Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিরিবিলি সন্ধ্যায় সান্দাকফুর ট্রেকার্স হাটে বসেছিল জমাটি আড্ডার আসর

বরফে ঢুকে এখানে ওখানে স্তূপ হয়ে রয়েছে। তবে সব থেকে বেগ পেয়েছিলাম ছবি আঁকতে গিয়ে...সান্দাকফু ট্রেকিংয়ের আজ তৃতীয় পর্ব।গুটিসুটি হয়ে বসে গল্পগুজব করে, পায়ের কাছে রাখা থাকে জ্বলন্ত কয়লা ভরা বড় কাংড়ি। আলো বলতে বাইরের চালা থেকে ঝুলন্ত একটা টিমটিমে সোলার ল্যাম্প-ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, বড় জোর একটা-দুটো মোমবাতি, চোরাগোপ্তা হাওয়ার চোটে যেগুলো বেশি ক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা অসম্ভব।

বরফে ঢাকা সান্দাকফু-২০০৩

বরফে ঢাকা সান্দাকফু-২০০৩

দেবাশীষ দেব
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৭ ২২:২৪
Share: Save:

এই সব পাহাড়ি অঞ্চলে সারা বছর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বিদেশিদের ভিড় লেগে থাকে। খুব সহজে এঁদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলা যায়। মনে আছে প্রথমবার সান্দাকফুর ট্রেকার্স হাটে আমি আর অভিজিৎ ছাড়া সবাই ছিল বিদেশি। সন্ধেবেলা জমায়েত হত তিন দিকে জানলাওয়ালা বড় লাউঞ্জটায়। আলো চলে গেলে এখানে একেবারেই কিছু করার থাকে না। সাতটার মধ্যেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে যে যার ঘরে গিয়ে কম্বলের নীচে সেঁধিয়ে যায়। মাঝের সময়টা কাটে খাবার টেবিলের চারধারে।

আরও পড়ুন: সান্দাকফু রওনার আগে ব্যাগে ভরলাম ড্রইংখাতা

গুটিসুটি হয়ে বসে গল্পগুজব করে, পায়ের কাছে রাখা থাকে জ্বলন্ত কয়লা ভরা বড় কাংড়ি। আলো বলতে বাইরের চালা থেকে ঝুলন্ত একটা টিমটিমে সোলার ল্যাম্প-ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, বড় জোর একটা-দুটো মোমবাতি, চোরাগোপ্তা হাওয়ার চোটে যেগুলো বেশি ক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা অসম্ভব। ইংরেজ মেয়ে অ্যানি শোনায় ভারত ভ্রমণে এসে ওর নানা মজার অভিজ্ঞতার কথা। আমার পাশের গোলগাল আইরিশ মেয়েটি সুরেলা কন্ঠে গান গেয়ে ওঠে কান্ট্রি সং। এত ক্ষণ চুপচাপ বসে সবার স্কেচ করছিলাম, এ বার আমিও শুনিয়ে দিই ওদের সুর থেকে নেওয়া রবি ঠাকুরের ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া...’। এই গলায় গান...ঘোরতর আস্পর্ধা বটে। তা-ও শেষে দেখলাম হাততালি দিল সবাই। জার্মানির ‘বন’ শহর থেকে আইনিস এসেছে এক বেজায় ঢ্যাঙা আমেরিকান ছেলে বন্ধুকে নিয়ে, যার পাশে হাঁটাচলা করতে গিয়ে আমাদের ছ’ফুটিয়া অভিজিতেরও কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হচ্ছিল। দু’জনের আলাপ লন্ডন এয়ারপোর্টে। কিছু দিন একসঙ্গে ঘুরে ট্যুরে যে যার মতো ঘরে ফিরে যাবে। ছেলেটি মুখচোরা, প্রায় নাক অবধি ঢেকে সারা ক্ষণ শুধু ঝিমোচ্ছিল। অন্য দিকে, আইনিস তুমুল আড্ডাবাজ, ওর ছবিটা দেখে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘‘আপনি শিল্পী?’’ আমি তো অবাক, পরে জানলাম ও বাংলা পড়তেও পারে, এমনকী, সত্যজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটা সিনেমাও দেখেছে।

আইরিনের স্কেচ-১৯৯৯

বছর চারেক বাদে থইথই বরফের মধ্যে এসে এই ট্রেকার্স হাটে থাকতে কিন্তু ভীষণ অসুবিধে হয়েছিল। বেশির ভাগ ঘরই ভাঙাচোরা অবস্থায়। মেরামতের কোনও বালাই নেই।

বরফ ঢুকে এখানে ওখানে স্তূপ হয়ে রয়েছে। তবে সব থেকে বেগ পেয়েছিলাম ছবি আঁকতে গিয়ে। বাইরে তো বেরোতেই পারছি না, ঝড়ের বেগে এমন বরফ গলানো হাওয়া সারাক্ষণ। খোলা জায়গায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা, এত ঠান্ডা! স্পোর্টসম্যান অর্ণব এ দিকে গোটা দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায়, সায়নও বেচারা জবুথবু হয়ে রান্নাঘরের উনুনের সামনে থেকে নড়তেই চাইছেন না। প্রেম শর্মা ওঁকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফুটন্ত চা খাইয়ে যাচ্ছে। বললাম, ‘‘বরফ বরফ করে তো লাফাচ্ছিলি, এখন বোঝ!’’ আমি নিজে এখন মরিয়া, বরফে ঢাকা সান্দাকফু-র দৃশ্য আঁকা হবে না? দুগ্গা বলে বসে গেলুম র‌ং-তুলি সাজিয়ে যতটা সম্ভব হাওয়াটাকে আড়াল করে। তুলি ধরা হাত বার বার কেঁপে উঠছে...দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে, চোখ ঝাপসা...একমাত্র রাজা বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে সঙ্গ দিয়ে গেছে, ছেলেটা চিরকাল ওই রকম বেপরোয়া। কী করে যে এঁকে ফেলেছি কয়েকটা ছবি কে জানে। অবশ্য ফিনিশগুলো হয়েছিল ঘরের মধ্যে বসে। এ রকম সুযোগ কি আর রোজ রোজ আসে?

সান্দাকফু-র কথা উঠলেই আমার সব থেকে বেশি মনে পড়ে ‘শে’-র কথা, পুরো নামটা বলেছিল কি না মনে নেই। প্রথম বার গিয়েই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বছর বাইশের ফুর্তিবাজ ইহুদি ছেলে, বুঝিয়েছিল ওদের ভাষায় ‘শে’ মানে হল গিফ্ট বা উপহার।

‘শে’ও তার মাটিতে বসে খাওয়া ১৯৯৯

বাবা ইজরায়েলের কোনও এক গ্রামে চাষবাস করেন, আর ও সুযোগ পেলেই মনের আনন্দে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এ বার বেরিয়েছে ছ’মাসের জন্য। ইন্ডিয়া ঘুরে চায়না হয়ে সোজা রাশিয়া অবধি যাবে। বলল, ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেসে চেপে পুরো রাস্তাটা পাড়ি জমাবার ইচ্ছে আছে। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ঘরের সামনে একচিলতে দাওয়ায় সটান পা ছড়িয়ে বসে দিব্যি ডাল-ভাত খেয়ে নিল ‘শে’। এক বার করে পেঁয়াজে কামড় দিচ্ছে আর বলছে, ‘তোমাদের ইন্ডিয়ান অনিয়ন কি মিষ্টি খেতে আর কোথাও এমন পাবে না।’ এটা আমাদের সত্যিই জানা ছিল না। খাওয়া শেষ করে ‘শে’ তখন দিব্যি সিগারেট ধরিয়ে ফুক ফুক করে টান দিচ্ছে। সান্দাকফু এলে অনেকেই আরও কুড়ি কিলোমিটার হেঁটে ‘ফালুট’ অবধি চলে যায়। উচ্চতাটা কম হলেও পাহাড়টা ওখানে এমন ভাবে বাঁক নিয়েছে যে গোটা রেঞ্জটা আরও কাছে চলে আসে। আমার অবশ্য কোনও বারই যাওয়া হয়নি। ওখানকার ট্রেকার্স হাটটার অনেক দিন হল ঝড়ের ধাক্কায় ভগ্নদশা, সঙ্গে টেন্ট না থাকলে গিয়ে অসুবিধে। সেই তুলনায় সান্দাকফুর হালচাল ক্রমশ বদলেছে। হাজার চারেক টাকা খরচ করলে দার্জিলিং থেকে সরাসরি গাড়ি চেপে এত উচুঁতে উঠে পড়া যাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই— ফলে আসছেও প্রচুর লোক। কষ্ট করে পায়ে হেঁটে উঠতে তাদের বয়েই গেছে। সান্দাকফু দেখে এসেছি...ফিরে গিয়ে এটা বলতে পারলেই তো বাজিমাৎ!

আরও পড়ুন: রাস্তা গুলিয়ে বিকেভঞ্জন হয়ে সান্দাকফুর দিকে না গিয়ে ঢুকে পড়লাম নেপালে

এই দৃশ্য না এঁকে থাকা যায় না-২০০৩

তাই রাস্তায় গাড়িতে অনর্গল ঝাঁকুনি খেতে খেতে আসা এই লোকগুলোকে দেখছিলাম, আপাদমস্তক শাল জড়িয়ে ‘ও মাসিমা ও পিসিমা’ করতে করতে এমন হট্টগোল বাধিয়ে তুলছে, মনে হবে ঠিক যেন দল বেঁধে পুরীতে এসেছে। যাতায়াত সহজ হয়ে যাওয়াতে ভিড় বাড়ছে, ফলে সান্দাকফুতে গজিয়ে উঠছে একের পর এক হোটেল। শেষবার গিয়ে আমরা ওই রকম একটা হোটেলেই থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ তত দিনে ট্রেকার্স হাটগুলোর দফারফা হয়ে গিয়েছে। কেয়ারটেকার প্রেম শর্মা বেচারা নিজেই বারণ করল।

আমাদের ‘শেরপা শ্যালে’র ব্যবস্থা যথেষ্ট আরামদায়ক। থাকা-খাওয়া চমৎকার, ঘরের লাগোয়া টয়লেট, যত খুশি গরম জল (অবশ্য বাড়তি খরচে), সন্ধেবেলা ঝলমলে আলো, চকোলেট-বিস্কুট-সিগারেট-মদ সব কিছুই মজুত। পাশের রান্নাঘর থেকে গরম গরম চাউমিন বানিয়ে এনে দিচ্ছে হাসিখুশি মেয়েগুলো...লোকে জমিয়ে খাচ্ছে। জোর আলোচনা চলছে, কারও মোবাইল ফোনে বেজে উঠছে হিন্দি সিনেমার গান। সব মিলিয়ে রীতিমতো গমগমে পরিবেশ যাকে বলে। এই দুর্গম পাহাড়ের মাথায় বসে সন্ধেটা তাই মন্দ লাগার কথা নয়। তবু জানি না কেন খালি মনে হচ্ছিল, ট্রেকার্স হাটের সেই আধো অন্ধকার নির্জনতাটা আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

লেখক পরিচিতি: লেখক প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট। কিন্তু তুলি-কলমের বাইরেও আদ্যন্ত ভ্রমণপিপাসু। সুযোগ পেলেই স্যাক কাঁধে উধাও। সঙ্গে অবশ্য আঁকার ডায়েরি থাকবেই।

অলঙ্করণ: লেখকের ডায়েরি থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE