকর বিজেপি বা কংগ্রেস, কোনও পক্ষেই না এগিয়ে প্রথমে একা এগোতে চান। কিন্তু তিনি সফল হননি। প্রতিযোগিতায় পরাস্ত হন। তাই আজ মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দলিত ব্যক্তিকে ঘোষণা করে আবার বিজেপি অপটিকসের রাজনীতি করছে। ভোটের রাজনীতিতে পরাস্ত করতে চাইছে অন্যদের। ভোটে কেউ জিতবেন, কেউ হারবেন। কিন্তু এই চমক দিয়ে দেশের দলিত সমাজের সমস্যা মিটবে, ঘরপোড়া গরু তো, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE