প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর কক্ষ। গভীর চিন্তায় তাঁকে খুব রুক্ষ দেখাচ্ছিল। খানিকটা উত্তেজিতও। ঠিক এই সময়ে ঘরে প্রবেশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ওম মেহতা। কিছু ক্ষণ ফাইলের উপর চোখ বোলানোর পর শ্রীমতি গাঁধী খুবই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আই লাইক টু সি অল রিপোর্টস ইমিডিয়েটলি’। ওম মেহতা খানিকটা হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। ইন্দিরা আবার উত্তেজিত ভাবে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ব্রিং ইট ইমিডিয়েটলি’।
আসলে সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের একটি ঘটনা ইন্দিরাকে একদম দিশেহারা করে দিয়েছিল। নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। জগজীবন রাম কংগ্রেস ছেড়ে সিএফডি গঠন করেছেন, ইন্দিরা যেখানেই প্রচারে যাচ্ছেন সেখানেই জনসাধারণ তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখাচ্ছে। ইন্দিরা বুঝে গিয়েছেন যে ভোটের ডাক দেওয়াটা ভুল হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের যে রিপোর্ট ওম মেহতা ইন্দিরাকে দেন, তা দেখে তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিছু ক্ষণ পর ইন্দিরার সচিব আর কে ধবনের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন ওম আরও কিছু ফাইল নিয়ে। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে ইন্দিরার জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভোট হলে ইন্দিরা পর্যুদস্ত হবেন। ইন্দিরা বলেন, এই গোয়েন্দা রিপোর্ট তাঁকে আগে কেন দেখানো হয়নি? এই রিপোর্ট আগে দেখলে ইন্দিরা হয়তো মার্চে নির্বাচনটাই ডাকতেন না।
চলছে গুলির লড়াই। পাঠানকোটে। ছবি: এএফপি।
আসলে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর গুরুত্ব বৃদ্ধির কাজটাও যেমন ইন্দিরা করেছিলেন, আবার এটিকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করাটাও তখনই চরমে যায়। রাজনীতির জন্য আইবি-কে ব্যবহার করতে করতে আজ এই গোয়েন্দা বিভাগের অগ্রাধিকারেই গোলমাল হয়ে গিয়েছে।
আজ পাঠানকোটের ঘটনার পর গোয়েন্দা সমন্বয়ের অভাব নিয়ে আবার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়েও। কিছু দিন আগেই এক গোয়েন্দাকর্তা ক্ষোভের সুরে বলছিলেন, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা খুশি হন বলে আমাদের বড় কর্তারাও কারণে-অকারণে রাজনৈতিক রিপোর্ট তৈরি করেন। কিন্তু রাজনীতির থেকেও আজ সন্ত্রাস দমনের কাজে গোয়েন্দা ব্যুরোকে ব্যবহার করা অনেক বেশি জরুরি। কার্গিলের সেনা অনুপ্রবেশের পরও এই একই অভিযোগ উঠেছিল। তখনও সেনা গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা বাহিনীর সমন্বয়ের অভাব নিয়ে অভিযোগের তর্জনী উঠেছিল। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন বিএসএফ গোয়েন্দা বাহিনী ও অন্যান্য আর্থিক গোয়েন্দা শাখার সমন্বয়ও ছিল খুব দরকার। সুব্রহ্মণ্যম কমিটির সুপারিশেও সব গোয়েন্দা বাহিনীগুলিকে নিয়ে একটি অ্যাপেক্স বডি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কার্গিল যুদ্ধের পর পাঠানকোট কাণ্ড— সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
ইন্দিরা গাঁধী গোয়েন্দা বাহিনীর গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। তিনি গোয়েন্দা বাহিনীর আধুনিকীকরণের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করেছিলেন সেটি নিঃসন্দেহে সে দিন প্রয়োজন ছিল। ইন্দিরা তাঁর ১১ বছরের রাজত্বে খুব ধীরে ধীরে বহু অর্থব্যয় করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরকে পুরোপুরি আধুনিক কায়দায় সাজিয়েছিলেন। যাতে রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক নিরাপত্তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যে কোনও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নির্ভর করে তার গোয়েন্দা দফতরের উপর। আর ভারতের মতো দেশ, যেখানে বহু বিদেশি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা চক্র সবসময় সক্রিয় রয়েছে সেখানে ভারতের নিজের গোয়েন্দা দফতরটিকে যদি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে অত্যাধুনিক করা না যায় তবে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা চক্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে কী করে? ইন্দিরা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের সহযোগী সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’, সংক্ষেপে ‘র’-এর প্রবর্তন করেছিলেন। ইন্দিরার উৎসাহেই ‘র’-এর মতো দক্ষ সংস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধেও এই ‘র’-এর ভূমিকা আজও স্মরণীয়।
কিন্তু সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগের রাজনীতি নিয়ে অতি মাতামাতিও ইন্দিরার সময়েই বেড়ে যায়। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা— এই দীর্ঘ সময়ে গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকায় ছিল রাজনীতির আধিপত্য।
তবে সে সময়ে গোয়েন্দা বিভাগের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। এ কথা ঠিক, আজকের মতো সে দিনও রাজনেতারা গোয়েন্দা বিভাগের সমালোচনা খুশি মনে নিতেন না।
ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে পরাজয়ের পর গোয়েন্দা দফতর কিন্তু ইন্দিরাকে বলেছিলেন, এখনও মানুষ তীব্র ইন্দিরা বিরোধী হয়নি। যদি তিনি পদত্যাগ করে দেন এবং সাময়িক ভাবে কোনও সিনিয়র মন্ত্রীকে অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের শুনানির জন্য অপেক্ষা করেন, সেটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা হবে। এমনকী, গোয়েন্দা দফতরের অধিকর্তা শ্রী মাথুর বলেছিলেন, যদি সুপ্রিম কোর্টও শুনানির পর নির্বাচনে লড়ার অধিকার কেড়ে নেয় চাইলে নির্বাচন কমিশন সে আদেশ খারিজ করে দিয়ে তাঁকে প্রার্থী হওয়ার অধিকার দিতে পারে। কে ডি কে সুন্দরম যখন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তখন ডি পি মিশ্রর ছ’বছর ব্যাপী নির্বাচনী অনুপযুক্ততার আদেশ নির্বাচন কমিশন খারিজ করেছিল। গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট পেয়ে ইন্দিরা না কি ইস্তফা দেওয়ার কথা ভেবেও ছিলেন। দেবকান্ত বড়ুয়াকে না কি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সঞ্জয় গাঁধী ও অন্যান্য কিছু স্তাবকের কথায় প্রভাবিত হয়ে ইন্দিরা শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দেননি। সঞ্জয় মাকে বলেছিলেন, ক্ষমতা যার কাছে থাকবে তার দিকেই অনুগতরা থাকে। তাই ইস্তফা দিও না। অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে সকলে তার দিকেই চলে যাবে। তুমি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।
১৩৮৪-র ৯ আশ্বিন ইন্দিরা গাঁধী ও গোয়েন্দা দফতর নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। যার লেখক ছিলেন তৎকালীন সময়ের সাংবাদিক রুদ্রেন্দু সরকার। বইটির দাম তখন ছিল ছয় টাকা। মণ্ডল অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত এই বইটি এখন আর ছাপা নেই। এই বইটিতে ইন্দিরার কাছে দেওয়া গোয়েন্দা রিপোর্ট ও ইন্দিরার ইস্তফা না দেওয়ার নেপথ্য কাহিনি জানা যাচ্ছে।
গত ত্রিশ বছর ধরে এই গোয়েন্দা বিভাগকে আমারও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। আগে তো বাঙালি গোয়েন্দাদের সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। এখন অনেক কম।
নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমনে গোয়েন্দা কার্যকলাপের চেয়ে রাজনীতির বিষয়ে অভ্যন্তরীণ টিকটিকিগিরির প্রাধান্য আজও সমানে চলেছে। প্রয়াত গোয়েন্দা মলয়কৃষ্ণ ধরের বিতর্কিত বইটি থেকে তো হালের রাজনৈতি আড়ি পাতার বহু কাহিনি দিবালোকে এসেছে।
সম্ভবত পাঠানকোট কাণ্ডের পর এই অগ্রাধিকার নিয়ে আর এক বার ভাবার সময় এসেছে।
অনিবার্য কারণে এ সপ্তাহে শাহি সমাচার প্রকাশিত হল না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy