পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আনুষ্ঠানিক ভাবে পলিটব্যুরোর ভাষায় জোট না হলেও বাস্তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করার জন্য কংগ্রেস এবং সিপিএমের জোট গঠন হয়েছে। এই জোট নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে সফল হবে কি হবে না সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু আজ শাহি দরবারে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠনকে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা করছি। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির বিকাশের ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, সিপিএমের পক্ষে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধা মতাদর্শগত দিক থেকে কত বড় একটি ঘটনা।
১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয় ভারতের বাইরে তাসখন্দে এবং ১৯২৫ সালে কানপুরের একটি সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম জন্ম নেয়। ১৯২০ না ১৯২৫ কোন বছরটিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা বর্ষ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হবে তা নিয়েও কমিউনিস্ট মহলে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এককথায় বলা যায়, বিশের দশকে এক দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আর অন্য দিকে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবে মার্কসবাদী মতাদর্শের প্রেরণা, এই দু’টি ঘটনাই ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। এটাও বলতেই হবে, মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বহু প্রধান কমিউনিস্ট নেতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তাড়াতে চাইলেও ভারতের জাতীয়তাবাদী শক্তি সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই নেতিবাচক। রাজনীতি-বিজ্ঞানী ও ভারতীয় মার্কসবাদী ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ শোভনলাল দত্তগুপ্ত বলেন, ১৯২০ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রথম মতটিই এ দেশে সাম্যবাদী আন্দোলনের দিকনির্দেশ করেছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে ১৯৩৫ থেকে ’৪৭, এই পর্বে দ্বিতীয় মতটি প্রাধান্য পায়। যেখানে বলা হয়, জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে হাত না মেলালে কমিউনিস্টদের পক্ষে একক ভাবে ব্রিটিশদের তাড়ানো অসম্ভব।
’৪৭ সালে নেহরু ক্ষমতায় আসার পর মার্কসবাদীরা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কংগ্রেসের বিরোধিতা তীব্র থেকে তীব্রতর করে। ১৯৬৪ সালে দল ভাগ হল, সে সময়ে রুশপন্থী সিপিআইয়ের সঙ্গে চিনপন্থী সিপিএমের সংঘাতের পৃষ্ঠভূমিতে আর একটি বিষয় ছিল, সেটি হল সিপিআই ছিল কংগ্রেসপন্থী, সিপিএম কংগ্রেস বিরোধী। আবার সোভিয়েত কর্তারাও ছিলেন জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ। কমিউনিস্ট পার্টি গোটা দেশে এ ভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল কেন, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। গরম হাওয়া ছবির রাজনৈতিক জাতীয় পটভূমি বদলে গেল কেন তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শোভনবাবুর একটা বক্তব্যকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করি। তা হল ’৬৪ সালের দলীয় ভাঙন না হলে আর নকশাল আন্দোলন না হলেই যে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে শক্তিশালী থাকত তা নয়, এই অবক্ষয়ের পিছনে শুধু দলীয় বিভাজন নয়, দলীয় মতাদর্শ ও অন্যান্য বহু ইস্যু আছে।
যেমন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাসিদ্ধ ব্যাকরণ বলে ‘শ্রেণি’ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব আর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি স্লোগানগুলির মাধ্যমে মূলত যে উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চাওয়া হয়, সেটি কী? সেটি হল শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের ধারণাকে অবলম্বন করে কংগ্রেস পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। সঙ্গে সঙ্গে একটি বিকল্প জনমুখী শ্রেণিবিন্যাসকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এগোতে এগোতে সিপিএম ধাক্কা খায় দু’টি দিক থেকে। একটি হল, শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতপাতকে দেখার ফলে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে দলীয় বৃদ্ধির সমস্যা। এমনকী, তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্টের শরিক হয়েও সিপিএমের জাতপাত সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যদের সঙ্গে ফারাক স্পষ্ট। আর অন্য সমস্যা হল, ’৯৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার ঘটনা। এর ফলে এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সিপিএম। ১৯৮৯ থেকে ’৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে এল সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। দ্বিতীয়ত, মার্কিনি দাপট বৃদ্ধি। কার্যত একরৈখিক বিশ্বের আবির্ভাবে আর দেশের ভিতর বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কংগ্রেসের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার খতম অভিযানের চেয়ে। এমনকী অ-বিজেপি এবং অ-কংগ্রেসি দলগুলিও কতটা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠল। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ল।
মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন পরমাণু চুক্তির বিরোধিতায় প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে সিপিএমের কট্টর অবস্থান আবার দলের পুরনো অবস্থানই মনে করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত ভাতিন্দা কংগ্রেসে নতুন প্রেক্ষিতে সিপিআইয়ের নীতিও নির্ধারিত হল যার আসল কথাটাই হয়েছিল কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নীতি পরিত্যাগ করে সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্যের মূল স্রোতে সামিল হওয়া। ডাঙ্গে এই মতকে মেনে নেননি। ফলে তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ’৮১ সালে তিনি কংগ্রেসপন্থী এআইসিপি গঠন করেন। সিপিএম জরুরি অবস্থায় সমালোচনা করে সিপিআইয়ের চেয়ে বেশি লাভবান হয়। কিন্তু কংগ্রেসের অধোগমনে যে পরিসর তৈরি হল তা দাখিল করতে লাগল বিজেপি।
১৯৮০ সালের ভোটে দুই কমিউনিস্ট পার্টির লোকসভায় আসনসংখ্যা ছিল ৪৭। যার মধ্যে সিপিআইয়ের ছিল ১০ আর সিপিএম ৩৭। ’৮৯ সালের ভোটে সব বামপন্থী দলের আসনের সংখ্যা ছিল ৫২। যার সিংহভাগ ছিল সিপিএম। কিন্তু জিতে আসা এই আসনগুলির সিংহভাগ ছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এ ছাড়া কেরল, ত্রিপুরা, বিহারের মতো রাজ্য থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আসনের ফলে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত আঞ্চলিক দলেই পরিণত হল।
এখন দলের মধ্যেই প্রশ্ন, ’৮৯ সালে কংগ্রেস বিরোধিতা করে বিজেপিকে পরোক্ষ ভাবে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বনাথপ্রতাপকে সমর্থন করাটা ঠিক কাজ হয়েছিল কি না। আজ মমতা ও মোদী বিরোধিতায় আওয়াজ তুলে সিপিএম আবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধছে। অনেকেই বলছেন, কংগ্রেসকে পাকাপাকি ভাবেই সমর্থন করা প্রয়োজন, তা না হলে আগামী দিনে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি আরও হবে। কংগ্রেসের অবক্ষয়ের পরিসর তৃতীয় ফ্রন্ট নয়, দখল করেছে বিজেপি। অতএব, সাধু সাবধান! জানি না, আগামী দিনে সিপিএম আবার পেন্ডুলামের মতো কংগ্রেস বিরোধিতার দিকেও যাবে কি না! এটুকু বলতে পারি রাজ্যে মমতা বিরোধিতার জন্য কংগ্রেস-বাম জোট দলীয় ইতিহাসে আবার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy