Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুটি ফেরি ব্রিজ বিক্রি হয়ে গেল ৮০ হাজার টাকায়

‘অচেনা শহর’-এ এ বার মুখোমুখি দুই শহরের মেলবন্ধনের আখ্যান।সে সময়ের লর্ড এলেনবরোর সরকার জানিয়ে দিল যে, এ কাজে সরকারের পুরোপুরি সমর্থন থাকলেও কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানিকে কোনও আর্থিক অনুদান বা ঋণ মঞ্জুর করা এই অবস্থায় সম্ভব নয়।

১৮৭৪ সালে তৈরি হয় হাওড়া ব্রিজ। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

১৮৭৪ সালে তৈরি হয় হাওড়া ব্রিজ। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

তারাপদ সাঁতরা
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৭ ১৯:৪০
Share: Save:

পরিকল্পনা খাতে এমন অসম্ভব ব্যয় বৃদ্ধি ও অব্যবস্থা ঘটার দরুন অংশীদাররা এ পরিকল্প রূপায়ণে তেমন আশার আলো না দেখতে পেয়ে শেষ অবধি ১৮৪২-এর ১৫ জুনের এক সভায় যাবতীয় মালপত্র বিক্রি করে কোম্পানি তুলে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।

এই পরিস্থিতিতে কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি পরিকল্পটি যাতে সফল হয় সে বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে সরকারের কাছে আর্জি জানাল যে, এমন একটি ভাসমান সেতু নির্মিত হলে জনসাধারণ যে যথেষ্ট উপকৃত হবে সে কথা চিন্তা করে সরকার যেন এ পরিকল্প বাবদ সীমাশুল্ক মকুব করে দেবার ব্যবস্থা করেন। সে সময়ে প্রকাশিত খবরের কাগজেও সরকারের কাছে দাবি করা হল, এমন একটি জনকল্যাণমূলক পরিকল্প রূপায়ণে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু সে সময়ের লর্ড এলেনবরোর সরকার জানিয়ে দিল যে, এ কাজে সরকারের পুরোপুরি সমর্থন থাকলেও কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানিকে কোনও আর্থিক অনুদান বা ঋণ মঞ্জুর করা এই অবস্থায় সম্ভব নয়।

অতএব বিগত ১৫ জুনের অংশীদারদের সভায় কোম্পানির যাবতীয় মালপত্র ও সাজসরঞ্জাম বিক্রি করে দেবার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী ১৮৪২-এর ১ অগাস্টের অংশীদারদের সভায় সেই সিদ্ধান্ত বহাল রেখে দুটি ফেরি ব্রিজ আশি হাজার টাকায় এবং ছোট টাগ স্টিমারটি বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে এই পরিকল্পটির পরিসমাপ্তি ঘটানো হল। আসলে নদী পারাপারের পরিকল্পনাটি সার্থক হতে পারল না এই কারণে যে, পরিকল্পের সঠিক ব্যয় নির্বাহের পরিমাণ নির্ধারণে যথাযথ হিসাব কষায় ত্রুটি এবং সর্বোপরি কোম্পানির ডিরেক্টরদের গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা ও অযোগ্যতাও এর মূলে ইতি ঘটানোয় এক বড় কারণ।

আরও পড়ুন: কলকাতা-হাওড়ার সেতুবন্ধ কাহিনী

নদী পারাপারের এ পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে যাওয়ার বারো বছর পরে ১৮৫৪ সালে হাওড়ায় রেল স্টেশন বসিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। অতঃপর বাষ্পীয় শকট চালু হয়ে যাতায়াত করেছে হুগলী-পাণ্ডুয়া পর্যন্ত। পরের বছর আবার রাণীগঞ্জ অবধি রেল লাইন বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত এক বছরে ‘ইনকাম’ও রেল কোম্পানির মন্দ হয়নি। কী কী বাবদে কত টাকা এসেছে আর কত টাকা খরচ-খরচা হয়েছে তার হিসেবও রেল কোম্পানি খবরের কাগজ মারফত জনসাধারণকে জ্ঞাত করিয়েছেন। কলকাতা-হাওড়া পারাপারে তখনও কোনও সেতু নির্মিত হয়নি। কলকাতা থেকে যাত্রীরা এপারে আসছে খেয়া পার হয়ে। তদুপরি আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে ফেরি স্টিমারও চালু রয়েছে। কোনও এক বাবু লক্ষ্মীনারায়ণ বোস হলেন এই ফেরি সার্ভিসের মালিক। তাই নেটিভ লক্ষ্মীবাবুর স্টিমার সার্ভিস সম্পর্কে সাহেবরা কিন্তু সন্তুষ্ট নয়। মাঝে মাঝে পারাপারের জন্য স্টিমারে গোরু-ভেড়া তুলে সাহেব যাত্রীদের ‘স্ট্যাটাস’ নষ্ট করে দেওয়া হয় বলেই তাদের এই উষ্মা লক্ষ্মীবাবুর উপর।

তবে আর্মেনিয়ান ঘাটে রেলের বুকিং অফিসে রেলের টিকিট কাটালে বা মালপত্র বুক করলে রেলের স্টিমারেই ওপারে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা আছে। এর জন্যে আর যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় না।

অথচ কলকাতার মতো এতবড় এক মহানগরীর সঙ্গে রেলপথ যোগাযোগের পরিকল্পনা যে এই রেল কোম্পানির ছিল না— এমন নয়। কিন্তু সে যোগাযোগের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই হুগলী-ভাগীরথী নদী। তাই হাওড়া স্টেশনের কাছ বরাবর একটি সেতু বানিয়ে নদীর ওপারে টাঁকশালের কাছ দিয়ে কলকাতা অবধি লাইনটা বসিয়ে দিলেই সমস্যা চুকে যায়; তদুপরি রেল কোম্পানির দু পয়সা আয় বৃদ্ধি হয়।

এদিকে কলকাতার বদলে হাওড়া থেকে রেল চালু করার জন্যে রেল কোম্পানিকে তো সে সময়ের খবরের কাগজগুলো একহাত নিয়েছে। কোম্পানির হঠকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে কাগজে লেখা হয়েছিল যে, ব্যবসা বাণিজ্যের পরিস্থিতি, বাণিজ্যগত স্বার্থের প্রয়োজনীয়তা এবং রেলের নিজস্ব সুবিধে-সুযোগের কথা চিন্তা করে কলকাতা থেকেই কোম্পানির রেল লাইন শুরু করা উচিত ছিল। অবশ্য রেল কোম্পানিও চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিল, কী করে গঙ্গাবক্ষে একটি সেতু নির্মাণ করা যায়।

(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ থেকে নেওয়া। আজ তার দ্বিতীয় অংশ। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE