প্রতিশ্রুত ‘আচ্ছে দিন’ কোথায়?
অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, একটা দেশের টাকার দাম অন্য দেশের তুলনায় তখনই বাড়ে, যখন সে দেশের উৎপাদন অন্য দেশের তুলনায় বেশি বাড়ে। তবে উৎপাদন ছাড়া অন্য কারণেও টাকার দাম বাড়তে পারে। যেমন মুদ্রাস্ফীতির আপেক্ষিক হার, সম্পদ ইনপুট বৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রাকে আকৃষ্ট করা। এগুলিও কতটা হচ্ছে আর কতটা হচ্ছে না তার বিচারেও টাকার দামের বৃদ্ধি বা হ্রাস নিয়ন্ত্রিত হয়। বিদেশি পুঁজি আসা তো দূরের কথা, তা বাজার থেকে উঠে পালায়, যদি বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি হয় তবে টাকার দামও কমবে।
অতএব দেশের অর্থনীতিকে সুষ্ঠু ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেই প্রশাসন, যে প্রশাসন টাকার দামকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শুধু শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তানই নয়, অন্য এশীয় দেশগুলির টাকার দাম তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়া খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। চিনের কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সাপেক্ষেও ভারতের টাকার অবস্থা শোচনীয়। এক দশক আ়গে বাংলাদেশের এক টাকা শুধু ভারতীয় ৬৯ পয়সা পেত। এখন পায় ৮৬ পয়সা। ফিলিপিন্সের পেসো, মালয়েশিয়ার রিঙ্গিত, তাইল্যান্ডের বাহত, ভিয়েতনামের ডং, টাকা তার আপেক্ষিক মূল্যই হারাতে বসেছে। আর টাকার এই পতন শুরু হয়েছে ২০০৮ থেকে।
শক্তিশালী ডলারের পাশাপাশি চিন তার ইউনকে সবসময় ঝড়ঝঞ্ঝার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। এমনকি রিঙ্গিত বা পেসো টক্কর দিচ্ছে ইউরোর সঙ্গে সেখানে ভারতীয় টাকা তার প্রাসঙ্গিকতাই হারাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। চিন ছাড়া অন্য এশীয় দেশগুলির তুলনায় ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গতির হার বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন এমন হল? কেন এমন হচ্ছে?
ভারতের কৃষি উৎপাদন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং বা অন্যান্য উৎপাদনের ব্যবসা মার খেয়েছে, অথচ এই দু’টি ক্ষেত্রেই ভারতের বাণিজ্য সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধিও দেশের সার্বিক উৎপাদনে বিশেষ ভাবে প্রভাব ফেলে। ভারতের পুরো কর্মী সংখ্যা বা ওয়ার্ক ফোর্সের প্রায় অর্ধেক এখনও কৃষিক্ষেত্রেই যুক্ত। এ দিকে কৃষিক্ষেত্রে কাজ নেই। তাই কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মী সংখ্যাকে অন্য পেশায় আরও বেশি করে নিযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন হিরে কাটার কাজ বা কাপড়জামার ব্যবসায়। এ ক্ষেত্রে চিনকে দেখলে অবাক হতে হয়। এক দিকে ওরা গুণগত মানের কথা না ভেবে খেলনা আর কাপড়জামা তৈরি করে অন্য দেশে ব্যাপক ভাবে পাঠিয়েছে বা পাঠাচ্ছে আর রোবট তৈরির মতো বিশেষ কাজও করছে। কৃষিক্ষেত্রের বাইরে তাই শ্রমভিত্তিক কাজকর্ম এই দেশে বাড়াতে হবে। কৃষিক্ষেত্রের বাইরে কাজ তৈরি হলে যেমন নির্মাণ ব্যবস্থা বা পর্যটন পরিষেবা বৃদ্ধি, এই সব ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আর এই উৎপাদন বাড়লে টাকার দামও বাড়বে। দুঃখের কথা, গত সাড়ে পাঁচ বছরে এই উদ্যোগ, এই প্রচেষ্টা দেখতে পেলাম কই?
পেট্রল ও ডিজেলের দাম কেন্দ্র ঠিক এক বছর আগে এক বার কমিয়ে ছিল। প্রতি লিটারে দু’টাকা কমানো হয় সে বার। ২০১৭-র ৩ অক্টোবর, গাঁধী জয়ন্তীর পরের দিন আবার কম হল। এ বার লিটার প্রতি দেড় টাকা কম। উৎপাদন শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) কমানো মানে কী? সেটাও তো বুঝতে হবে আমাদের! এত দিন ধরে দেশের অর্থমন্ত্রী এই দাম কমানোর কাজটা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। প্রথমত, অর্থমন্ত্রী বার বার বলার চেষ্টা করেন, পেট্রলের দাম বাড়ছে আন্তর্জাতিক কারণে, আমাদের জন্য নয়। এই দাম কমানো মানে কল্যাণকামী প্রকল্পের রূপায়ণ ব্যাহত হবে। এখন সেই অর্থমন্ত্রীই বলছেন এই সামান্য এক্সাইজ ডিউটি কমানোয় দেশের অর্থনীতির উপর কোনও প্রভাব পড়বে না। দেশের আর্থিক ঘাটতির উপর এর প্রভাব শতকরা মাত্র ০.০৫ ভাগ। এর ফলে বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলিকে এখন ওই এক টাকার বোঝাটা নিতে হবে যা সংস্কারপন্থী উন্নতির পক্ষে নয়।
গত বছর গুজরাত নির্বাচনে এসে গিয়েছিল বলে শুল্ক কমাতে হয়েছিল। এ বারেও পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে, সর্বোপরি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা ভেবেই দাম কমানো। কিন্তু এর ফলে একটা কথা সরকার বাহাদুর স্বীকার করেনি যে পেট্রল ও ডিজেলের দামের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ না রাখার সরকারি সংস্কার নীতি নয়, আজও সরকারি নিয়ন্ত্রণের যুগই চলছে। এখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রেও ভারতের থেকে পেট্রল ও ডিজেলের দাম কম।
এই অবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া তার সুদের হার শতকরা ৬.৫ থেকে একচুলও কমালো না। গত ৫ অক্টোবর আরবিআইয়ের ছয় সদস্যের মনিটারি পলিসি কমিটি (এমপিসি) এই সিদ্ধান্ত নিল যে ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনই নাকি সুদের হার কমানোর বিপক্ষে ছিল। আরবিআই টাকার দাম বাড়ানোর চেষ্টায় ব্রতী না হয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে মন দিয়েছে। তাদের মনে হচ্ছে, সুদের হারের অপরিবর্তনশীলতা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। তাই উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে তেলের দাম কমানো স্বল্পমেয়াদি ‘পপুলিজম’। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একই ভাবে সে পথে হাঁটবে না।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে টাকার দাম আমেরিকার ডলারের তুলনায় ৭৪ নামক সংখ্যাটিকেও অতিক্রম করল। এটি একটি রেকর্ড পতন। আবার স্টক মার্কেট, শেয়ার মার্কেটে এই ঘোষণার পরেই ধস নেমেছে। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শেয়ার বাজারে মন্দা।
অতএব ডলারের সাপেক্ষে প্রায় প্রতি দিন টাকার দাম আরও তলানিতে চলে যাচ্ছে। তার উপর বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম আরও বাড়ছে। এর সঙ্গে বেলুনের মতো ফুলে ওঠা আমদানি খরচে রাশ টানতে বহু পণ্যে (যেমন এসি, ফ্রিজ) সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছে। আমদানি খরচ বাড়ছে বই কমছে না। তা হলে রফতানি থেকে আয় বাড়ছে না। এ দিকে আমদানি, বিশেষ করে বিদেশ থেকে কয়লা ও আকরিক লোহার আমদানি গত পাঁচ মাসে ১৯ শতাংশ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে এর ফলে ঘাটতি আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে।
দেশের অর্থনীতির যখন এই হাল তখন প্রশ্ন ওঠেই গত পাঁচ বছরে সেই প্রতিশ্রুত ‘আচ্ছে দিন’ কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy