Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সান্দাকফু রওনার আগে ব্যাগে ভরলাম ড্রইংখাতা

মানেভঞ্জন শহরটা ক্রমেই ছোট হয়ে এল...তার পর একটা বাঁকের পরেই ভ্যানিশ! আজ প্রথম পর্ব।মানেভঞ্জন শহরটা ক্রমেই ছোট হয়ে এল...তার পর একটা বাঁকের পরেই ভ্যানিশ! আজ প্রথম পর্ব।

মানেভঞ্জন থেকে উঠে গেছে সান্দাকফুর রাস্তা।

মানেভঞ্জন থেকে উঠে গেছে সান্দাকফুর রাস্তা।

দেবাশীষ দেব
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৭ ২৩:৪৬
Share: Save:

শেষমেশ আমাকেও কিনা ঘোড়া রোগে ধরল! পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে পৌঁছে জীবনে প্রথম পাহাড়ে ট্রেকিং করতে যাওয়ার জন্য ক্ষেপে উঠলাম— সালটা ছিল ১৯৯৯। এ যাবৎ বেড়িয়েছি প্রচুর। হিমালয় দর্শনও কিছু কম হয়নি, কিন্তু সবই শৌখিন টুরিস্ট হিসেবে। এ বার দস্তুরমতো অ্যাডভেঞ্চার আর গন্তব্য হল বারো হাজার ফুট উঁচুতে ‘সান্দাকফু’। জায়গাটা আমাদের পশ্চিম বাংলার পাহাড়ি অঞ্চলে একেবারে নেপাল সীমান্তে। চেনা জানা বহুলোক গেছে এসেছে— শুনে শুনে রুটটা প্রায় মুখস্থ। ট্রেকিংয়ে হাতেখড়ির জন্য সান্দাকফু একেবারে আদর্শ-রাস্তা ভাল-পথে বিস্তর থাকার জায়গা-ওপরেও সরকারি ট্রেকার্স হাট আছে-খাবার পাওয়া যায়।

ঠিক হল, মার্চের গোড়ায় রওনা দেব— আমি আর আর্টিস্ট বন্ধু অভিজিৎ, আমার থেকে দশ বছরের ছোট আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক গুলে খাওয়া ছেলে। ট্রেকিংয়ে যাওয়া ওর-ও এই প্রথম। ছবি আঁকাই আমার পেশা। আর্ট কলেজে থাকতে ‘আউটডোর স্কেচিং’ ব্যাপারটা চুটিয়ে উপভোগ করতাম, অথচ পরে আর বেড়াতে গিয়ে বসে বসে ছবি আঁকার ইচ্ছে হয়নি। মাঝে কেটে গেছে কুড়িটা বছর। সান্দাকফু যাওয়ার তোড়জোড় যখন তুঙ্গে এক বন্ধু একটা ইংরেজি বই এনে দিল— চেন্নাই থেকে ছাপা, লেখক তামিল ডাক্তার যিনি এক অভিযাত্রী দলের সঙ্গে পাহাড়ে চড়েছিলেন এবং যাবতীয় অভিজ্ঞতা অতি সরস ভাষায় বর্ণনা করেছেন বইটিতে। সেই সঙ্গে রয়েছে লেখকেরই আঁকা বেশ কিছু লাইন স্কেচ। চোখের সামনে যা দেখেছেন সহজ ভঙ্গিতে এঁকে নিয়েছেন। এর মধ্যে পাহাড়, জঙ্গল যেমন আছে তেমন আছে দড়ি-গাঁইতি, তাঁবুর মতো পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম কিংবা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কোনও যাত্রাসঙ্গী। ভদ্রলোক গোড়াতেই স্বীকার করে নিয়েছেন, আঁকা বা লেখা কোনওটাই তাঁর কাজ নয়, স্রেফ মজার ছলে করেছেন। ঠিক এই কারণেই বেড়ানো নিয়ে তাঁর এই ডকুমেন্টেশন এতই স্বতঃস্ফুর্ত হয়েছিল যে এক ধাক্কায় যেন ফিরে এল আমার সেই ‘আউটডোর স্কেচিং’-এর দিনগুলো। ফলে সান্দাকফু রওনা হওয়ার আগে নতুন উৎসাহে রুকস্যাকের মধ্যে ভরে নিলাম একটা পাতলা ড্রয়িংখাতা।

পাহাড়ের কোলের ছোট্ট শহর— মানেভঞ্জন

শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে চেপে পর দিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন, সেখান থেকে শেয়ার জিপে করে প্রথমে ‘ঘুম’। এখান থেকে একটা রাস্তা গেছে দার্জিলিংয়ের দিক অন্যটা সুখিয়াপোখরি হয়ে রিম্বিক অবধি— আমরা লোকাল বাসে চেপে ওই রাস্তা ধরে চলে গেলাম মানেভঞ্জন, দূরত্ব দশ কিলোমিটারের, পৌঁছলাম বিকেল তিনটে নাগাদ। রাতটা কাটিয়ে পর দিন আমাদের হাঁটা শুরু হবে এই মানেভঞ্জন থেকেই। একটু এ দিক-ও দিক ঘুরে একটা হোটেল পেয়ে গেলাম, দোতলায় ঘর, নীচে রাস্তার ওপর মালিকের ঘড়ি সারানোর দোকান। বাঙালি, অবনী ভট্টাচার্য। আদতে দুর্গাপুরের লোক, এখানে নেপালি মেয়ে বিয়ে করে দিব্যি জমিয়ে বসেছেন। আমাদের কাছ থেকে চল্লিশ টাকা করে নিল, ছোট্ট একটা মেয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছিল, পর্দার আড়ালে থাকা ওর মায়ের নির্দেশমতো, অবনীবাবুর পরিবার। রাতে চাউমিন খাওয়াবে শুনে আমরা বর্তে গেলাম। আসার সময়ে গয়াবাড়িতে একটা খাবারের দোকানে আমাদের জিপ থেমেছিল, ঝটপট একটা ছবি এঁকে উদ্বোধন করেছিলাম আমার স্কেচ খাতার। ইচ্ছে হল অবনীবাবুকেও আঁকব। পর দিন ভোরে উঠে ওঁকে এই প্রস্তাব দেওয়ায় উনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন বলে মনে হল। ছাদের একপাশে দাঁড় করিয়ে কোনওমতে মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে ওঁর ছবি আঁকা হল। তখনও জানতাম না বছর চারেক বাদে আবার এসে দ্বিতীয় বার আঁকব এই ঘড়ির ডাক্তারকে!

মানেভঞ্জন থেকে হাঁটা শুরু হল সকাল আটটা নাগাদ। প্রধান সড়ক থেকে একটা পায়ে চলা পথ উঠে গিয়েছে। একটা সাইনবোর্ড লেখা, সান্দাকফু এখান থেকে ৩১ কিলোমিটার, ইচ্ছেমতো থেমে থেমে ওঠা যায়...সে জন্য বেশ কিছু ট্রেকার্স হাট আর লজ আছে...তা ছাড়া চাইলে গ্রামের যে কোনও বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে। প্রথম দিকে রাস্তাটা বেশ খাড়াই। সবাই ধীরে সু্স্থে ওঠে। বহুকাল ধরে শরীরচর্চা করে আসছি, নিয়মিত জগিংয়ের অভ্যাস আছে। ফলে প্রথম বার পাহাড়ে চড়তে বেশ ভালই লাগছিল। কিছুটা উঠে জনা পাঁচেক ছেলের মুখোমুখি হলাম, দুদ্দাড়েই নেমে আসছিল। ওদের দমই আলাদা...এক জন ওর হাতের লাঠিটা আমাকে ধরিয়ে দিল...কিছু বোঝার আগে সবাই হাওয়া। এই লাঠিটা কিন্তু শেষ অবধি রেখেছিলাম...বেশ কাজে দিয়েছিল।

চিত্রে-আমাদের প্রথম হল্ট।

নীচে মানেভঞ্জন শহরটা ক্রমেই ছোট হয়ে এল...তার পর একটা বাঁকের পরেই ভ্যানিশ! চারপাশে ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে ঘণ্টাখানেক গিয়ে আমাদের প্রথম স্টপ চিত্রে। দূর থেকে চোর্তেন বা মন্ত্র লেখা ফ্ল্যাগের সারি চোখে পড়েছিল...একটু বড় জনবসতি মানেই একটা গুম্ফা থাকবে। সামান্য জিরিয়ে, চা খেয়ে আবার হাঁটা, এ বার চড়াই কম তবে পরের গ্রাম মেঘমা পৌঁছতে দুপুর হয়ে যাবে। প্রচুর বিস্কুট, চকোলেট আর বাদাম চাট আনা হয়েছে, এনার্জি পেতে গেলে গ্লুকোজ দরকার। অল্প কামড় দিতে দিতে এগোচ্ছি। মেঘমা নামটা সার্থক, চারধারে মেঘে আর কুয়াশার ছড়াছড়ি...দু’হাতে দূরের লোককে দেখা যায় না। প্রথম বার গিয়ে অল্প কিছু ঘরবাড়ি দেখেছিলাম। ২০১১তে শেষবার গিয়ে দেখি রীতিমতো একটা শহর হয়ে গেছে। অনেকটা উঠে এসেছি, তায় কুয়াশা, দুপুর বারোটাতেই বেশ ঠান্ডা। সামনেই একটা চালাঘরের গায়ে বোর্ড লাগানো, সাইলিং টি হাউস। ঢুকে পড়লাম। এ বার শুধু চা নয়, এ বার টা-ও দরকার। বেশ বড়সড় ঘর, একপাশে কাঠের টেবিল-বেঞ্চ। অন্য দিকে উনুন জ্বলছে, কয়েক জন মোড়াতে বসে হাত-পা শেঁকছে। হাসি হাসি মুখে উঠে এল এক জন। খানা হোগা? জলদি জলদি? এসে গেল গরম গরম নুডলস‌্‌-এর ঝোল। খিদের মুখে ভালই লাগল...তখনও জানতাম না সামনের চার দিন স্রেফ এই খেয়েই কাটাতে হবে!

লেখক পরিচিতি: লেখক প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট। কিন্তু তুলি-কলমের বাইরেও আদ্যন্ত ভ্রমণপিপাসু। সুযোগ পেলেই স্যাক কাঁধে উধাও। সঙ্গে অবশ্য আঁকার ডায়েরি থাকবেই।

অলঙ্করণ:লেখকের ডায়েরি থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE