চাঁদের আলোয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের গম্বুজ।
কলকাতার ল্যান্ডমার্ক কোনটি, জানতে চাইলে অনেকেই চোখ বুজে বলে ফেলবেন ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল’। বিদেশিদের কাছেও হাওড়া ব্রিজের চাইতে কলকাতা অনেক বেশি সমার্থক ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে। সেই দৌড়ে অবশ্য অনেক পিছিয়ে রয়েছে ধর্মতলার মনুমেন্ট! অথচ মজার ব্যাপার, এই ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ নিয়ে আমরাই কি সবটুকু এখনও জেনে উঠতে পেরেছি?
১৯০১-এ রানির মৃত্যুর পর মূলত কার্জনের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল এই স্মৃতিসৌধ তৈরির কাজ। ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের সবচাইতে দৃষ্টিনন্দন অংশ হল এই স্থাপত্যের ঠিক মধ্যভাগের একটি ডোম বা গম্বুজ। এই ডোমটির ঠিক নীচের ঘরটিকেই বলা হয় ‘কুইন’স হল’। আর এই ডোমটির ঠিক ওপরেই মধ্যস্থলে বসানো রয়েছে বিউগল হাতে ডানা মেলা ব্রোঞ্জের সেই বিশ্বখ্যাত পরীটি। নীচে, ভেতরে এই ঘরটির পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে চলে যাওয়া যায় ওপরে। ডোমটির গোলাকৃতি ঘিরেই রয়েছে একটি রেলিং দেওয়া পথ। আর এই পথটির ঠিক ওপরের পোর্টিকো’গুলিতে স্থাপিত হয়েছে ১২টি বেশ বড় মাপের ছবি। অনেক আগে মনে করা হয়েছিল এই ছবিগুলি আসলে ফ্রেস্কো। ভেজা দেওয়ালের ওপর রং দিয়ে খুব দ্রত আঁকা এক ধরনের ছবিকে ‘ফ্রেস্কো’ বলা হয়। অজিণ্ঠা গুহাচিত্রে এই ফ্রেস্কোর প্রয়োগ দেখা যায়। পরে শিল্পগবেষক এবং ঐতিহাসিকরা অনুসন্ধান করে জানান যে এগুলি ফ্রেস্কো নয়, বরং ক্যানভাসের ওপর আঁকা তৈলচিত্র। বিস্তারিত অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি এই দ্বাদশচিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিকৃতি আঁকিয়ে শিল্পী ফ্রাঙ্ক সালিসবারি।
‘কুইন’স হল’-এর গ্যালারি।
ওপরের গম্বুজের ১২টি খোপে রয়েছে এই অনবদ্য দ্বাদশ চিত্রকলা। এই ছবিগুলি কী এবং কোন উপলক্ষে আঁকা সেই কাহিনি বলা যাক। শিল্পী এখানে রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনের দ্বাদশ আখ্যানের বিষয়গুলি চিত্রিত করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই ছবিগুলির মধ্যে প্রথমেই দেখা যাবে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের মৃত্যু সংবাদ রানিকে জানাচ্ছেন ক্যান্টারবেরির প্রধান ধর্মযাজক লর্ড চেম্বারলেন (২০ জুন, ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ)। দ্বিতীয় ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে রানির সাক্ষাৎ এবং লর্ড চ্যান্সেলর কর্তৃক রানিকে শপথ গ্রহণ করাবার দৃশ্য। ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবেতে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন রানির অভিষেক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভীষণ জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই রাজকীয় ধূমধামের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে তৃতীয় চিত্রে। পার্লামেন্টের অধিবেশনের সমাপ্তি অনুষ্ঠান (১৭ জুলাই ১৮৩৭) শিল্পী চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন চতুর্থ ছবিতে। রাজকীয় শকটে রানি প্রথম লন্ডনে আসেন ৯ নভেম্বর, ১৯৩৭-এ। রানির সেই বর্ণাঢ্য আগমনী শোভাযাত্রার দৃশ্য রয়েছে পঞ্চম চিত্রে। ষষ্ঠ চিত্রটিতে এক পাশে ব্রিটিশ সিংহ এবং অন্য পাশে বাংলার বাঘ-সহ ভারতীয় সিপাহী পরিবেষ্টিত ব্রিটানিয়া’কে দেখা যাচ্ছে।
রাজকুমার অ্যালবার্টের সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার বিবাহ দৃশ্যটি শিল্পী চমৎকার তুলে ধরেছেন সপ্তম চিত্রে। ১৮৭৭-এ রানি ভিক্টোরিয়াকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ্’ বা ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সে দিন এই সম্মান প্রদর্শন উপলক্ষে বিরাট একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল দিল্লিতে। অষ্টম ছবিতে ধরা পড়েছে রাজকীয় অনুষ্ঠানের সেই দৃশ্য। রাজাসনে উপবিষ্ট ভিক্টোরিয়ার একটি প্রতীকী আলেখ্য: শিরে রাজমুকুট, হাতে রাজদণ্ড আর অঙ্গে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পরিচ্ছদ নবম চিত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গী ‘বিশ্বস্ততা’ ও ‘স্বাধীনতা’ এবং কাঁধে রয়েছে ‘সত্য’ ও হাতে ‘ন্যায়’-এর প্রতীক বিরাজমান। রানির রাজ্য শাসনের হীরকজয়ন্তী বেশ ধুমধাম করেই পালিত হয়েছিল ২২ জুন ১৮৯৭-তে, সেন্ট পলসে। একাদশ চিত্রে সেই উৎসবপালনের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। দ্বাদশ এবং শেষ ছবিতে ধরা পড়েছে শোকের আবহ। এখানে দেখানো হয়েছে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ শয্যায় শায়িত মহারানি ভিক্টোরিয়া, ২২ জানুয়ারি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ। এককথায়, এই চিত্রমালাই এই সংগ্রহালয়ের এক বিরাট সম্পদ। যেগুলি, যাঁর স্মরণে এই সৌধ, তাঁকে চিনিয়ে দেয় পর্যায়ক্রমে। অথচ, মাথার ওপরে থাকে বলে এই দৃশ্যাবলী সাধারণত আমাদের মাথার ওপর দিয়েই বেরিয়ে যায়!
ক্যানভাসের ওপর আঁকা তৈলচিত্র।
দীর্ঘ কাল এই অনবদ্য চিত্রকলাগুলি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাজ্যপাল কে আর নারায়ণন এই ‘ডোম-পাথওয়ে’টি খুলে দিয়েছিলেন উৎসাহী দর্শকদের জন্য। এখন সবসময় অনুমতি না মিললেও এই অসাধারণ রাজকীয় মহিমা সমৃদ্ধ কুইন’স হল-এর ভেতরে এসে এক বার ওপরের দিকে তাকান, ঠিক চোখে পড়বে মহারানি ভিক্টোরিয়ার জীবনী-সহ এই অসাধারণ ছবিগুলি। ইতিহাসের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ এই ছবিগুলি, কারণ গবেষকদের মতে, এখানে এই চিত্রগুলিতে শুধু যে রানির জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে তাই নয়, বরং এখানে ধরা পড়েছে সেই সময়কার রাজকীয় জীবনযাত্রা, সামরিক বা রাজকর্মচারীর পোশাক পরিচ্ছদ এবং সর্বোপরি সেকালের স্থাপত্য। ফলে কলকাতার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে এলে এ বারে আপনাকে এক বার চোখ ফেরাতেই হবে ওপরের দিকে! ইতিহাসের সাক্ষী হতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy