Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ম্যাডামের ডায়েরি থেকে

স্পিতি উপত্যকার কেন্দ্র কাজা-য় গিয়ে অবিস্মণীয় অভিজ্ঞতার সামনে পড়েছিলেন বনভূষণ নায়ক।স্পিতি উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র কাজা (৩৬০০ মিটার) থেকে পঁয়ত্রিশ কিমি দূরে কুংরি যেতে হলে তখন হয় পয়দল না হলে গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। দু’দিন অপেক্ষা করার পর একটা সরকারি ট্রাকে করে আতারগো গিয়ে সেখান থেকে পায়দলে এগারো কিমি যাওয়ার পর হতাশ হতে হল।

বনভূষণ নায়ক
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ১৫:০০
Share: Save:

কাজা শহরে সে বার পর্যটক তেমন আসেনি। অগস্টের প্রথম সপ্তাহে জাঁকিয়ে ঠান্ডাও পড়েছিল। ফলে মানালি থেকে রোটাং পাস (৩৯৮০ মিটার) এবং খুমজুমলা (৪৫৫১ মিটার) পেরিয়ে দুশো কিলোমিটার দূরে কাজা শহরে বাইরের মানুষ চোখে পড়ার মতো বলে মনে হয়নি। বিদেশিদের সেই থিকথিকে ভিড় দেখলে হতভম্ব হওয়ার কোনও ব্যাপার ছিল না। অনেক বার ভেবেও আগে আমার কুংরি গোম্ফা যাওয়া হয়নি। সে বার সেখানেই যেতে চেয়েছিলাম। শোনা যায়, এক সময় এই গোম্ফাটি বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র হিসাবে সুপরিচিত ছিল। এখনও কুংরি (৩৫২০ মিটার) যথেষ্টই প্রসিদ্ধ। পিন নদীর তীরে বড় রাস্তা ধরে গুলিং থেকে মাত্র দু’কিমি উপরে উঠলেই পৌঁছে যাওয়া যায় কুংরি গোম্ফায়।

স্পিতি উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র কাজা (৩৬০০ মিটার) থেকে পঁয়ত্রিশ কিমি দূরে কুংরি যেতে হলে তখন হয় পয়দল না হলে গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। দু’দিন অপেক্ষা করার পর একটা সরকারি ট্রাকে করে আতারগো গিয়ে সেখান থেকে পায়দলে এগারো কিমি যাওয়ার পর হতাশ হতে হল। এক জন তরুণ লামা কুংরি ওঠার পথে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনিই জানালেন যে, ওই দিন গোম্পার উপরে ওঠা যাবে না। কেন বা কী কারণে এমন নির্দেশ তা তিনি নিজেও জানেন না। তিনি যে নিতান্তই এক জন বার্তাবাহক, এ কথা জানাতে তিনি কোনও দ্বিধা করেননি। আমার মনটা ঝট করে তেতো হলে গেল। এত দিন পর একটা সুযোগ এসেও সেটা এ ভাবে নষ্ট হওয়ায় আমি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে পড়লাম। বিরক্তি কী ভাবে প্রকাশ করব যখন প্রায় ঠিক করে ফেলেছি তখনই একটা ভাড়াগাড়ি আমাদের সামনে এসে সজোরে ব্রেক কষল। আমার হিসাব মুহূর্তে ঘেঁটে গেল।

গাড়ি থেকে নামলেন এক জন অত্যন্ত স্মার্ট মহিলা। বব করা কাঁচাপাকা চুলে তাঁকে দারুণ আকর্ষণীয় লাগছিল। অনুমান, আমারই মতো তিনিও সদ্য পঞ্চাশকে পিছনে ফেলেছেন। ম্যাডাম সেই লামাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে আনেন। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় পাঁচ-সাত জন ম্যাডামের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাই দেখি ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ম্যাডামকে গাড়িতে উঠে পড়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সে জানাল, তুমি এক্ষুণি গাড়িতে না উঠলে তোমার সঙ্গে আমারও বিপদ হতে পারে। মহিলাটি গর্জন করতে করতে গাড়িতে উঠে পড়লেন। আসলে স্পিতি এলাকায় লামাদের কেউই অসম্মান করে না। আপত্তি থাকলেও একটা সহজ সমাধান মানুষজন বের করে নেয়। বিদেশি মহিলা, তাই সম্ভবত স্থানীয় রীতি ও শিষ্টাচার সম্বন্ধে ওনার তেমন ধারণা ছিল না। বা এমনও হতে পারে, কোনও কারণে উনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। হঠাৎ হঠাৎ এমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন।

গাড়িটি আচমকা গতি বাড়িয়ে যে দিক থেকে এসেছিল সে দিকে চলে গেল। আমারও ওই পথেই ফিরে যাওয়া দরকার। তার মানে ফের এগারো কিলোমিটার পথ শেষ করে তবে আতারগো। সেখান থেকে অপেক্ষায় থাকা যদি কাজা পর্যন্ত যাওয়ার কিছু মিলে যায়। কুংরি গোম্ফার মাথায় মনে মনে সতেরো ঘা মেরে হাঁটতে শুরু করলাম।

গুলিং থেকে আতারগো পথে গাড়ি চলে মূলত রাস্তা তৈরি করার প্রয়োজনেই। সে পথ তৈরি হয় পিডব্লিউডি, অর্থাৎ পূর্ত বিভাগের মর্জিমতো। সেই ’৯৫ সালে তাকে ঠিক রাস্তা বলা যেত না। কিন্তু ওই পথে চলতে চলতে দুটি অপরূপ দৃশ্যের আনন্দ উপভোগ করা যেত। এক, আতারগো পর্যন্ত পিন নদীর সুনীল জলধারা ‘ছলছলাৎ’ শব্দের সিম্ফোনি দিয়ে প্রায়ই মানসিক বিনোদনের আয়োজন সাজিয়ে রাখত। সেই শব্দ শুনতে শুনতে উত্তর-পূর্ব প্রান্তে প্রসিদ্ধ ডানখার গোম্ফার ভগ্নাবশেষ বেশ কিছুটা দূরে হলেও হাতের সামনে বলে মনে হত। স্পিতির রূক্ষ সবুজহীন প্রান্তরে ডানখার (৩৮৭০ মিটার)। এখনও তাজমহলের মতো মর্যাদার দাবিদার, নিঃসন্দেহে। দ্বিতীয় দৃশ্যটি দেখা যেত আতারগো পৌঁছে। ওখানে অত জল বয়ে নিয়ে এসেও স্পিতি নদীতে পিনের অসহায় আত্মসমর্পণ মনটা বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু, সেই মহামিলনের দৃশ্য সারা গিদন্ত জুড়ে— আলবাত, বিশ্বশ্রেষ্ঠ চোখজুড়ানো দৃশ্য বলে মনে হতে পারে। আমার, আপনার এবং বাকি সবাইয়ের কাছে। কোনও বিরক্তি চলবে না বস! আই সে, জাস্ট নো আরগুমেন্ট— য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড?

আতারগো যেতে হলে স্পিতি নদীর উপর একটা লোহার ব্রিজ পার হতে হয়। দেখলাম একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর ব্রিজের শেষে দাঁড়িয়ে। একটা হালকা চান্স বলে মনে হল। বেলা তিনটে। কাজা তখনও বাইশ কিমি দূরে। মজবুত শরীরেও বাইশের পর আরও বাইশ কিলোমিটার একটু বেশিই। তবে লিফ্টের প্রয়োজনে অকারণ হ্যাংলামো আমার না-পসন্দ। পার হয়ে তাবো-কাজা পথ ধরে প্রায় কিলোমিটার খানেক এগনোর পর পিছনে গাড়ির আওয়াজ পেলাম। পিছন ফিরে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম একটা সাদা অ্যাম্বাসডর। তা হলে কি সেই গাড়িটাই, ভাবছিলাম। গাড়িটা আচমকাই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। পরিষ্কার ইংরেজিতে জানতে চাইলেন এক জন। তখনও তিনি গাড়ির মধ্যে। কাচ সরে যেতেই তাঁকে দেখতে পেলাম— সেই বিদেশি মহিলা। তাঁর সঙ্গের গাড়িটার রং যে সাদা ছিল আমার মনেই পড়েনি।

আরও পড়ুন: হি পাতাল-ইয়াংসুম-পেলিং-বার্সে-ওখরে

ইফ য়ু ওয়ান্ট, আই উইল গিভ য়ু অ্যা লিফ্ট আপটু কাজা।

ওই অবস্থায় এমন পড়ে পাওয়া সুযোগ হাতে এলে যা হয় তাই হল। কালবিলম্ব না করে আমার স্যাক নিয়ে আমি ম্যাডামের পাশে বসে পড়লাম। বসেই মনে হল, কাজটা ঠিক হল না। যে মেয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে চায়, সে তো যে কোনও সময় মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তখন আর সে সব ভেবে কোনও লাভ নেই।

আমরা দু’জনই একদম চুপচাপ ছিলাম। উনিও আমার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেননি, আমিও না। তবে তার ফলে পরিবেশটা বেশ দমবন্ধ করা হয়ে পড়েছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আমরা কেউ কারও দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। মনে হল, বেশির ভাগ পথটাই আমরা পার করে ফেলেছি। তাই ইচ্ছে হল, আর কিছু না হোক, ম্যাডামের নামটা জানার। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমি তাঁর নাম জানতে চেয়েছিলাম। তার আগে অবশ্য আমি তাঁকে আমার নামটা জানিয়ে দিয়েছিলাম।

লেট মি ইন্ট্রোডিউস মাইসেল্ফ। আই অ্যাম বি নায়ক ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল। মে আই নো ইয়োর নেম, ম্যাম?

হঠাৎ মনে হল, ম্যাডামের মুখটা হলুদ হয়ে গেল। সম্ভবত তিনি মৃদু অস্বস্তি বোধ করলেন। অথচ আমি তাঁকে আমার নামটা বলে তাঁর নামটা জানতে চেয়েছিলাম মাত্র। ম্যাডাম ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।

মিস্টার নায়ক, তুমি মাঝ রাস্তায় হাঁটছিলে। তুমি সাহায্য চাওনি তবু আমি দাঁড়ালাম, মনে হল তুমি বেজায় বিপদে পড়ে গেছ। আমি তোমায় কাজা পর্যন্ত একটা লিফ্ট দিতে চাইলাম। তুমি নিলে। সেটাই যথেষ্ট নয় কি?

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এমন ধরনের কথা মানে তো চরম অসৌজন্যতা। কী বলব ঠিক করতে পারলাম না।

তুমি হঠাৎ আমার নাম জানতে চাইছ! স্পর্ধা তো তোমার কম নয়! এক্ষুণি তুমি গাড়ি থেকে নেমে যাও।

কোনও কিছু না বলে নিঃশব্দে আমি গাড়ি থেকে যখন বেরোচ্ছিলাম তখন মহিলা পা দিয়ে আমার স্যাকটা নীচে ফেলে দিলেন। ভাল করে বোঝার আগেই গাড়ি বিপুল গতি নিয়ে কাজার দিকে চলে গেল।

আরও পড়ুন: লাচুং-ইয়ুমথাং-লাচেন-গুরুদোংমার

আমি যে বরাবরই প্রথম শ্রেণির আহাম্মক তা আমি একযুগ আগে থেকেই বিলক্ষণ জানি। তবু আমি বুঝতে পারলাম না, কী কারণে আমাকে এমন হেনস্থা হতে হল। যেন কিছুই হয়নি, যেমন হাঁটছিলাম তেমনই হাঁটতে থাকলাম। ঘণ্টাখানেক দ্রুত হাঁটার পর ছোট্ট একটা ধাবার মতো ছাউনি দেখা গেল। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ধাবা নয়, ছোট্ট একটা টি স্টল। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দেখতে পেলাম। আরও ছিল। অনেকক্ষণ আগেকার দোমড়ানো আলু পরোটা। স্যাক নামিয়ে বসে পড়লাম।

আর মাত্র তিন কিলোমিটার গেলেই কাজা। তবে সত্যি কথা বলতে কী, আমার পা আর চলছিল না। ছোট্ট গ্লাসে পর পর দু’গ্লাস চা খেয়ে সবে দোমড়ানো পরোটায় কামড় দিতে যাব— দেখি সেই ম্যাডাম ছাউনিতে ঢুকছেন। আর অবাক করে দেবার মতো ঘটনাটা তিনি তখনই ঘটালেন। সেটি হল, পিলে চমকানো সৌজন্যে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি হাসিনি ঠিকই, কিন্তু আলগা পাটাতনের বেঞ্চে তাঁকে বসার জায়গা করে দিতে আমি সরে বসলাম। আমার সৌজন্যে পরম সন্তুষ্ট হয়ে তিনি একেবারে আমার গা ঘেঁষে বসলেন। পরিমিত ইঙ্গিতে উনি কয়েক বার বলে গেলেন— নায়ক, আই অ্যাম ভেরি ভেরি সরি।

এই একটা শব্দ নিয়ে বিদেশিরা পর্যায়ক্রমে নাটক করতে পারে। আর আশ্চর্য সোনা সোনা মুখ করে ক্ষমাহীন দুষ্কর্ম ঘটানোর পরও যে কেউ ছাড় পেয়ে যায়, প্রায়শই। তবে ‘সরি’ কথাটা সত্যিই অন্তরের কথা হলে তাকে সহজে অবজ্ঞা করা যায় না। বিদেশিদের কাছে এই শব্দটা অসম্ভব দামি। তবে সহজাত বোধ আর অদম্য মানসিক বিশ্বাসই বুঝতে সাহায্য করে কার ‘সরি’ কতটা দামি। আমার সরল বিশ্বাস থেকে মনে হল ম্যাডাম সত্যি বলছেন। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম।

আপনি অযথাই ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন। আমার কথা আপনার পছন্দ হয়নি। তাই বিরক্ত হয়ে আপনি আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমারই উচিত আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া।

আমার কথা উনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ভাবছিলেন, রাগের বশে আমি ওনাকে নিয়ে মজা করছি।

তুমি ঠিক বলছ?

আমি বোধহয় হেসে ফেলেছিলাম। তার মধ্যেই বলতে হল।

একদম ঠিক বলছি।

সঙ্গে সঙ্গে ওই দেহাতি লোকজনের সামনেই উনি আমার গালে আলতো করে চুমো খেয়ে উঠে পড়লেন।

একটু লজ্জা পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু টি-স্টল থেকে উঠে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। বিভিন্ন সময়ে পাহাড় ছাড়াও সমতলে আমার সঙ্গে বিদেশি মানুষজনের সংযোগ ঘটেছে। বেশ কয়েক বার কিঞ্চিৎ ব্যাপক মাত্রায়। তা থেকে মনে হয়েছে, তারা উচ্ছ্বাস বা অনুভূতি জোর করে আড়াল করতে শেখেনি। এত বেশি খোলামেলা আচরণে তারা অভ্যস্ত যে সময়-সময় ভারি অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এ সব পরিস্থিতিতে সেই-ই পাশ করে যায় যে সব অবস্থার সঙ্গেই মোটামুটি মানিয়ে নিতে পারে। এ ব্যাপারে আমার রেকর্ড খুব একটা মন্দ না। তাই জানতাম, ম্যাডাম কয়েক ঘণ্টার জন্য আর আমার সামনে আসবেন না।

সন্ধের মুখে কাজা পৌঁছে আমার হোম-স্টে-র মালিক ওয়াংগেল জানাল, কাল সকালেই রুমটা ছেড়ে দিলে ভাল হয়। একটা বড় পার্টির সব ঘরগুলোই চাই। তারা সকালে এসেই উঠতে চায়। অল্প ভেবে ঘাড় নাড়লাম। ঘরটা ছেড়ে দেব জেনে যেতেই খুশি হয়ে সে চলে গেল। ঘরটার উত্তর দিকের এক ফালি জানলা দিয়ে চোখে পড়ে একটা চলনসই রেস্টুরেন্ট। পকেটে টান-পড়া লোকজন ওখানেই নাস্তা সারতে আসে। আমিও। হঠাৎ নজরে পড়ল, সেই ম্যাডাম ওখানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। হাতে চায়ের কাপ। ভেবেছিলাম স্পিতি নদীর ধারে পুরনো কাজা শহরে যাব। কিন্তু বেরলাম না। ওনার নজরে পড়লে অযথা সমস্যায় পড়তে পারি।

কিছু পরে বেরিয়ে পুরনো কাজা থেকে ফিরছিলাম। পৌনে আটটার পর কাজা শহরের রাস্তায় আশি ভাগ মানুষই মাতাল। তাদের মধ্যে দিয়ে কোনও মতে হোম-স্টের কাছে এসে এক্কেবারে ম্যাডামের মুখোমুখি। বেশ অবাক হলাম। এত স্বাচ্ছন্দ্য যাঁর তিনি হঠাৎ এত রাতে এমন নিম্নবিত্তের এলাকায় ঘোরাঘুরি করছেন কী প্রয়োজনে!

আমাকে সামনে দেখে উনি খুশিতে উপচে উঠলেন। আবার কিছুটা বিরক্তও হলেন। কখন থেকে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু কেউই তোমার খবর দিতে পারছে না। থাকার জন্যে তুমি আর জায়গা পেলে না।

যেন কত দিনের পরিচয়। আমি কোথায় থাকব সেটাও উনি ঠিক করে দেবেন। এই না হলে ম্যাডাম। মৃদু ঠেস দেবার ইচ্ছে হল।

আমাকে খুঁজছেন হঠাৎ। ভাল করে তো আমাদের পরিচয়ই হয়নি।

খপ করে আমার হাতটা ধরে রেস্টুরেন্টের বেঞ্চিতে বসিয়ে দিলেন। ফাঁকা চার দিক। গা ঘেঁষে বসে অসম্ভব মেপে এক চিলতে হাসলেন।

নাই বা হল পরিচয়। আমি কিন্তু আমার মতো করে তোমাকে ঠিক চিনে নিয়েছি।

ঠেসটা কাজে এল না। এত তাড়াতাড়ি মানুষটা খোলস ছেড়ে একটু একটু করে সামনে চলে আসতে পারে বিশ্বাস হচ্ছিল না। হঠাৎ কেন এত খোঁজাখুঁজি জানতে চাইলাম। দূরে, অন্ধকার পাহাড়ের দেওয়ালে চোখ রেখে জানতে চাইলেন।

তুমি কবে মানালি ফিরবে?

কাল সক্কালেই। মনে ভোর চারটে দশে আমার বাস ছাড়বে।

অসম্ভব অবাক হয়ে পড়লেন ম্যাডাম।

সে কী! ভেবে রেখেছিলাম কিছুটা সময় তোমার সঙ্গে কাটাব।

আমিও অসম্ভব অবাক হলাম। বলেন কী মহিলা। কিছুটা সময় আমার সঙ্গে কাটাতে চান! তবে এটা ঠিক, এত দ্রুত কাজা ছেড়ে চলে যেতে পারি এটা উনি ভাবতে পারেননি।

তা হলে আজ থাক। কাল সকালেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা করব।

তারপর আচমকাই উঠে পড়লেন। সামান্য এগিয়ে গিয়ে গড়িতে উঠে বসলেন।

আরও পড়ুন: সামাটার... ছালামথাং... রাবংলা... নামচি...

কনকনে ঠান্ডা আর হু হু বাতাস সরিয়ে আবছা অন্ধকারে স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি ম্যাডাম আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আমার সঙ্গে উনি ভিড় ঠেলে বাসের ভেতর ঢুকে পড়লেন। অথচ তার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। আমার কোনও কথাই উনি কানে তুললেন না। অকথ্য ঠেসাঠেসি, দুর্গন্ধ আর ধূমপানের উৎকট ধোঁয়ায় দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় হওয়া সত্ত্বেও ম্যাডাম দাঁড়িয়ে থাকলেন। গাড়ি ছাড়ার প্রথম হর্ন বাজতেই উনি প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চাইলেন—

আজ থেকে সাত দিন পর তুমি সিমলায় আসতে পারবে?

মানালিতে কয়েক দিন থেকে আমার সিমলাতেই যাওয়ার কথা। মুখ তুলে তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল, সত্যিই উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। হয় এমন হঠাৎ করে। আবেগে মনটা নরম হয়ে উঠলে কোনও মানুষীর প্রতি সহসা আকর্ষণ বেড়ে যায়। কিচ্ছু করার থাকে না। উত্তরটা দিতেই হল।

না, ম্যাডাম! সেটা সম্ভব হবে না। আমাকে দ্রুত কলকাতায় ফিরে যেতে হবে।

অনেকটা সময় পর তাঁর মনে হল, কোথাও একফালি প্রত্যুত্তর দেওয়া দরকার। উনি সেটাই করলেন।

ঠিক আছে। পরে তা হলে কখনও দেখা হবে। তখনই আমরা কথা বলতে পারি।

বুঝলাম, প্রচুর আবেগ আড়াল করতেই উনি কথাগুলো বললেন। আমিও পিছিয়ে থাকতে চাইলাম না।

অবশ্যই দেখা হবে, ম্যাডাম। তখনই আমরা কথা বলব। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।

অসম্ভব অবাক হয়ে গেলেন। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।

সত্যি বলছ, তুমি অপেক্ষায় থাকবে?

একদম সত্যি!

আমি সিট থেকে উঠে দাঁড়াতেই উনি আমাকে প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। সেই দৃশ্য দেখে বাসের মধ্যে দেহাতি মানুষজন, যাকে বলে এক্কেবারে থ!

শেষ হর্ন বাজিয়ে বাস চলতে থাকল। তারই মধ্যে অদ্ভুত তৎপরতায় ম্যাডাম নেমে গেলেন। মুহূর্তে একটু একটু করে সব পিছনে চলে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE