Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতা-হাওড়ার সেতুবন্ধ কাহিনী

‘অচেনা শহর’-এ এ বার মুখোমুখি দুই শহরের মেলবন্ধনের আখ্যান।হাওড়ায় রেললাইন তখন বসেনি, কিন্তু খ্রিস্টীয় উনিশ শতকে কলকাতার সঙ্গে হাওড়ার যোগাযোগ রাখতে রয়েছে নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যের আকর্ষণ-বিকর্ষণের টানে। তাই কলকাতা থেকে হাওড়ার এলাকার পা রাখতে গেলে অতি অবশ্যই ভাগীরথীর উপর দিয়ে নৌকা বা ডিঙি সহযোগে পার হয়ে আসতে হবে, কেন না তখনও পর্যন্ত কোনও সেতু নির্মিত হয়নি।

হাওড়া সেতু তৈরির বিরল ছবি। ফাইল চিত্র।

হাওড়া সেতু তৈরির বিরল ছবি। ফাইল চিত্র।

তারাপদ সাঁতরা
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৭ ১৭:২৩
Share: Save:

হাওড়ায় রেললাইন তখন বসেনি, কিন্তু খ্রিস্টীয় উনিশ শতকে কলকাতার সঙ্গে হাওড়ার যোগাযোগ রাখতে রয়েছে নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যের আকর্ষণ-বিকর্ষণের টানে। তাই কলকাতা থেকে হাওড়ার এলাকার পা রাখতে গেলে অতি অবশ্যই ভাগীরথীর উপর দিয়ে নৌকা বা ডিঙি সহযোগে পার হয়ে আসতে হবে, কেন না তখনও পর্যন্ত কোনও সেতু নির্মিত হয়নি। সে সময়ের সরকারি এক হিসেব অনুযায়ী জানা যায় দৈনিক প্রায় দশ হাজার মানুষ এইভাবে নদী পারাপার করে থাকত, কিন্তু প্রতি বৎসরই নৌকোডুবিতে মারা পড়ত শয়েক-দেড়শো লোক। ছোট নৌকা বা ডিঙিতে নদী পারাপার হওয়াতে তখন বেশ ঝুঁকি ছিল। অন্যদিকে আবার নদীর পাড়ে নৌকোয় মালপত্র বোঝাই ও খালাস করার বিষয়েও বেশ অসুবিধে দেখা দিয়েছিল। এর ফলে হাওড়ার অর্থনৈতিক উন্নতিও বেশ ব্যাহত হচ্ছিল।

এই নদী পারাপার হওয়ার সমস্যা যখন চলছে তখন ১৮৩৯ সালে ‘বেঙ্গল হরকারু’ পত্রিকায় এই সমস্যায় আলোকপাত করে লেখা হল, বিলেতের প্লাইনাথের কাছে হামোয়াজির উপরে জেমস এস. রেন্ডেল-এর নকশা অনুযায়ী যে রকমের স্টিম ফেরি ব্রিজ নির্মাণ করে চার বছর ধরে চালু রাখা হয়েছে, সেই ধরনের এখানেও যদি ফেরি ব্রিজ নির্মাণ করা হয় তা হলে সুষ্ঠুভাবে নদী পারাপার সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং সে জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা হল, সরকারেরও উচিত অন্তত মানবিকতার খাতিরে এখানেও যেন ওই ধরনের একটি ফেরি ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরে তদানীন্তন শিল্পদ্যোগী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি এই মূল্যবান পরামর্শে উৎসাহিত হয়ে এমন একটি পরিকল্প রূপায়িত করার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহান্বিত হলেন এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরবর্তী বাণিজ্যিক উদ্যোগ হল, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসাবে স্টিম ফেরি ব্রিজ কোম্পানির প্রতিষ্ঠা, যার উদ্দেশ্য হল, কলকাতা ও হাওড়ার সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে একটি ভাসমান সেতুর সাহায্যে নদী পারাপারের ব্যবস্থা করা। ১৮৪০ সালের ৭ জুলাই কলকাতার টাউন হলে এই কোম্পানির পক্ষে প্রথম সভাটি ডাকা হল। সেখানে নদী পারাপার বিষয়ক পরিকল্পটির খুঁটিনাটি কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের কাছে বিশদভাবে ব্যক্ত করে বলা হল, বিলেতের রেন্ডেল-এর পরিকল্প অনুযায়ী এখানে একটি নব্বই ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বিশিষ্ট লোহার ভাসমান সেতু রাখা হবে। চল্লিশ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট এক স্টিম ইঞ্জিন দ্বারা চালিত ঘূর্ণায়মান পেনিয়ানযুক্ত চাকার সঙ্গে যে লোহার ঘাটকাটা চেন লাগানো হবে তা দিয়ে এপার-ওপার টেনে আনবে সেই ভাসমান সেতুটিকে। আর এই ফেরি পার হতে সময় লাগবে মাত্র সাত মিনিট এবং প্রতি খেপে এটির যাত্রীবহন ক্ষমতা হবে এগোরোশোর মতো। এ ছাড়া এই ধরনের আর একটি বাড়তি ভাসমান সেতু প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য নদীর অপর প্রান্তে রাখা হবে এবং আড়াআড়িভাবে নদীগর্ভে পাতা চেনের জন্য অন্যান্য জাহাজ চলাচলে যাতে কোনও অসুবিধার সৃষ্টি না হয় সে জন্য কোম্পানির পক্ষে একটি ছোট স্টিমার রাখা হবে যেটি নদীবক্ষে চলাচলকারী জাহাজগুলিকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রতি যাত্রী পিছু পারানির কড়ি আধ পয়সা হিসেবে ধরলে পরিকল্পটির অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে বছরে ৩৬ হাজার টাকার মতো লাভ দাঁড়াতে পারবে। এ ছাড়া পরিকল্পটিতে একশো টাকা হিসাবে দু’হাজার শেয়ার বিক্রি করে যে দু’লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে তাতে পরিকল্পটির রূপায়ণে নানাবিধ গঠনকার্যে ব্যয়িত হবে।

মল্লিকঘাটের কাছে পন্টুন সেতু

ওই বছরের শেষ দিকে সরকারি অনুমতি ইত্যাদি পাওয়ার পর ওই ধরনের স্টিম ফেরি ব্রিজের বায়নাও দিয়ে দেওয়া হল বিলেতের রেন্ডেল কোম্পানিকে। কিন্তু পরিকল্পনায় যে ব্যয়-বরাদ্দ ধরা হয়েছিল, তার দ্বিগুণ খরচ লেগে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় শেয়ার হোল্ডারদের সভায় সিদ্ধান্ত হল যে, দুটি ফেরি ব্রিজের অর্ডার যখন দেওয়া হয়ে গেছে তখন দুটির মধ্যে একটিকে শতকরা দশভাগ ছাড় দিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হবে।

কিন্তু যা ভাবা হয়েছিল সেইমতো কাজ অবশ্য এগুল না। বিলেতে অর্ডার দেওয়া টাগ স্টিমারটি যখন এল তখন দেখা গেল পরিকল্পিত দামের অধিক মূল্য যদিও ধরা হয়েছে, কিন্তু সেটি চালান আসার সময়ে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে উপযুক্ত সারাই করা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এদিকে অন্য আরেক বিপত্তি দেখা দিল। ক্যালাকাটা ডকিং কোম্পানি নদীতে আড়াআড়িভাবে চেন পাতার জন্য উত্তর দিকে তাদের জাহাজ চলাচলে অসুবিধা ঘটবে বলে আপত্তি জানিয়ে প্রস্তাবিত জেটির স্থান অন্যত্র সরাবার দাবি জানাল। এদিকে ১৮৪২ সালের জুলাই মাসে বিলেতে তৈরি হওয়া দু’টি ফেরি ব্রিজ জাহাজে করে কলকাতা এসে পৌঁছল। কিন্তু সেখানেও দুর্ভাগ্য এই যে, ওই দু’টি ফেরি ব্রিজের মধ্যে একটি ভাল অবস্থায় থাকলেও অন্যটিতে দেখা গেল সেটির তলায় ফুটো হয়ে গিয়েছে। এবং তার কলকব্জা বেশ জং ধরা অবস্থায়।

(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ থেকে নেওয়া। আজ তার প্রথম অংশ। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE